সি চিন পিংয়ের গল্প
  2018-10-31 09:04:07  cri
সি চিন পিংয়ের গল্প: লিয়াং চিয়া হ্য গ্রাম চীনের উন্নয়নের প্রতীক

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একবার বলেছিলেন, 'আমার জীবনে যা আমি প্রথম শিখেছি, তা শিখেছি লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামে।' চীনের হুয়াং থু মালভূমিতে অবস্থিত এ ছোট গ্রামে সি চিন পিং ৭ বছর কাটিয়েছেন। এ গ্রাম সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালুর পর বিগত ৪০ বছরে চীনে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে, তার সাক্ষীও বটে।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন সি চিন পিং প্রথমবার চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, তখন তিনি মার্কিন জনগণকে লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামে তার অভিজ্ঞতার গল্প বলেন।

সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালুর ৪০ বছর পর, চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। তবে এর আগে চীন কেমন ছিল? ৪০ বছর ধরে চীনে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে? ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক অভ্যর্থনা-ভোজে সি চিন পিং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, 'গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আমি কিশোর ছিলাম। তখন বেইজিং থেকে শ্যানসি প্রদেশের ইয়ান আন শহরের লিয়াং চিয়া হ্য নামক একটি গ্রামে গেলাম এবং ওখানে একজন কৃষক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। আমি ওই গ্রামে ৭ বছর ছিলাম। তখনকার বাড়িঘর ও বিছানা ছিল কাদামাটির তৈরি। তখন সবাই দরিদ্র ছিল। কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো একবার মাংস খাওয়ার সৌভাগ্য হতো। আমি তখন ঠিকই বুঝেছি যে, আমাদের কৃষকদের জন্য কী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরে আমি এ গ্রামের সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক হই এবং সবাইকে নিয়ে উত্পাদন-খাতের উন্নয়ন ঘটাই। তখন আমার স্বপ্ন ছিল, একদিন আমাদের কৃষকরা ইচ্ছামতো মাংস খেতে পারবেন। চলতি ব্ছরের বসন্ত উত্সবের সময়ে আমি সেই গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম। আমি দেখেছি, গ্রামে এখন বিটুমিনের রাস্তা হয়েছে, কৃষকরা ইট দিয়ে তৈরি বাড়িঘরে বাস করছেন, ইন্টারনেটের সঙ্গেও তারা যুক্ত। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মৌলিক অবসর বীমার আওতায় এসেছেন, গ্রামের সব মানুষের চিকিত্সা-বীমা আছে। শিশুরা ভাল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। আর ইচ্ছেমতো মাংস খাওয়া এখন আর কোনো সমস্যা নয়। আমি আরও গভীরভাবে জানি যে, চীনা স্বপ্ন আসলে জনগণের স্বপ্ন এবং কেবল সুন্দর ও সুখী জীবনের প্রতি চীনা মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্ত হলে তা বাস্তবায়িত হবে। লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামের পরিবর্তন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালুর পর চীনা সমাজের উন্নয়নের প্রতীক।'

সি চিন পিং আরও বলেন, 'আমরা ভালো করেই জানি যে, চীন এখনও বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ। চীনা মানুষের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে চাইলে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। উন্নয়ন এখনও চীনের মূল লক্ষ্য। চীনা নেতৃবৃন্দের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের জীবনমান উন্নত করা, সবাইকে সচ্ছল করা।'

সি চিন পিংয়ের গল্প: হাইনানের ওপর সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের ইতিবাচক প্রভাব

চীনে এমন একটি প্রদেশ আছে, যেটি সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালুর পর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ নীতির কারণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। গত শতাব্দীর আশির দশকে অসংখ্য চীনা যুবক নিজ নিজ স্বপ্ন পূরণ করতে এ প্রদেশে আসে। প্রদেশটির নাম হাইনান। সম্প্রতি সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালুর ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে চীনের সর্বোচ্চ নেতা প্রদেশটিকে আরও উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেন।

১৯৮৮ সালের ১৩ এপ্রিল। চীনের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত হাইনান প্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি হাইনানাকে 'বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হাইনান চীনের বৃহত্তম বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। তবে শেন চেন এবং চু হাইর মতো অন্য উন্নত বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার সঙ্গে হাইনানের ব্যাপক পার্থক্য ছিল। হাইনানের অধিকাংশ এলাকা ছিল গ্রাম; অর্থনীতির ভিত্তি ছিল দুর্বল ও পশ্চাত্পদ। তবে, গত ৩০ বছরের প্রচেষ্টায় হাইনান নিজের পরিবেশ ও অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে হেঁটেছে এবং সীমান্তের একটি সাধারণ দ্বীপ থেকে 'আন্তর্জাতিক পর্যটনদ্বীপে' পরিণত হয়েছে।

চলতি বছরের ১০ এপ্রিল, বোআও এশিয়া ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দেশ-বিদেশের অতিথিদের সামনে হাইনানের পরিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন,

'সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের কারণে জন্ম হয় হাইনান প্রদেশের এবং এ নীতির কারণে এটি উন্নতও হয়। হাইনান একটি অনগ্রসর ও রুদ্ধদ্বার সীমান্ত-দ্বীপ থেকে চীনের সবচেয়ে উন্মুক্ত ও প্রাণবন্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। অর্থনীতি ও সমাজ-উন্নয়নেও বেশ সাফল্য অর্জন করে দ্বীপটি। হাইনান প্রদেশের উন্নয়ন চীনে বিগত ৪০ বছরের উন্নয়নের প্রতীক।'

চলতি বছর হাইনান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ৩০তম বছর এবং সংস্কার ও উন্মুক্তকারণ নীতি চালুর ৪০তম বার্ষিকী। বোআও ভাষণে সি চিন পিং জোর দিয়ে বলেন, চীন সংস্কার ও উন্মুক্তরণ নীতিতে অবিচল থাকবে এবং নিজেকে আরও উন্মুক্ত করতে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গত ৪০ বছরের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার দিকে ফিরে তাকিয়ে সি চিন পিং বলেন, 'ইতিহাস কখনও কখনও মানুষকে শক্তি যোগায়। ১৯৭৮ সালে তেং সিয়াও পিংয়ের উদ্যোগে চীনে শুরু হয় সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের প্রক্রিয়া। গ্রাম থেকে শহরে এবং পরীক্ষামূলক অঞ্চল থেকে সার্বিকভাবে গোটা দেশে বাস্তবায়ন করা হয় এ নীতি। ৪০ বছর ধরে চীনা মানুষ নিজেদের হাতে রচনা করে দেশ ও জাতির উন্নয়নের মহাকাব্য।'

সি চিন পিং আরও বলেন, 'চীনের সংস্কার ও উন্মুকরণের নীতি উন্নয়ন, নবায়ন ও সুন্দর জীবনের প্রতি চীনা মানুষের প্রত্যাশা এবং বিশ্বের নানা দেশের জনগণের উন্নয়ন, সহযোগিতা ও শান্তির প্রতি চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। চীনের ৪০ বছরের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে: একটি দেশ বা একটি জাতির পুনরুত্থান ঘটাতে চাইলে, সংশ্লিষ্ট প্রচেষ্টা হতে হবে যুগ ও ইতিহাসের প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

সি চিন পিংয়ের গল্প: চীনারা সাঁতার কাটতে কাটতে সাঁতার শিখেছে

চীনের গত ৪০ বছরের সংস্কার ও উন্মুক্তরণ প্রক্রিয়ার দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যায় যে, বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে চীন বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৭৮ সালে যখন বিশ্বের জন্য চীন নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়, তখন অনেক কষ্ট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে চীনা জাতিকে। সিপিসি'র নেতৃত্বে চীনা মানুষ বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অবশেষে লক্ষ্যণীয় সাফল্য অর্জন করে। সি চিন পিং মনে করেন, এ সাফল্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হল, চীনারা 'সাঁতার কাটতে কাটতে সাঁতার শিখেছে'

২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। সেটাই ছিল এ বেসরকারি অর্থনৈতিক ফোরামে তাঁর প্রথম অংশগ্রহণ। তখন বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের কাজ চলছিন; আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে ছিল মন্দাবস্থা। তা ছাড়া, বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদও দিন দিন গুরুতর আকার ধারণ করছিল। এমনি এক প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট সি চীনের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করে বলেন,

'অর্থনীতির বিশ্বায়ন নিয়ে চীনের ছিল সন্দেহ ও দুচিন্তা। তবে আমরা মনে করি, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে চীনের মিশ্রণ একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। আমরা বুঝতে পারি যে, চীনের অর্থনীতির উন্নয়ন চাইলে বিশ্ববাজার নামক সাগরে সাঁতার কেটেই তা করতে হবে। সাঁতার না-জানলে একদিন চীনের অর্থনীতিকে এই সাগরেই ডুবতে হবে। তাই চীন সাহস নিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে। এ প্রক্রিয়ায় আমরা বার বার ঝড় ও ঘূর্ণি মোকাবিলা করেছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। আমরা সাঁতার কাটতে কাটতে সাঁতার শিখেছি। আমরা তখন একটি সঠিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।'

সি চিন পিংয়ের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি সাগরের মতো। আপনি এতে প্রবেশ করতে পারেন বা না-ও করতে পারেন; তবে একে অস্বীকার করতে পারবেন না, এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারবেন না। বিশ্ব অর্থনীতির সাগর থেকে যারা আলাদাভাবে ছোট ছোট নদী বা হ্রদ সৃষ্টি করতে চায়, তারা সফল হবে না।

সি চিন পিং জোর দিয়ে বলেন, অর্থনীতির বিশ্বায়নের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ—দুটোই আছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা উচিত। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040