0127
|
বন্ধুরা, কয়েকদিন আগে সিআরআইয়ের ক্যান্টিনে আমার শিক্ষক প্রফেসর পাই-এর স্ত্রী ওয়াং আন্টির সাথে আমার দেখা হয়। আমরা একসাথে অনেক কথা বলেছি। তিনি আমার অনেক আপন মানুষ, আসলে পরিবারের মত। এজন্য আমরা অনেক কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেন যে, ইতোমধ্যে বসন্ত উত্সবের জন্য কেনাকাটা শুরু হয়েছে।
টুটুল: ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে?
আকাশ: হ্যাঁ। আগে বসন্ত উত্সব উপলক্ষ্যে পরিবারের সদস্যদের জন্য অনেক আগে থেকেই কেনাকাটা শুরু করতে হতো। এ ছাড়া আগে বসন্ত উত্সবের সময় কয়েকদিন দোকানও বন্ধ থাকতো।
টুটুল: আমাদের বাংলাদেশের ঈদের মত, তাইনা?
আকাশ: হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছো। এজন্য অনেক আগেই অনেক জিনিস, যেমন মাছ, মাংস, সবজিসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনে রাখতে হতো। এখন আমার মনে আছে, আমার আত্মীয়স্বজনরা ভাজা মাছ খেতে অনেক পছন্দ করেন। এজন্য বসন্ত উত্সবের আগে আমার মা দাদার বাড়িতে গিয়ে অনেক মাছ ভাজি করতেন। অনেক কষ্টকর।
টুটুল: মাছে ভাতে বাঙালি, ভাইয়া, চীনারাও মাছ খেতে অনেক পছন্দ করেন?
আকাশ: হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। বিশেষ করে আমার পরিবার, আমার বাবা একসাথে অনেক ভাজা মাছ খেতে পারেন। এখন আসলে সবসময় সুপারমার্কেট খোলা থাকে, বসন্ত উত্সবেও খোলা থাকে। আসলে বাংলাদেশেও এখন একই অবস্থা, তাইনা? আমি দেখেছি ঈদের সময় উত্তরায় আগুরা, স্বপ্ন, ফ্যামিলি নিডসসহ সব সুপার মার্কেট খোলা থাকে, তাইনা?
টুটুল: হ্যাঁ। ভাই, আপনি ঠিকি বলেছেন।
আকাশ: এ ছাড়া এখন বসন্ত উত্সবের সময় এত বেশি খাবারও তৈরি করে না সবাই। এজন্য এখন বসন্ত উত্সবে এত বেশি কেনাকাটার দরকার পড়ে না। কিন্তু ওই দিন ওয়াং আন্টি বলেন যে, তিনি এখন থেকে বসন্ত উত্সবের কেনাকাটা শুরু করেছেন। একথা শুনে মনে অনেক উষ্ণ অনুভূতি তৈরি হয়। বসন্ত উত্সবে সবাই মিলে সুন্দর খাবার খান, গল্প করেন। এই মুহূর্তটির জন্য আমরা অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে থাকি।
টুটুল: ...
সংগীত
আকাশ: ভাই, তুমি 'দ্যা ওয়ান ম্যান অলিম্পিকস' নামক একটি চলচ্চিত্র দেখেছো?
টুটুল: না, এটা কিসের চলচ্চিত্র ভাই?
আকাশ: এই চলচ্চিত্রটি একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে নির্মিত হয়। তার নাম লিউ ছাং ছুন। তিনি চীনের পক্ষ থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়া প্রথম খেলোয়াড়। আজ আমরা তার গল্প শুনবো, কেমন?
টুটুল: দশম অলিম্পিক গেমস ১৯৩২ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১৪ অগাস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে আয়োজিত হয়। মোট ৩৭টি দেশের ১৩৩১জন খেলোয়াড় এতে অংশ নেন। এতে চীন প্রথম বারের মত অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে খেলোয়াড় পাঠায়। কিন্তু শুধু একজন। তার নাম লিউ ছাং ছুন। তিনি চীনের পক্ষ থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়া প্রথম খেলোয়াড়।
১৯০৯ সালে লিউ ছাং ছুন চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর তালিয়ানের হে খ্যও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ৯ বছর বয়সের সময় তার মা অসুস্থতার কারণে মারা যান। তিনি বাবার সাথে শহরে গিয়ে জুতা তৈরি করে জীবনযাপন করা শুরু করেন। পাশাপাশি তাকে পাহাড়ে উঠে পশুপালকের কাজ করত হয়। সারাদিন পাহাড়ে উঠে দৌড়ানোর কারণে তার একটা শক্ত শারীরিক ভিত্তি তৈরি হয়। এরপর তার বাবা অর্থ খরচ করে তাকে স্কুলে পাঠান। প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় তিনি রানিং করেন।
১৯২০ সালে লিউ ছাং ছুন ১১.৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার এবং ৫৯ সেকেন্ডে ৪০০ মিটারের দৌড়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এই রেকর্ডের কারণেই তিনি স্পোর্টস বিষয়ের একজন ছাত্র হন।
১৯২৯ সালে ২০ বছর বয়সী লিউ ছাং ছুন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন- 'চীন-জাপান-জার্মানি প্রতিযোগিতা'। তিনি এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এই প্রতিযোগিতায় তিনি ১০.৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটারের দৌড়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। পাশাপাশি তিনি ২১.৭ সেকেন্ডে ২০০ মিটারের দৌড়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এটা হলো দূরপ্রাচ্য অঞ্চলের সবচেয়ে ভালো রেকর্ড। জেনারেল চাং শুয়ে লিয়াং এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন। তিনি এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খেলোয়াড় তৈরি করতে চান।
১৯৩১ সালে জাপান চীনের উত্তরাপূর্বাঞ্চল দখল করে। এরপর ১৯৩২ সালে জাপান চীনের উত্তরাপূর্বাঞ্চলে পুতুল রাষ্ট্র তথাকথিত 'মাঞ্চুখুয়ো' স্থাপন করে। বিশ্বে মাঞ্চুখুয়োর সুনাম ছড়িয়ে দেবার জন্য জাপানিরা দু'বার লিউ ছাং ছুনের বাসায় গিয়ে তাকে অনেক বেতনের এবং অনেক উচ্চ পর্যায়ের পদ দেবার জন্য প্রতিজ্ঞা করে। এমনকি, তখন তথাকথিত মাঞ্চুখুয়োর পত্রিকায় মিথ্যা খবর প্রকাশ করা হয় যে, লিউ ছাং ছুন মাঞ্চুখুয়োর পক্ষ থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশ নেবেন।
এ খবর জানার পর, লিউ ছাং ছুন দ্রুত থিয়ান চিনের 'তা কং পাও' নামক একটি পত্রিকায় এক ঘোষণা প্রকাশ করেন। এতে তিনি বলেন: "আমার মধ্যে নীতিবোধ ও গরম রক্ত এখনও আছে, আমি কিভাবে মাতৃভূমি ভুলে গিয়ে জাপানের পুতুল রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবো?"
এ ছাড়া লিউ ছাং ছুন জেনারেল চাং শুয়ে লিয়াংয়ের সাথে যোগাযোগ করেন এবং জানান যে, তিনি চীনের পক্ষ থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে চান। জেনারেল চাং শুয়ে লিয়াং তা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন।
এ বছরের জুন মাসে তং পেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ডিন হাও কেং সেং লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে লিউ ছাং ছুনের অংশ নেয়ার ব্যাপারে চীনের স্পোর্টস প্রমোশন কমিটিকে জরুরি ফোন দেন। সবাই অল্প সময়ে তাকে এ অলিম্পিকে পাঠাতে রাজি হন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সব খরচ লিউ ছাং ছুনকে বহন করতে হবে। এ খবর জানার পর জেনারেল চাং শুয়ে লিয়াং সংশ্লিষ্ট সব টাকা লিউ ছাং ছুনকে দেন।
১ জুলাই, চাং শুয়ে লিয়াং তং পেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন যে, দশম অলিম্পিক গেমসে চীনের পক্ষ থেকে অংশ নিতে সমর্থনের জন্য তিনি লিউ ছাং ছুন এবং ইয়ু শি ওয়েইকে ১৫০০ মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা দেবেন। এরপর লিউ ছাং ছুন চীনের দক্ষিণের শহর শাংহাইয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। কিন্ত জাপানি বাহিনী ইয়ু শি ওয়েইকে গৃহবন্দি করে। এজন্য শুধুমাত্র লিউ ছাং ছুন চীনের পক্ষ থেকে প্রথম বারের মত অলিম্পিক গেমসে অংশ নেন।
এ বছরের ৬ এবং ৭ জুলাই তার জন্য শাংহাইয়ে বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। তখন প্রায় দুই হাজার লোক এতে অংশ নেন। ৮ জুলাই লিউ ছাং ছুন শাংহাই থেকে জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। আর এর সাথেই শুরু হয় চীনের অলিম্পিক গেমসের প্রথমযাত্রা।
সাগরে ২১ দিন যাত্রা শেষে তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছান। কিন্তু যাত্রার ক্লান্তির কারণে তিনি অলিম্পিকে সেরা পারফরমেন্স করতে পারেন না। কিন্তু এটা হলেও তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে আসার সময় জনগণ তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তখন প্রথমবারের মতো অলিম্পিক গেমসে চীনা খেলোয়াড় অংশ নিয়েছেন। এর পাশাপাশি বিশ্বের সবাই দেখতে পারে যে লিউ ছাং ছুন চীনের পক্ষ থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছেন।
১৯৩৩ সালে চীনের জাতীয় গেমসে, লিউ ছাং ছুন ১০.৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার এবং ২২ সেকেন্ডে ২০০ মিটারের দৌড়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন এবং চ্যাম্পিয়ন হন। তার ১০.৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটারের দৌড়ের রেকর্ড ২৫ বছরের মধ্যে দেশের কেউ ভাঙতে পারে নি।
নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর তিনি তালিয়ান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এর মধ্যে তিনি পঞ্চম সিপিপিসিসি'র জাতীয় কমিটির সদস্য ও চীনের অলিম্পিক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সবসময় খেলাখুলার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। ১৯৮৩ সালে শাংহাইয়ে ন্যাশনাল গেমস আয়োজনের প্রাক্কালে ৭৪ বছস বয়সী লিউ ছাং ছুন মারা যান।
চীনের খেলাধুলা এবং অলিম্পিকের জন্য লিউ ছাং ছুনের যে অবদান তা সবসময় স্মরণীয়। বর্তমানে তালিয়ান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিউ ছাং ছুন-এর নামে একটি স্টেডিয়াম রয়েছে। তার অধ্যবসায় সবসময় চীনা জনগণকে উত্সাহিত করে আসছে।