ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট
  2018-11-14 11:07:20  cri

ব্রিটেনের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে লু কাও ছিং নিজের দক্ষতার স্মাক্ষর রেখেছেন। পাশ্চাত্যের উচ্চশিক্ষা খাতের উন্নয়নে তিনি রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়ার সময় তাঁর বিষয় ছিল ন্যানোপ্রযুক্তি। ব্রিটেনের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হবার পর তিনি তাঁর মূল কাজের পাশাপাশি, চীন ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা, প্রযুক্তি ও শিল্পে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিনিময়ের কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি বলেন, 'আমি চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতির সুবিধাভোগী এবং আমি চীন ও পাশ্চাত্য জগতের বিনিময়ের সেতু ও দূত হতে চাই।'

১৯৬৩ সালে লু কাও ছিং শানতুং প্রদেশের তুংইং শহরের একটি কৃষক-পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাই-বোন বেশ কয়েকজন। তাই খুব ছোটবেলা থেকেই তাকে নানান কাজ করতে হয়। তিনি মনে করেন, ছোটবেলার কষ্টকর ও কঠিন জীবন তার সম্পদ। কারণ, এতে উনি কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী হতে শিখেছেন। ১৯৭৯ সালে তিনি উত্তরপূর্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ওখান থেকে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। গত শতাব্দির আশির দশকে চীন শুরু হয় উন্মুক্তকরণনীতি বাস্তবায়নের কাজ। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পায়। লু কাও ছিং অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়ে পড়তে যান। সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের নীতি চালুর পর চীনের যে-কজন প্রথম বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। তিনি সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, বিমানটি যখন ব্রিসবেন বিমানবন্দরে অবতরণ করে, তখন তাঁর পকেটে মাত্র ২০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে খরচ হয় ১৭ ডলার। বাকি থাকে ৩ ডলার। এটাই ছিল তাঁর হাতের পাঁচ। প্রথম সপ্তাহে তাঁর বৃত্তির কোনো অর্থ পাননি। তাই তিন ডলার এবং সহপাঠির সাহায্যে তিনি এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেন। তবে লু কাও ছিংয়ের জন্য এক সপ্তাহ কষ্টকর সময় ছিল না। কীভাবে টাকা ব্যয় করতে হয়, সে-সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ওই সময় গোটা ব্রিসবেনে মাত্র ২০ জন চীনা ছাত্রছাত্রী ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই আবার দূতাবাসের শিক্ষার্থীকেন্দ্রে বাস করেন এবং সময় পেলে কাজ করে টাকা উপার্জন করেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কম। তবে লু কাও ছিং তাদের চেয়ে ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। তিনি নিজে বাড়ি ভাড়া করেন এবং স্কুলের নানান পার্টি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শুরু করেন। তিনি বলেন, 'আমি সব সুযোগ গ্রহণ করতাম এবং স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতাম। এতে, আমার ইংরেজি উন্নত হতে থাকে এবং অন্যদিকে আমি স্থানীয় সমাজের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে শুরু করি। পার্টিতে অংশ নিতে চাইলে কিছু খরচ হয়। অন্য শিক্ষার্থীরা এই খরচটুকু করতে চাইত না। আমি মনে করি এমন খরচের দরকার আছে। কারণ, প্রতিটি পার্টি থেকে আমি কিছু-না-কিছু শিখতে পারি। কোন শব্দটি আমি কোন পার্টিতে শিখেছি, এখনও আমার মনে আছে; কখনও ভুলে যাব না।'

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে লু কাং ছিং ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন এবং অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে অন্য একটি দেশে যানা। তিনি সিঙ্গাপুর নান ইয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন তার বন্ধু তাকে বলেন, সিঙ্গাপুর ছোট একটি দেশ। সেখানে তাঁর উন্নয়নের সম্ভাবনা কম। তবে লু কাং ছিং মনে করেন, এ কাজ তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তিনি শিক্ষার্থীদের শেখানোর পাশাপাশি সেখানে একটি গবেষণাদলের নেতা হিসেবে কাজা করার সুযোগ পান। তিন বছর পর তিনি কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন এবং সেখানে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন। তিনি Nanomaterials নিয়ে গবেষণা করেন এবং আন্তর্জাতিক বিখ্যাত একাডেমিক জার্নালে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন এবং অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে প্রযুক্তি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল একাডেমির শিক্ষক হন।

২০১৫ সালে ব্রিটিশ সারে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শতাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে লু কাং ছিংকে বাছাই করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সারে বিশ্ববিদ্যালয় বড় ছিল না বা রেঙ্কিংয়েও উপরে ছিল না। তবে লু কাং ছিং কোনো দ্বিধা না-করে এ চাকরি গ্রহণ করেন। তার কাছে প্রেসিডেন্ট পদটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা আকর্ষণীয় ছিল, তা নয়। তিনি বলেন, 'ছোট উপগ্রহ প্রযুক্তি এবং শিল্প সহযোগিতা বিষয়ে সারে বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটেনের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এগিয়ে ছিল এবং ব্রিটেনের শিল্পকাঠামো অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে সম্পুর্ণ। বিশ্ববিদ্যলয় শিল্পখাতে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আমার মতে এটা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের মাপকাঠি। আমি আশা করেছিলাম, আমার প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় সমাজে অবদান রাখবে।'

তিনি আরও বলেন, 'এখানে আমি আরও বেশি কাজ করতে পারি এবং এখানে চ্যালেঞ্জও বেশি।' তিনি হেসে বলেন, 'দুটি জিনিসের মধ্যে যেটা বেশি চ্যালেঞ্জিং, সেটা বেছে নেওয়া আমার স্বভাব।'

সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর তিনি Universities UK –এর সদস্য হন। বলা বাহুল্য, তিনিই ছিলেন একমাত্র চীনা সদস্য। চলতি বছর তিনি ব্রিটিশ সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিটি (সিএসটি)-তে যোগ দেন। তাঁর একটি স্বপ্ন আছে। স্বপ্নটি হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে সারে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি করা।

লু কাও ছিংয়ের টেবিলে রাখা আছে কনফুসিয়াসের একটি মূর্তি। আর আলমারিতে আছে চীনের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন স্মারকবস্তু। পূর্ব ও পশ্চিম—দুটি শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই লু কাও ছিং শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় তিনি সবসময় চীনের ঐতিহ্যিক 'মধ্যপন্থা' অনুসরণ করেন। সমস্যা সমাধানের সময়ে তিনি দেখেন যাতে কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ না-হয়।

লু কাও ছিং অস্ট্রেলীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি নিজের দেশকে কখনও ভুলে যাননি। তার উদ্যোগে সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইভ-জি কেন্দ্র ও চীনের হুয়া ওয়ে কোম্পানি সহযোগিতা করছে। তাঁর উদ্যোগে ব্রিটিশ-চীনা অধ্যাপকতদের কমিটি গঠিত হয়েছে। এ কমিটির সদস্যরা ব্রিটিশ-চীনা পন্ডিত। তিনি কমিটির সদস্যদের নিজেদের পেশাদার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটিয়ে দু'দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে উত্সাহ দিয়ে থাকেন।

লু কাও ছিং বলেন, তিনি একজন সৌভাগ্যবান মানুষ এবং চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণনীতির সুবিধাভোগী। তিনি বলেন, 'এ নীতি না-থাকলে আমি বিদেশে যাবার সুযোগ পেতাম না এবং চীনের অর্থনীতি ও সমাজ এত উন্নত হতো না। আমরা বিদেশে এমন সফলতাও অর্জন করতে পারতাম না। এই নীতির ফলে চীন শক্তিশালী হয় এবং আমরাও বিদেশে বেশ সম্মান অর্জন করি।'

তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে যখন তিনি বিদেশে লেখাপড়া করেন তখন পাশ্চাত্য দেশে চীনা শিক্ষার্থী ছিল কম এবং তাদের সম্পর্কে বিদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল নেতিবাচক। এখন চীনের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিনিময় দিন দিন বাড়ছে এবং চীন বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলছে। এখন বিদেশে চীনাদের অবস্থানেরও উন্নয়না ঘটেছে।

লু কাও ছিং বিদেশে বাস করেন। তবে তার আত্নীয়স্বজন এখনও শানতুংয়ে আছেন। তিনি যখন দেশে আসেন, তখন তাঁদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি বলেন, তার শিকড় ও হৃদয় সবসময় চীনের মাটিতে থাকে।

(শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040