রোববারের আলাপন-181209
  2018-12-09 13:21:51  cri


আকাশ: সুপ্রিয় শ্রোতা, সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠানে। আপনাদের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আমাদের সাপ্তাহিক আয়োজন 'রোববারের আলাপন'। আপনাদের সঙ্গে আছি এনামুল হক টুটুল এবং শিয়েনান আকাশ।

আকাশ: বন্ধুরা, সম্প্রতি আমরা চীনের বিখ্যাত পিংপং (টেবিল টেনিস) খেলোয়াড় তেং ইয়া পিংয়ের প্রশিক্ষণের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করেছি। তিনি পেশাদার পিংপং প্রতিযোগিতা থেকে অবসর নেয়ার পর ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।

আজ আমরা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার আরো কিছু গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, কেমন?

টুটুল: ১৯৯৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, তেং ইয়া পিং বিমানে করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তার জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, পাশাপাশি একটি কঠিন সূচনা বিন্দুও।

তেং ইয়া পিং বলেন, "দ্বিতীয় দিন আমি ক্লাসে যাই, মোট ৯ জন সহপাঠী, ক্লাসরুম তেমন বড় নয়। শিক্ষক প্রথমে আমাদেরকে পরস্পরের কাছে নিজের পরিচয় দিতে বলেন। ক্লাসে বেশি নিয়মশৃঙ্খলা নেই। পড়ানোর সময় ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে প্রশ্ন জিজ্ঞাস করেন। ক্লাস শেষে আমার মাথা ঘুরতে থাকে। ৪টি সপ্তাহ পার হয়েছে, প্রতিদিনে ১৫ বা ১৬ ঘণ্টা শিখতে থাকি। কিন্তু তেমন কার্যকর ফলাফল নেই। ইংরেজিও বেশি উন্নত হয় নি। শিক্ষক কোনো পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করেন না, ক্লাস শুরুর আগে তিনি আলোচনার একটি রূপরেখা দেন। এই স্টাইলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া আমার জন্য খুবই কঠিন"।

"থাকার পরিবেশও তেমন ভাল না। ব্রিটেনে অধিকাংশ বিদেশি ছাত্রছাত্রী ব্রিটিশ পরিবারের বাসায় রুম ভাড়া করে বাস করে। আমিও এটা করেছি। আমি ভেবেছি এটা করলে বেশি করে ব্রিটেনের রীতিনীতি শিখতে এবং জানতে পারবো এবং আরো ইংরেজি চর্চার সুযোগও হবে। কিন্তু আমার থাকার ওই পরিবারের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক দূরে এবং বাসস্থানের ফি অনেক বেশি। প্রতি মাসে বাসা ভাড়া দুইশো পাউন্ডেরও বেশি এবং খাবারের ফি হচ্ছে একশো পাউন্ডেরও বেশি। প্রতিমাসে পাঁচ হাজার ইউয়ানের বেশি খরচ করতে হবে। আমি নিজের খরচে ব্রিটেনে লেখাপড়া করছি। খরচ অনেক বেশি। আমাকে কম খরচ করতে হবে।"

"আমার মনে আছে, একদিন আমি বৃষ্টিতে রেইনকোট পড়ে সাইকেল চালিয়ে ক্লাসরুমে গিয়েছি, এটা আমার সহপাঠীদের কাছে অদ্ভুত লেগেছে। তারা ভেবেছেন, কেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সাইকেল চালিয়ে ক্লাসরুমে আসছেন? হ্যাঁ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও একজন সাধারণ মানুষ, তাইনা? আমি সবকিছু পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করেছি, সব আমার ঘামের মাধ্যমে উপার্জন করেছি। সবকিছু আমাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। লেখাপড়া এবং জীবনের সঙ্গে লড়াই, আশা করি আমি এটা পাস করতে পারব।"

"ব্রিটেনে প্রথম আসার সময়, আমি পোস্টঅফিসের মাধ্যমে চীনে পরিবারকে কিছু টাকা পাঠাতে চাই। পোস্ট অফিসে গিয়ে কিছু ফর্ম পূরণ করতে হবে, কিন্তু লিখতে পারি না। ওখানে কর্মকর্তা আমাকে অনেক সাহায্য করেন। আমি তার পাশে হতবুদ্ধি অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমি কি করতে পারি? কি করব? কাকে জিজ্ঞাস করব, জিজ্ঞাস করেও কোনো লাভ নেই, আমি বুঝতে পারি না। অবশেষে কিছু করতে না পেরে আমি বাসায় ফিরে আসি।"

"নতুন সেমিস্টার শুরুর আগে বাড়িওয়ালা আমাকে পরিবেশ সম্পর্কে জানানোর জন্য গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরতে নিয়ে যান। দ্বিতীয় দিন আমি নিজে সাইকেল চালিয়ে ক্লাসে যেতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমি রাস্তা চিনতে পারি না। পরে অনেক কষ্ট করে ক্লাসে আসি, দেখি আমি দেরি করে ফেলেছি। আমি কখনই দেরি করি নি, আজ রেকর্ড ভেঙ্গেছি। ক্লাসে আমি ইংরেজি ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না, এই মুহূর্তের বিব্রতকর অবস্থার কথা আমি কখনই ভুলতে পারব না"।

তেং ইয়া পিংয়ের ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী বিদেশি। তাদের ক্লাসে চীনের মূলভূভাগের একমাত্র শিক্ষার্থী তিনি।

"প্রথমে ক্যামব্রিজে আসার সময়, আমি অনেক পরিশ্রম করে লেখাপড়া করি, কিন্তু তেমন কার্যকর কোনো ফলাফল নেই। আমি জানি, আমার ইংরেজি খুব দুর্বল, এজন্য আমাকে সব প্রচেষ্টা দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। লেখাপড়া আসলে পিংপং প্রশিক্ষণের মত, কোন শর্টকাট উপায় নেই। সব নিজের প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করতে হবে"।

প্রতিদিন বেশি বেশি লেখাপড়া করার জন্য তেং ইয়া পিং শুধু কয়েক ঘণ্টা ঘুমান।

"প্রথম এক-দুই মাস ক্লাসে আমি শিক্ষকের কথা কিছুই বুঝতে পারি নি। শিক্ষক যা লিখেছেন সব কপি করে আমার নোটবুকে লিখেছি। বাসায় ফিরে আসার পর অভিধানে এক একটি শব্দের অর্থ দেখেছি। প্রতিদিনের জীবন একই রকম, চার-পাঁচ ঘণ্টা ক্লাস। ক্লাস শেষে অনেক হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করতে হয়। খাওয়া-দাওয়াও আমার জন্য অনেক কষ্টের এবং কঠিন ব্যাপার। দুপুরে বিশ্রামের সময় মাত্র দেড় ঘণ্টা। আমি সাধারণত হোস্টেলে ফিরে যাই নি, সকালে হোস্টেল থেকে আনা স্যান্ডউইচ খাই, তারপর কিছু সময় বই বড়ি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যাওয়ার পর, নিজে কিছু টমেটো, ডিম দিয়ে নুডলস বানিয়ে খাই। তারপর লেখাপড়া শুরু করি। প্রতিদিন ১২টার পর লেখাপড়া বন্ধ করে ঘুমাই"।

এরপর তিনি চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। তার গ্রাজুয়েশন থিসিসের নাম "চীনের জাতীয় খেলাধুলা-পিংপংয়ের ইতিহাস ও উন্নয়ন"।

তিনি চমত্কারভাবে তার গবেষণাপত্রের প্রোপোজাল লেখেন এবং সবকিছু সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন।

"অবশেষে আমি আমার ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করি। গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে আমি অনর্গল ইংরেজিতে বক্তব্য দেই"।

আকাশ: বন্ধুরা, ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করার পর তেং ইয়া পিং ব্রিটেনের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি শুরু করেন।

এখন আমরা তার নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, কেমন?

টুটুল: ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে, তেং ইয়া পিং ব্রিটেনের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার মাস্টার্স ডিগ্রি শুরু করেন।

"আমি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আরো পছন্দ করি, ওখানকার দৃশ্য অনেক সুন্দর, আমার অনেক ভালো লাগে। কিন্তু অবশেষে আমি নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করেছি, কারণ এখানকার বিদেশি ভাষা বিভাগ ব্রিটেনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো"।

"আমার শিক্ষক হয়তো আমাকে বেশি জানেন না, তাই তার কিছু চিন্তা আছে। তিনি চিন্তিত যে, একজন খেলোয়াড় গ্রাজুয়েশন করতে পারবে কিনা। আমি তাকে বললাম, "আপনার অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর চেয়ে আমি হয়তো একটু দুর্বল, তাই আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। অন্যরা হয়তো একবারেই বুঝতে পারেন, আমার সম্ভবত দুই বার লাগবে। অন্যদের হয়তো এক বছর লাগবে, আমার হয়তো দেড় বা দুই বছর লাগবে। কিন্তু যত কঠিনই হোক না কেন, আমি করবোই!। আমি অনেক জেদী, যেকোনো কাজ করতে চাইলে সব প্রচেষ্টা দিয়ে তা সম্পন্ন করতে চাই"।

"ব্রিটেনে মাস্টার্স লেখাপড়ার দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হচ্ছে একটি কোর্স শেষ হলে পরীক্ষা দেওয়া; আরেকটি হচ্ছে শিক্ষকের সাথে গবেষণা করা। গবেষণাপত্র সঠিকভাবে সম্পন্ন করলে গ্রাজুয়েশন করতে পারবে। আমি দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মাস্টার্স করি। আমার নিজের শিক্ষক আছে। কিন্তু তার সাথে আমার প্রতিদিন দেখা করার সুযোগ নেই। তিনি আমাকে একটি বইয়ের তালিকা দিয়েছেন, আমি নিজে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই অনুযায়ী লেখাপড়া করি। যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমি আমার শিক্ষকের কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাস করি। প্রথমে আমি এ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে পারি নি। আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে 'সমসাময়িক চীনা অধ্যয়ন'। এই বিষয়ের সঙ্গে খেলাধুলার খুব বেশি সম্পর্ক নেই এবং লাইব্রেরিতে এ সম্পর্কিত তেমন বেশি বইও নেই। এজন্য আমাকে অনেক লাইব্রেরি এবং অনেক বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজতে হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আমি অনেক শিখেছি। এর মধ্য দিয়ে আমি জটিল ও কঠিন অবস্থায় লক্ষ্য বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করেছি"।

"পিংপং খেলার সময় আমার দৃষ্টিশক্তি অনেক ভাল ছিলো, দু'টি চোখের দৃষ্টিশক্তি ছিলো ১.৫। লেখাপড়ার পর আমার চোখ অনেক নষ্ট হয়েছে। এখন একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি মাত্র ০.৬ । লেখাপড়া ও পিংপং একেবারে দুটি ভিন্ন জিনিস। অনেক অনেক ঘুম, ক্লাসে মাঝেমাঝে ঘুম আসে, চোখ খুলতে পারি না, বেশি বসে থাকলে বেশি ঘুম আসে। কিন্তু সামনে শিক্ষক আছেন, ঘুমাতে পারি না, পালিয়ে যেতেও পারি না। প্রথম দিকে মাঝে মাঝে এটা ঘটেছে। তারপর আস্তে আস্তে এটা ঠিক হয়ে যায়। কিভাবে সুষ্ঠুভাবে বিশ্রামের সময় ব্যবস্থা করতে পারি, তা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি।"

"আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে 'একটি সাধারণ মেয়ে থেকে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন'। চীনের নারী পিংপং টিমকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে এ টপিক ব্যবহার করেছি। এ বিষয়টি গবেষণার জন্য আমি কিছু গবেষণা প্রবন্ধ দেখেছি। কিন্তু আমি দেখি যারা এ বিষয় নিয়ে লিখেছেন তারা বেশিরভাগই বিদেশি। তারা আসলে সত্যিকারভাবে চীনের নারী খেলোয়াড়দের জীবন ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বেশি জানেন না। এজন্য তারা এ বিষয়ে গভীর গবেষণা করতে পারেন নি। আমি আশা করি, আমার চেষ্টার মাধ্যমে, চীনের নারী ও নারী খেলোয়াড়দের নিয়ে গবেষণা সম্পর্কে সবাই সত্যিকার তথ্য জানতে পারবে। আমি আরো আশা করি বিদেশে লেখাপড়ার পর আমি আরো ভালভাবে চীনকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো এবং বিশ্ব চীন সম্পর্কে আরো জানতে পারবে"।

প্রতিদিন তেং ইয়া পিং'র ক্লাস থাকে এবং সাপ্তাহিক ছুটিতে তাকে অনেক হোমওয়ার্ক করতে হয়। এটা হলেও, তিনি মনে করেন এটা যথেষ্ট নয়, তিনি পিংপং খেলার মত সব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেন।

তেং ইয়া পিং খেলা থেকে অবসর নেয়ার পর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির তরুণ সদস্য হন। এজন্য তিনি খুব তাড়াতাড়ি অনর্গল ইংরেজি শিখতে চান। তাই তিনি অব্যাহতভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে সুযোগ পেলে তিনি শিক্ষককে প্রশ্ন করেন। শিক্ষক মজা করে বলেন, তার শেখার অবস্থা থেকে বোঝা যায় তিনি একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। "প্রতিবার আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আগে, শিক্ষক সবসময় আমাকে সাহায্য করেন, তিনি আমার বক্তব্য, উচ্চারণ ও বক্তব্যের উপায় ঠিক করে দেন"।

আকাশ: ভাই, আমরা তেং ইয়া পিং'র গল্প ধারাবাহিকভাবে শুনেছি। আসলে, আমি তার গল্প থেকে অনেক কিছু শিখেছি। কিভাবে সফল হতে হয়, কিভাবে সবকিছু ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিভাবে সমস্যার সম্মুখীন হলে তা মোকাবিলা করা যায়, ইত্যাদি অনেক শিখেছি। কেবল পিংপংয়ের ক্ষেত্রেই নয়, তিনি সত্যিই একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমি মনে করি তার স্পিরিট সম্ভবত খেলাধুলার স্পিরিটের একটি অংশ।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040