0315adda
|
সুপ্রিয় শ্রোতা আমি ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা। সাপ্তাহিক 'কফিহাউসের আড্ডা' অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। এ সপ্তাহের আড্ডার বিষয় হচ্ছে: অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর আস্থাশীল চীন। আজকের অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন ড. মোস্তাক আহমেদ গালিব। তিনি বর্তমানে চীনের উহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'এক অঞ্চল, এক পথ' গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করছেন।
সুপ্রিয় শ্রোতা, গত ৩ ও ৫ মার্চ থেকে বেইজিংয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় গণকংগ্রেস (এনপিসি) এবং গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন (সিপিপিসিসি)-র দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। ড. গালিব সবসময় চীনের দুই অধিবেশনের ওপর নজর রেখে আসছেন। এবারের দুই অধিবেশন নিয়েও তিনি নিজের পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য অনুষ্ঠানে দর্শকদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। (স্বর্ণা/টুটুল/মুক্তা)
নিচে তাঁর সাক্ষাত্কারের কিছু অংশ:
" লিয়াংহুই " বা দুই আধিবেশন বলতে প্রতি বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত চীনের এনপিসি(National People's Congress) আর সিপিপিসিসি'র(Chinese People's Political Consultative Conference) অধিবেশনকে বোঝানো হয়ে থাকে। এনপিসি বা National People's Congress আদতে অনেকটা আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মতোই । তবে এর সদস্যসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। গণচীনের সংবিধান সংশোধন ও এর রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব রয়েছে এনপিসির হাতে। অপরদিকে সিপিপিসিসি বা Chinese People's Political Consultative Conference হলো অনেকটা যুক্তফ্রন্ট এর মতো। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) হলো গণচীনের প্রধান রাজনৈতিক ও আদর্শিক দল। গণচীনে সিপিসি ছাড়াও আরও আটটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম রয়েছে। এই আটটি দল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতৃত্বে একসাথে মিলিত হয়ে যে সহযোগিতার প্লাটফর্ম গঠন করেছে তার নামই হলো সিপিপিসিসি বা Chinese People's Political Consultative Conference। সিপিপিসিসি মূলত শাসনপ্রক্রিয়ার একটি উপদেষ্টা সংগঠন বা অ্যাডভাইসরি বডি হিসেবে কাজ করে।
চীনা চান্দ্র বছরের শুরু হয় "ছুন জিয়ে" বা বসন্ত উৎসবের মধ্য দিয়ে । বসন্ত উৎসবের পর চীনা নতুন বছর শুরু হলে চীনারা এসময়টাতেই পুরো বছরের একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে থাকেন ।কাজেই এসময়ে সরকারের এই বিশেষ আধিবেশনও আগামী এক বছরের মহাপরিকল্পনা বটে।আর সেকারনেই চীনের এই " লিয়াংহুই " বা দুই অধিবেশনের ওপর চোখ থাকে সারা বিশ্বের। বর্তমান টালমাটাল ও পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গণচীনের আগামী একবছরের কর্মপরিকল্পনা কি হবে, চীনে নতুন কি কি সংস্কার সাধিত হবে, নতুন কি কি প্রণোদনা আসছে , ত্রয়োদশ "লিয়াংহুই" এর এসব মূল বিষয়গুলোই আমাদের আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।
১ চীনের উন্নয়নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়ন
একসময়ের দরিদ্রদেশ চীন এখন উন্নয়নের মডেল। সবচেয়ে বড় উন্নয়নশীল দেশ এটি , বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিও বলা হয় এই দেশকে। দশকের পর দশক দ্রুতগতিতে উন্নয়নের পর অর্থনীতির নিজস্ব নিয়মেই বর্তমানে চীনের উন্নতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিচ্ছে। এটি অর্থনীতির জন্য একটি বিশেষ স্পর্শকাতর ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত বিধায় ২০১৯ সালকে বলা হচ্ছে চীনা অর্থনীতির "অতি গুরুত্বপূর্ন বছর " বা "crucial year"।
এমতাবস্থায় "লিয়াংহুই" এর মূল কৌশল যে চীনের সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঘিরে রচিত হবে তা বলাই বাহুল্য।এবছর জিডিপির গ্রোথ টার্গেট ৬-৬.৫ নির্ধারণ করা হয়েছে । আমরা সবাই জানি চীনের একটি সুবৃহৎ অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে এবং যেখানে বেশ বড় আকারের একটি তরুণ ক্রেতা সমাজ আছে । ধারণা করা হচ্ছে যে এই তরুণ ক্রেতা সমাজই আগামীতে অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে ।
এসব বিষয় মাথায় রেখেই , মূসক (মূল্য সংযোজন কর) ও ব্যক্তিগত কর হারের সীমা পুনঃনির্ধারণ ছিল এবারের অধিবেশনের প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি। এবারের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে উৎপাদন খাতের মূসক ১৬% থেকে কমিয়ে ১৩% এবং নির্মাণ ও যোগাযোগ খাতের মূসক ১০% থেকে কমিয়ে ৯% করার কথা । সর্বোপরি সরকার এ বিষয়ে আরও ছাড় দেবার ও মূসক খাতকে সময়োপযোগী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে । মূসক কমানোর পাশাপাশি সরকার আগামীতে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বীমার খরচ কমানোর এবং অবসর বীমার কিস্তির হার কমানোর ঘোষণাও দিয়েছে ।এছাড়াও রয়েছে চীনের পিছিয়ে পড়া পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের দেয়া ইনসেনটিভ আরও দীর্ঘমেয়াদী করা সহ বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ বিল ১০% পর্যন্ত কমানোর সুযোগ।
কর কমানোর এসব সুযোগের সাথে থাকছে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির আভাসও । নির্মাণখাতে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি থাকছে স্থানীয় সরকারের বণ্ড ইস্যুর ক্ষমতাবৃদ্ধিও । আগে স্থানীয় সরকারের এলাকা ভেদে বণ্ড ইস্যুর সর্বোচ্চ সীমা ১.৩৫ ট্রিলিয়ন আরএমবি থেকে বাড়িয়ে ২.১৫ ট্রিলিয়ন আরএমবি করা হয়েছে।
২ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য চীনা বিনিয়োগের দ্বার আরও একধাপ উন্মুক্তকরন
বিগত ৪০ বছরে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চীনে ৯৫০০০০ টি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছেন ।তাঁদের এই বিশাল বিনিয়োগ যে চীনের রকেট গতির উন্নয়নে বিশেষ ভুমিকা রেখেছে তা বলাই বাহুল্য । ৪০ বছর আগের যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই প্রেক্ষাপট বর্তমানে আর নেই। কাজেই সেই পুরনো বিদেশী বিনিয়োগ আইন (যা বিদেশী বিনিয়োগের তিন আইন নামে পরিচিত ছিল) বদলে নতুন ,যুগোপযোগী ও বিদেশি বিনিয়োগ বান্ধব আইন প্রণয়ন ছিল সময়ের দাবী। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৮ সালের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর চীনে বিনিয়োগকারী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্যোগকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয় : চীনা-বিদেশী যৌথ উদ্যোগ, চীনা-বিদেশী সহযোগিতার উদ্যোগ এবং সম্পূর্ণ বৈদেশিক মালিকানাধীন উদ্যোগ। ১৯৭৯ সালে চীন "চীন-বিদেশী যৌথ উদ্যোগের আইন " ঘোষণা করা হয় । ১৯৮৬ সালে "সম্পূর্ণ বৈদেশিক মালিকানাধীন উদ্যোগ আইন" এবং ১৯৮৮ সালে "চীনা-বিদেশী সহযোগিতার উদ্যোগ আইন" ধারাবাহিকভাবে বলবত করা হয়। চীনে এই তিনটি আইনকে একত্রে "বিদেশী বিনিয়োগের তিন আইন " হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
এবারের "লিয়াংহুই" উপলক্ষে দেয়া ভাষণে চীনের প্রধানমন্ত্রী লী খ্যা ছিয়াং সেই নতুন আইন প্রণয়নের ঘোষণা দিয়ে বলেন ,আমরা বিদেশী বিনিয়োগের জন্য ভবিষ্যতে একে একে আরও বিভিন্ন খাত উন্মুক্তকরণ অব্যাহত রাখবো। এব্যাপারে আমরা খুব শীগগিরই একটি বিদেশী বিনিয়োগে খাতের তালিকাও প্রকাশ করতে যাচ্ছি । এর পাশাপাশি এবছরই সাংহাই ফ্রি ট্রেড জোনে বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ ও সময় বৃদ্ধি করা হবে ।.
৩ উন্নয়নের নতুন খাত সনাক্তকরণ
এবারের " লিয়াংহুই " বা দুই অধিবেশনের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল দুটি বিশেষ শব্দ , যার একটি হলো সংস্কার (reform) ও অন্যটি হলো উদ্ভাবন (innovation )। ধারনা করা যায় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ,ইলেকট্রিক গাড়ী ,বায়োটেকনোলজি ও হাই টেক খাতগুলো নিয়ে সরকার খুবই আশাবাদী । চীনা নেতৃত্ব মনে করেন ভবিষ্যতে এ খাতগুলোর বিকাশের সাথে চীনের উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।কাজেই এ খাতগুলো পাচ্ছে সব ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। স্মার্টফোন, টেলিকম, সোলার ও অন্যান্য প্রযুক্তি খাতে চীনের চোখ ধাঁধানো সাফল্যের ফল হিসেবে এসব খাতেও সরকারের প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। জানা গেছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মোট বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে ১৩.৪% বৃদ্ধি করে ৩৫৪.৩১ বিলিয়ন আরএমবি করা হয়েছে ।
এসবের পাশাপাশি সরকার এবার নজর দিয়েছে চীনের ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। ওপরে বর্ণিত কর সুবিধাদির পাশাপাশি এদের জন্য থাকছে সহজ শর্তে উদ্ভাবনী ঋণ ও কর অবকাশ সুবিধা।
৪ চীনা গণমানুষের জীবনমান উন্নয়ন
চীনের দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প "গরিবি হঠাও" আন্দোলনে সরকারের রয়েছে চোখ ধাঁধানো সাফল্য । "গরিবি হঠাও" আন্দোলন শুরুর ৬ বছরে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি কমেছে। গত বছরের হিসাবমতে , চীনের পূর্বাঞ্চলের ৯টি প্রদেশের মধ্যে ৮টি সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে চীন অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে দরিদ্র লোকের সংখ্যা আরো ১ কোটি কমাবে। এসব দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্পের অংশ হিসাবে এবছর ১১ মিলিয়ন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হবে । এসবের পাশাপাশি জনগণের জীবনমান উন্নয়নের দিকে চোখ রেখে করমুক্ত আয়ের সর্বোচ্চ সীমা ৫০০০ আরএমবি এবং মোবাইল ইন্টারনেট খরচ ২০% পর্যন্ত কমানো হয়েছে। ক্যান্সার গবেষণার উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দসহ বৃদ্ধ ও রোগীদের বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার বিধান রাখা হয়েছে ।
এক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিতকরনের কথা বিশেষভাবে না বললেই নয় । চীন সরকারের "তিনটি কঠিন যুদ্ধের " ( দূষণ কমানো, দারিদ্রতা কমানো ,দুর্নীতির ঝুঁকি কমানো) প্রথমটিই হলো পরিবেশ দূষণ বিশেষত পি এম ২.৫ এর দূষণ কমিয়ে মানুষের জীবনমান উন্নত করা ।
৫ সর্বস্তরে আইনের শাসনপুষ্ট নতুন চীন বিনির্মাণ
দারিদ্র বিমোচনে চীনের এই সাফল্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যাবে যদি না সুষম উন্নয়ন ও দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করা যায়। সুষম উন্নয়নের মুল ভাবনাটি হলো গ্রামাঞ্চল বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে আসলে বেশি দূর আগানো যায় না, তাছাড়া চীনের কিছু কিছু দুর্গম এলাকা এখনও দারিদ্রপীড়িত। এই অনগ্রসর এলাকার লোকজনও গণচীনের উন্নয়নের সুফলভোগের দাবিদার।
দুর্নীতি হলো উন্নয়নকে কুরে কুরে খাওয়া এক ভাইরাস । কাজেই উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চীন সরকার ২০১২ সালে শুরু করে দুর্নীতি বিরোধী বিশেষ অভিযান ।এ অভিযান এখনও চালু আছে । চীনা জনগণের "চীনা স্বপ্ন"(Chinese Dream) বাস্তবায়নে ও "সমৃদ্ধ সমাজ"(moderately prosperous society) গঠনে আইনের শাসন নিশ্চিত করা বিশেষ গুরুত্ববহ।
পরিশেষে বলতে হয় চীনকে বাদ দিয়ে বিশ্ব নয় আবার বিশ্বকে বাদ দিয়ে চীন নয় বিধায় চীনের স্থিতিশিল উন্নয়ন আসলে এক অর্থে গোটা বিশ্বের উন্নয়নেরই একটি ধাপ মাত্র। কাজেই আশা করা যায় এবারের " লিয়াংহুই " বা দুই আধিবেশন যেমন চীনের উন্নয়নে ভুমিকা রাখবে তেমনি ভাবে সমাদৃত হবে বিশ্বজুড়ে।
ডঃ মোস্তাক আহমেদ গালিব
পরিচালক , " এক অঞ্চল এক পথ " গবেষণা কেন্দ্র
ঊহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ,গণচীন
Dr.ahmed.galib@whut.edu.cn