অরিত্রীর আত্মহত্যা: বদলাবে কি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক?
  2018-12-09 19:28:13  cri

পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় শিক্ষকের কাছে নিজের এবং মা-বাবার অপমান সইতে না পেরে গত ৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী। এ ঘটনা নাড়া দেয় রাজধানীসহ গোটা দেশকে। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের অবন্ধুসুলভ ও অবমাননাকর ব্যবহারের বিষয়টি আরেকবার চলে আসে সামনে।

একসময় ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনে বকাঝকাই শুধু নয়, বেত্রাঘাতসহ নানা ধরণের শাস্তি দিতেন শিক্ষকরা। অভিভাবকরাও মনে করতেন সন্তানদের মানুষ হওয়ার জন্য এ ধরনের শাস্তির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কালক্রমে সে দিন গত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের শুধু শারিরীক শাস্তি নয়, অবমাননাকর কোনো ব্যবহারও এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হলেও এখনো দেশের স্কুলগুলোতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যায়তনগুলোতে এখনো কমবেশি শাস্তির বিষয়টি বহাল রয়েছে। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মাঝেমাঝেই এমন খবর গণমাধ্যমে খবর হয়ে উঠে আসে। আবার তা সময়ের সঙ্গে মিলিয়েও যায়।

কিন্তু এবার অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশক। প্রশ্ন উঠেছে কী এমন ঘটলো যে কোমলমতি অরিত্রীকে আত্মহননের মতো এমন পথে নিয়ে গেল? নিষেধ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে গিয়েছিল সে। বিদ্যায়তন বা শিক্ষদের এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিশ্চয় অরিত্রী ভুল করেছে। ধরা যাক অরাধই করেছে। কিন্তু এর ফল হয়েছে মারাত্মক। সংশ্লিষ্ট শ্রেণি শিক্ষিকা তাকে ভৎর্সনা করেছেন। ঘটনা এ পর্যন্ত হলে কারো বলার কিছু থাকতো না। কিন্তু ঘটনা গড়িয়ে বহুদূর। স্কুল কর্তৃপক্ষ অরিত্রীর মা-বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কন্যার অপরাধের জন্য অপমান করা হয়েছে তার মা-বাবাকে। তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার অর্থাৎ টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। লঘু পাপে গুরুদণ্ড! এতটা সইতে পারেনি অরিত্রী। নিজের অপমান, মা-বাবার অপমান, সহপাঠীদের কাছে লজ্জা, স্কুল থেকে বহিষ্কারের ঝুঁকি- এতটা চাপ নিতে পারেনি কোমলমতি মেয়েটি। বেছে নেয় আত্মহননের পথ।

শিক্ষকদের হাতে শিক্ষার্থীদের নিগ্রহের এমন ঘটনা নতুন নয়। রাজধানীর নামি স্কুল হওয়ায় অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাটি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়। তার সহপাঠী ও অভিভাবকরা বিক্ষোভ করেন। সরকারের নটক নড়ে। ছুটে আসেন শিক্ষামন্ত্রী। আশ্বাস দেন ন্যায় বিচারের। সর্বোচ্চ আদালত তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। অব্যাহতি দেওয়া হয় কলেজ অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষককে। গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে শ্রেণি শিক্ষককে।

এতকিছু ঘটেছে ওই ভিকারুননিসা রাজধানীর নামিদামি স্কুল হওয়ায়। দেশের প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চলের কোনো অখ্যাত স্কুলের কোনো অরিত্রী এমন নিগ্রহের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করলে গণমাধ্যমে দু'একটা খবর হবার পর সব কিছু যেই কি সেই- আগের মতো হয়ে যেত।

কিন্তু এবার অরিত্রীর আত্মহননের ঘটনায় সব মহলেই বেশ তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। এতেও কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে। রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে হয়তো কিছু দিন বেশি থাকবে টেলিভিশনের খবর বা সংবাদপত্রের পাতায়।

বাঙালির প্রধান শিক্ষাচিন্তক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তার বহু নজীর রেখে গেছেন শান্তিনিকেতনে। নিজের শৈশবে শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের স্মৃতিতাড়িত রবীন্দ্রনাথ নিজের ছেলেমেয়েদের স্কুলেই পাঠাননি। বাড়িতে নিজেই পড়াতেন এবং শিক্ষক রেখে পড়িয়েছেন অনেককাল। শিক্ষকদের বলতেন ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু হয়ে উঠতে। কোনো ছাত্র পড়া করছে না- কোনো শিক্ষক অভিযোগ নিয়ে এলে বলতেন- ওটা তারই ব্যর্থতা। শিক্ষকের আকর্ষণ ক্ষমতার চেয়ে যদি পারিপাশ্বিকের কিছু তাকে আকর্ষণ করে সেজন্য ছাত্রটিকে দোষ দিতে নারাজ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের বর্তমান সময়ের অন্যতম শিক্ষাচিন্তক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রায় বলেন, যে শিক্ষক যত খারাপ তিনি তত বেশি পরিমাণে ছাত্রদের বেতিয়ে লাল করেন। আর শিক্ষকদের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, যে তার কান দুটি একটু বেশি বড় কারণ শিক্ষরা টেনে টেনে ও দুটুকে লম্বা করে দিয়েছেন। অধ্যাপক সায়ীদ হয়তো পরিহাসছলে কথাটি বলেন, কিন্তু এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তাবত শিক্ষার্থীর নিগ্রহের বেদনা।

অরিত্রীর ঘটনায় সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্পষ্ট করে বলেছেন, কোনো ছাত্রছাত্রীকে অবমাননাকর কোনো কথা বলার অধিকার কোনো শিক্ষকের নেই। শিক্ষার্থীর ভুল বা অপরাধের কারণে মা-বাবাকে অপমান করার তো প্রশ্নই আসে না। শিক্ষকদের নিজেদের আচরণ পরিবর্তন করে ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক হবার পরামর্শ দেন প্রণম্য এই শিক্ষক।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040