১০ নভেম্বর শেষ হয়েছে প্রথম চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা। পরের দিনটি ছিল 'সিঙ্গেলস ডে'। সিঙ্গেলস ডে (১১ নভেম্বর) আলিবাবার থিয়ান মাও কর্তৃক প্রচলিত কেনাকাটা উত্সব। দশ বছর আগে এই উত্সব শুরু করেছিল থিয়ান মাও বা টিমল।
চীনের আন্তর্জাতিক আমদানিবাণিজ্যের পরিমাণ ৫৭৮৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪০২২০ কোটি ইউয়ান। আর এবছর সিঙ্গেলস ডে কেনাকাটা উত্সবে কেনাকাটা হয়েছে ২১৩৫০ কোটি ইউয়ান মূল্যের পণ্য। এ দুটি বড় অংক চীনের বিশাল বাজারের পরিচায়ক। চীনের ভোক্তাবাজার চীনের অর্থনীতি উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তিও বটে।
সিঙ্গেলস ডে'তে অনলাইন কেনাকাটা শুরুর মাত্র ৬ ঘন্টা ২৯ মিনিট পর কেনাকাটার মোট পরিমাণ গত বছরের একই দিনের ২৪ ঘন্টার কেনাকাটার মোট পরিমাণকে ছাড়িয়ে যায়। কোনো কোনো বিদেশি ব্র্যান্ড এ দিবসে চীনে ১০ কোটি ইউয়ানের বেশি বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি কয়েক শতাধিক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ইউয়ানের বেশি। কোনো কোনো পণ্য চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় জনপ্রিয়তা পায় এবং মুহূর্তেই অনলাইনে হট আইটেমে পরিণত হয়। অস্ট্রেলিয়ান ফার্মেসী এমন একটি কোম্পানি। থিয়ান মাও প্ল্যাটফর্মে ১১ নভেম্বর তাদের পণ্যের কেনাকাটার মোট পরিমাণ ১০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। কোম্পানির চীনা বিভাগের সিইও চান হুই হুই বলেন, চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় তারা যে ১৫টি পণ্য প্রদর্শন করেছেন, সেগুলো থিয়ান মাও প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক আমদানি মেলার মাধ্যমে আরও বেশি অস্ট্রেলিয়ান ব্র্যান্ড চীনা বাজারে প্রবেশ করতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মার্কিন কসমেটিক ব্র্যান্ড Revlon কয়েক বছর আগে চীনের বাজার থেকে সরে গিয়েছিল। এতে তখন থেকে চীনা ভোক্তারা শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে Revlon-এর পণ্য ক্রয় করতে পারছিল। এবার আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় Revlon কোম্পানিও অংশ নেয় এবং ভোক্তাদেরকে বিনামূল্যে মেকআপ সেবা সরবরাহ করে। পরে দেখা গেল, অনলাইন কেনাকাটা দিবসে তথা সিঙ্গেলস ডে'তে তাদের পণ্যের বিক্রির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আলিবাবার সিইও চাং ইউং জানান, তারা নিজেদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আগামী ৫ বছরে ২০,০০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য চীনা বাজারে আনবেন এবং চীনা জনগণের দুয়ারে তা সরবরাহ করবেন। তিনি সিঙ্গেলস ডে'কে একটি 'বিশ্ব উত্সব' হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
শাংহাইয়ে জাতীয় প্রদর্শনীকেন্দ্রের দক্ষিণ দিকে সম্প্রতি চালু হয় গ্রীনল্যান্ড বিশ্ব পণ্য বাণিজ্য বন্দর। গ্রীনল্যান্ড কোম্পানির চেয়ারম্যান ছাং ইউ লিয়াং জানিয়েছেন, বর্তমানে ৪১টি দেশের ১১২টি কোম্পানি ও সংস্থা এ বন্দরের সেবা নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা চলাকালে গ্রীনল্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে যারা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাদের পণ্য এখনও দোকানে পাওয়া যায়, যেমন: তুর্কি সূর্যমুখী তেল, ভিয়েতনামের ড্রাগন ফল ইত্যাদি।
লোরেল (L'Oreal)-এর চীনা বিভাগের সিইও স্টেফানি রিন্ডার্কনেচ বলেন, সবচেয়ে ভাল মানের ব্র্যান্ড ও পণ্য এবং সবচেয়ে উন্নত খুচরা পদ্ধতি ও টেকসই উন্নয়নের ধারণা চীনা ভোক্তাদেরকে উপহার দিতে চায় তার কোম্পানি। অনেক বহুজাতিক কোম্পানির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেন, চীনা মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং ভোগের ধারণা পরিবর্তনের সাথে সাথে চীনা বাজারের সুপ্তশক্তি আরও বড় হবে। এখন অনেক কোম্পানি চীনে গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে। তারা চীনা ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করতে চায়। এতে প্রমাণিত হয়, চীনা বাজারের প্রতি তাদের আস্থা ও আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি।
চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা সাধারণ একটি মেলা নয়। এর বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি ও নতুন পণ্য এতে প্রদর্শন করা হয়। এবার মেলায় সবচেয়ে বড় ও ভারি একটি প্রদর্শিত পন্য হল জার্মানির একটি মেশিন টুলস। মেলা শেষ হবার পর এ মেশিন টুলস চীনে থেকে যায়। কারণ, একটি চীনা কোম্পানি একে কিনে নিয়েছে। দু'পক্ষের মধ্যে প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। জার্মান কোম্পানির দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানিয়েছেন, এখন বিশ্বের উন্নত মেশিন টুলসের নির্ভুলতা ৮ মাইক্রন এবং তাদের এ মেশিন টুলসের নির্ভুলতা ৪ মাইক্রন পর্যায়ের। চীনা কোম্পানি এ মেশিন টুলস ক্রয় করেছে। এর অর্থ চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং নতুন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছো।
এবার মেলায় ৫৭৮৩ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে, যার মধ্যে বুদ্ধিমান ও উচ্চপ্রযুক্তির পণ্যের বাণিজ্য হয়েছে ১৬৪৬ কোটি ডলারের। গাড়িবিষয়ক পণ্যের বাণিজ্য হয়েছে ১১৯৯ কোটি ডলার এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের বাণিজ্য হয়েছে ৫৭৬ কোটি ডলারের। উন্নত প্রযুক্তি, উন্নত সরঞ্জাম ইত্যাদির প্রতি চীনা কোম্পানিগুলো বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। অনেক চীনা কোম্পানিও এবার মেলার মাধ্যমে বিদেশের উন্নত প্রযুক্তি ও ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা করে নতুন প্রযুক্তি দেশে আনতে ইচ্ছা প্রকাশ করে।
ফু সিং চিকিত্সা ও ওষুধ কোম্পানি বিগত কয়েক বছরে বিদেশ থেকে উন্নত সার্জারি রোবট ও ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপি আমদানি করে আসছে। কোম্পানির চেয়ারম্যান বলেন, চিকিত্সা ও ওষুধ খাতে নবায়ন ও গবেষণার জন্য বেশ সময় লাগে। নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগাতে বা ওষুধ গবেষণায় ১০ বছরের বেশি লাগবে। এই বাস্তবতায় তাদের সামনে একটি বিকল্প হচ্ছে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি করার পাশাপাশি নিজেরাও গবেষণা করা।
প্রথম চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা মাত্র শেষ হয়েছে। এখন দ্বিতীয় মেলার জন্য অপেক্ষার পালা। কোনো সন্দেহ নেই, এবার মেলার সফল আয়োজন শাংহাই তথা গোটা চীনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রভাব ফেলবে।
(শিশির/আলিম)