চীনের সংস্কার ও উন্মুককরণ নীতি এবং গ্রামাঞ্চলে এর প্রভাব
  2019-01-22 10:06:56  cri

গত ৪০ বছরে চীনের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। উন্নতি ঘটেছে চীনের মানুষের জীবনমানেরও। চীন কৃষিপ্রধান দেশ থেকে একটি শিল্প-প্রধান দেশে পরিণত হয়েছে। 'বিশ্ব কারখানা' তকমা তো লেগেছে অনেক আগেই। এখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এমনকি চীন এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং নব্যতাপ্রবর্তনে দেশে পরিণত হয়েছে। চীনের এই উন্নয়ন বৈশ্বিক উন্নয়নেও রেখেছে বিপুল অপদান।

গত ৪০ বছরে চীনের তিনটি প্রধান শিল্প অনেক উন্নত হয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানের শুরুতে আমি এ বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলব।

১৯৭৮ সালের শীতকালে আনহুই প্রদেশের ফেংইয়াং জেলার সিয়াওগাং গ্রামের ১৮ জন কৃষক প্রথমে ঠিকা ও শ্রমচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে চীনে গ্রামসংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এদের মধ্যে একজন কৃষক হলেন ইয়ান চিন ছাং। তাঁর বর্তমান বয়স ৭৫ বছর। তিনি বলেন, "আগে চীনে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল। আমাদের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু ওই চুক্তির পর জমির ওপর সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর অধিকার নির্ধারিত হয়। এর মাধ্যমে 'যত বেশি কাজ, তত বেশি লাভ' নীতি বাস্তবায়িত হয়।"

সংস্কার কার্যকর হওয়ার দ্বিতীয় বছরেই দরিদ্র সিয়াওগাং গ্রামবাসী অনেক মুনাফা অর্জন করে।

এরপরের ৪০ বছরে গ্রামের অনেক মানুস শহরে কাজ খুঁজে নেন, ব্যক্তিখাতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এভাবে চীনা গ্রামগুলোর উন্নায়নপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। সিয়াওগাং গ্রামেও ২০০৫ সালে ভূমি সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। গ্রামটি শক্তিশালী কোম্পানির বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। ইয়ান জিন ছাং তখন নিজের জমি ভাড়া দিয়েছিলেন। তিনি জানান, বর্তমানে তাঁল জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে। তিনি বলেন, "আমার সাতটি সন্তান আছে। এর মধ্যে পাঁচটি ছেলে এবং দু'টি মেয়ে। আমার দু'টি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলে নিজের ছোট হোটেল খুলে বসেছে এবং অন্য একটি ছেলে সুপারমার্কেটের ব্যবসা করে। তাঁদের জীবনমান উন্নত হয়েছে। আসলে আমরা বেশি ধনী না, আবার খুব গরিরও না। সন্তানদের সবার নিজস্ব গাড়ি আছে।"

ইয়ান জিন ছাংয়ের পরিবারের জীবন আসলে চীনা গ্রামীণ জীবনের বিরাট পরিবর্তনের একটি উদাহরণ। ৪০ বছরে চীনা গ্রামে দরিদ্র লোকসংখ্যা ৭০ কোটি কমেছে, যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যবিমোচনের ৭০ শতাংশ।

চীনের কয়েক লাখ গ্রামের মতো বর্তমান সিয়াওগাং গ্রামেও আধুনিক কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সিয়াওড়াং গ্রামের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) কমিটির সম্পাদক স্যু গুয়াং ইয়ৌ বলেন, "সিয়াওগাং গ্রামে আধুনিক কৃষির মান উন্নত করার জন্য রাষ্ট্র দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়েছে। একটি হচ্ছে: সিয়াওগাং গ্রামে আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্র। এটি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং এটি নির্মিত হবে। এ প্রকল্প বাস্তাবায়িত হলে খাদ্য উত্পাদন-প্রযুক্তির মান উন্নত হবে। অন্য একটি প্রকল্প হচ্ছে: আধুনিক গ্রাম সমৃদ্ধ পরিকল্পনা। বর্তমানের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও চলছে।"

চীনে গ্রামের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি বাস্তবায়নের কাজ শরু হয়েছিল সিয়াওগাং গ্রাম থেকে। তখন থেকে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সার্বিকভাবে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি কার্যকর হয়। ৪০ বছরে চীনের শিল্প ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।

পূর্ব চীনে অবস্থিত ওয়েনচৌ শহরে চিন্ট গ্রুপের (Chint Group) একটি 'স্বচ্ছ কারখানা' রয়েছে। কারখানার উত্পাদনাআ-প্রক্রিয়া শক্তিশালী ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। উত্পাদনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি দৃশ্য রেকর্ড করা হয়। তথ্য-উপাত্ত নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইলে দেখা যায়। ২০১৬ সাল থেকে চিন্ট গ্রুপ জার্মানির কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা করে ফোটোভোলটাইক মডিউল উৎপাদনব্যবস্থা আধুনিক মানের করেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। চিন্ট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মাদাম হুয়াং হাই ইয়ান বলেন, স্বয়ংক্রিয়তার মাধ্যমে উত্পাদনের ক্ষমতা বেড়েছে এবং এতে জ্বালানির ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, "শ্রমিকের সংখ্যা তিন ভাগের দুই ভাগ কমেছে। উত্পাদনের সামর্থ্যও অনেক বেড়েছে। আগে প্রতিবছরে প্রত্যেক শ্রমিকের উত্পাদনের গড় পরিমাণ ছিল এক মেগাওয়াটেরও কম। কিন্তু স্বয়ংক্রিয়তা বাস্তবায়নের পর প্রতিবছরে প্রত্যেক শ্রমিকের উত্পাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ মেগাওয়াটেরও বেশি। পাশাপাশি জ্বালানিসম্পদ সাশ্রয় হয়েছে।"

গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিক থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু দিক পর্যন্ত চিন্ট গ্রুপ ছিল ওয়েনচৌ শহরে বৈদ্যুতিক কেটল বিক্রি করার জন্য একটি ছোট কর্মশালা। কিন্তু এখন গ্রুপটি বিদ্যুৎ শক্তি উত্পাদন, পরিবহন, স্টোরেজ, বিতরণ ও ব্যবহার ছাড়াও ফোটোভোলটাইক উত্পাদন ও ইন্টারনেট'র পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো পরিবর্তন ও সংস্কার করেছে। বর্তমানে গ্রুপটি প্রতিবছর আয়ের ৪ থেকে ১২ শতাংশ প্রযুক্তি ও শিল্পের উন্নয়নে ব্যয় করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চিন্ট গ্রুপ শুধু যে জাতীয় পর্যায়ের প্রযুক্তিকেন্দ্র গড়ে তুলেছে তা নয়, বরং ইউরোপ, উত্তর অ্যামেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে গবেষণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মাধ্যমে বহুমুখী ও উন্মুক্ত গবেষণার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চীনা জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, চীনের নতুন শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা, নতুন শক্তির গাড়ি বিক্রয় এবং স্মার্টফোনের বিক্রয় বিশ্বের সর্বোচ্চ। গত বছর চীনের নতুন বায়ু টারবাইন বিক্রয়, নতুন পিভি ইনস্টলেশন এবং নতুন শক্তি যানবাহন যথাক্রমে বিশ্বব্যাপী বাজারের ৩০%, ৫০% এবং ৬০% এর বেশিা দখল করেছিল।

চীনের দু'টি বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তি উদ্যোগের যৌথভাবে নির্মিত 'হুয়ালং এক নম্বর' পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থানীয় পরিবেশ সুরক্ষা ও কর্মসংস্থান সরবরাহের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। সিজিএন'র মুখপাত্র হুয়াং সিয়াও ফেই বলেন, "আমাদের অগ্রণী প্রযুক্তি আমদানি করা নয় বা অন্য কারো কাছ থেকে ক্রয় করা নয়। আমরা নিজেরাই তা উদ্ভাবন করেছি। আগে আমাদের দাইয়াওয়ান পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল এক শতাংশের কম। কিন্তু বর্তমান হুয়ালং এক নম্বর কেন্দ্র নির্মাণে ব্যবহৃত প্রযুক্তির ৯০ শতাংশেরও বেশি স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত। কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ চীনে তৈরি। কেন্দ্রটিতে ১০ হাজারেরও বেশি যন্ত্রপাতি আছে।"

জানা গেছে, সিজিএন ও ফরাসি শক্তি গ্রুপ যৌথভাবে ব্রিটেনের সঙ্গে নতুন পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প নির্মাণের সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ সম্পর্কে হুয়াং সিয়াও ফেই বলেন, এর মাধ্যমে ব্রিটেন চীনা প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে চলছে।

তিনি বলেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি কার্যকর হওয়ার পাশাপাশি চীনের পারমাণবিক বিদ্যুত উত্পাদনের ক্ষেত্রে অগ্রগতিও অর্জিত হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "৩০ বছর ধরে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নব্যতাপ্রবর্তন করে আসছি। আমরা জানি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে নব্যতাপ্রবর্তনের ফল তাত্ক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না। তারপরও আমরা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।"

এখন চীন হল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক সত্তা, বৃহত্তম রফতানিকারক এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। ৪০ বছরে চীনের আমদানি-রফতানির পরিমাণ ১৯৮ গুণ বেড়েছে। সেবা আমদানি ও রফতানির পরিমাণ ১৪৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা সেবাশিল্প খাতে ব্যাপক পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "চেচিয়াং প্রদেশের ইউ শহরে ই-কমার্স অ্যাকাউন্ট ২.৫ লাখেরও বেশি। 'ই-কর্মাস গ্রাম'-এর সংখ্যা প্রায় একশ। গত বছর ইউ'র ই-কমার্সের বাণিজিক পরিমাণ ছিল ২২.২ বিলিয়ন ইউয়ান।"

চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি কার্যকর হওয়ার ৪০ বছরে জনগণের জীবনমান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি, তাদের জীবনও সহজ হয়েছে। ই-কমার্স উন্নয়নের ফলে লোকজন বাড়িতে বসে কেনাকাটা করতে পারছেন। এক্সপ্রেস শিল্পের উন্নয়নের ফলে ঘরে বসে ক্রেতারা পণ্য পেয়ে যাচ্ছেন সরাসরি কারখানা থেকে।

ডিজিটাল অর্থনীতি ও অন্তঃদেশীয় ই-কমার্স উন্নয়নের পাশাপাশি, চীনা মানুষ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যও ঘরে বসে কিনতে পারছেন। এতে চীনাদের ভোগের অভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। চীনা বাজারের সুপ্তশক্তিও সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চীনের বিখ্যাত ই-কমার্স প্লাটফর্ম টিমাল'র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওয়েই ছেন বলেন, "বিশ্বের বিখ্যাত ব্রান্ডগুলো চীনে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনা মানুষ অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি সতর্ক। তাঁরা প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। সেজন্য বিদেশের ক্ষুদ্র ও মধ্যম পর্যায়ের ব্রান্ডের পণ্য বর্তমান চীনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদি বিদেশি কোনো কোম্পানি চীনের এক শতাংশ ভোক্তা পায়, তাহলে তাদের জন্য যথেষ্ট। কারণ, চীনের বিশাল বাজারের এক শতাংশ বাকি বিশ্বের সম্মিলত বাজারের চেয়ে বড়।"

চীনা শুল্ক বিভাগের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত অন্তঃদেশীয় ই-কমার্সের বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬৭.২ বিলিয়ন ইউয়ান, যা ২০১৭ সালের একই সময়ের চেয়ে ৫৩.৭ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সাল থেকে চীনে অন্তঃদেশীয় ই-কমার্সের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম কার্যকর হচ্ছে। এটি হবে চীনের উন্মুক্তকরণ বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা।

চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র উন্নয়নের অসংখ্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান চীন নতুন পর্যায়ে উঠে গেছে। চীন অব্যাহতভাবে নব্যতাপ্রবর্তন, সমন্বয়, সবুজ, উন্মুক্ত ও অভিন্ন ভোগের ধারণায় নতুন দফা সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040