ইয়ান চিন ছাং
দুপুরে, আন হুই প্রদেশের ফেং ইয়াং জেলার সিয়াও কাং গ্রামে, স্থানীয় মানুষ ফেং ইয়াং ড্রাম নামে একটি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আনন্দ করছেন। পর্যটকরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করছেন। চিন চাং সি ফু নামের একটি রেস্টুরেন্টের সামনে ইয়ান চিন ছাং মুখে হাসি নিয়ে অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করছেন।
১৯৭৮ সালে গোটা চীনে ক্ষুধা ছিল প্রকট। এমনি এক প্রেক্ষাপটে সিয়াও কাং গ্রামের কৃষক ইয়ান হুং ছাংসহ ১৮ জন কৃষক যৌথভাবে নির্ধারিত দলিলে আঙুলের ছাপ দিয়ে কৃষিজমির ওপর নিজেদের অধিকার লাভ করেন এবং তখন থেকে শুরু হয় চীনা গ্রামগুলোর সংস্কার কার্যক্রম।
৪০ বছর আগের কথা স্মরণ করে ইয়ান চিন ছাং বলেন, "তখন ঠিকমতো খাওয়া জুটতো না; পরার জন্য কাপড় ছিল না। বৃষ্টি হলে মাটির ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হতো। একদিন কাজ করলে মাত্র কয়েক 'চিয়াও' (১০ চিয়াও=১ ইউয়ান) পাওয়া যেত। কোনো উপায় না-দেখে গ্রামের সবাই শহরে গিয়ে ভিক্ষা করতো। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেই আমরা ১৮ জন পেটের তাগিদে জমির মালিকানা-দলিলে আঙুলের ছাপ দেই।"
১৮ জন কৃষকের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু হয় চীনের গ্রামগুলোকে 'হাউজহোল্ড কর্ট্রাক্ট রেসপনসিবিলিটি সিস্টেম' বা পারিবারিক দায়িত্ব-ব্যবস্থা। গেল ৪০ বছরের পরিবর্তন নিজের চোখের সামনেই দেখেছেন ইয়ান চিন ছাং। তিনি সাংবাদিককে জানান, ২০১৭ সালে সিয়াং কাং গ্রামের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ১৮ হাজার ইউয়ান। সবাই এখন পেটপুরে খেতে পারে, ভালো কাপড় পরতে পারে, এবং ভালো বাড়িঘরে ঘুমাতে পারে। গ্রামের কালেকটিভ বার্ষিক আয় ৮২ লাখ ইউয়ান এবং প্রত্যক কৃষক এর থেকে অংশ পেয়ে থাকে।
পারিবারিক দায়িত্ব-ব্যবস্থা চীনের গ্রামাঞ্চলে চালু একটি মৌলিক অর্থনৈতিক নীতি। তবে ইয়ান চিন ছাং এখন আর জমি চাষ করেন না। তিনি নিজের সব জমি ভাড়া দিয়েছেন। তার ছেলে ও তার ৭ মু (প্রায় ০.৫ হেক্টর) জমি আছে এবং প্রতি মু'র ভাড়া ৮০০ ইউয়ান। তাই প্রতিবছর তিনি ৫৬০০ ইউয়ান করে পেয়ে থাকে। তিনি একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছেন এবং প্রতিবছর সেখান থেকে তার আয় হয় এ লাখ ইউয়ানের বেশি। পাশাপাশি, গ্রাম থেকে লভ্যাংশ পান ৩৫০ ইউয়ান করে।
ইয়ান চিন ছাং বলেন, জমি ভাড়া দেয়ার পর অনেক কৃষক নিজের ব্যবসা শুরু করেন বা গ্রামের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। তার ৫ জন ছেলে আছে এবং তাদের মধ্যে ৪ জন গ্রামে রেস্টুরেন্ট চালু করেন। তার দু'ছেলের রেস্টুরেন্ট পাশাপাশি অবস্থিত। একজনের রেস্টুরেন্টে খালি আসন না-থাকলে অন্য একজনের রেস্টুরেন্টে যেতে পারেন পর্যটকরা।
ইয়ান চিন ছাংয়ের ছোট ছেলে ইয়ান ত্য ছুয়ান ও তার স্ত্রী
ইয়ান চিন ছাংয়ের ছোট ছেলে ইয়ান ত্য ছুয়ান ১৯৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চীনা গ্রামের সংস্কার-কার্যক্রম। তার এখনও মনে আছে, বাবা ও ৪ ভাই জমি চাষ করে কী ভীষণ পরিশ্রম করতেন। এতে তাদের পরিবারের চলে যেত। কিন্তু স্বচ্ছলতা কখনও আসেনি। বড় হবার পর তিনিও চীনের উন্নত এলাকায় গিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। তবে অবশেষে তিনিও গ্রামে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, কারখানায় কাজ করার সঙ্গে তিনি খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। কিছু রান্নার কৌশল শেখার পর তিনি ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে কাজ করা শুরু করে এবং পরে নিজের রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এখন গ্রামে তার মতো অনেক মানুষ রেস্টুরেন্ট চালু করেছেন বা কাছাকাছি কোম্পানিতে কাজ করেন। ইউয়ান ত্য ছুয়ান বলেন, "আমার শিশু-সন্তান গ্রামে লেখাপড়া করছে। তাই আমরাও দূরে যেতে চাই না। আমরা ভাল শিক্ষা অর্জন করতে পারি নাই। আশা করি, আমাদের সন্তান ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যলয়ে লেখাপড়া করতে পারবে।" ইয়ান ত্য ছুয়ানের স্ত্রী অন্য একটি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বিয়ে হবার পর তিনি আসেন সিয়াও কাং গ্রাম। তিনি বলেন, কাছাকাছি কয়েক গ্রামের মধ্যে সিয়াও কাং গ্রাম সবচেয়ে ধনী। এখানে পরিবহন ও পরিবেশও তুলনামূলক ভাল। গ্রামে স্কুলও আছে, যা খুব ভাল।
সিয়াও কাং গ্রাম এখন চীনের ৪ স্টার একটি দর্শনীয় স্থান এবং ৫ স্টার অর্জনে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইয়ান চিন ছাংয়ের নাতি ইয়ান লিয়ান সুয়ান আন হু প্রদেশের রাজধানী হ্য ফেই শহরে লেখাপড়া করেছে এবং ওখানে কাজ করেছে। ৩ বছর আগে বাবা-মার অনুরোধে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, তার মতো যুবকরা এখন গ্রামের বাইরে যায় এবং যারা গ্রামে কাজ করেন তাদের প্রায় সবাই বয়স্ক। তিনি গ্রামে প্রাণশক্তি যোগ দিতে চান এবং গ্রামের উন্নয়নে নিজের অবদান রেখতে চান। তবে গ্রামে ফিরে আসার পর তিনি ভাল লাগার চাকরি পাননি এবং দাদার সঙ্গে নিজের কষ্ট শেয়ার করেন। দাদা তাকে বলেছেন, "তুমি গ্রামের যে কোন একটি জায়গায় কাজ কর। তা গ্রামের উন্নয়নে অবদান রাখবে।" দাদার কথা শুনে উত্সাহিত হন। তিনি বলেন, "দাদা পরিবারের প্রধান। সবাই দাদার সঙ্গে নিজের সমস্যা আলোচনা করতে পছন্দ করি। কারণ দাদা সবসময় আমাদেরকে ভালো পরামর্শ দেন।"
২০১৭ সালে, সিয়াও কাং গ্রামের ১০০০ হেক্টর জমির মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি বড় শস্য উত্পাদক বা কোম্পানিকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে এবং গ্রামের ৪২০৯ জন কৃষক কোম্পানির কাছ থেকে জমির ভাড়া পেয়ে থাকেন।
ইয়ান চিন ছাংয়ের নাতি ইয়ান লিয়ান সুয়ান
ইয়ান লিয়ান সুয়ান এখন পর্যটক-সেবাকেন্দ্রে কাজ করেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে এক মিলিয়নের বেশি পর্যটক সিয়াও কাং গ্রাম ভ্রমণ করেছেন এবং এ সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বেশি হবে। তার কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যারা সিয়াও কাং গ্রামে আসেন তাদের সঙ্গে প্রথমে দেখা হয় সেবাকেন্দ্রের কর্মীদের। গ্রামের যুবক-যুবতীদে একটি উইচ্যাট গ্রুপ আছে, তারা সবময় সেখানে কথা বলে। সিয়াও কাং গ্রামের ভবিষ্যত সম্পর্ক তাদের নিজের কল্পনা আছে। ইয়ান লিয়ান সুয়ান তাদের কল্পনা বর্ননা করে বলেন, ভবিষ্যতে সিয়াও কাং গ্রাম সবুজ গ্রাম হবে। এখানে বড় চাষের জমি আছে। সবার বাড়িঘর পাশাপাশি অবস্থিত। গ্রাম একটি দর্শনীয় স্থান এবং সবাই এখানে সুখি জীবন যাপন করেন। বাইরে না-গেলেও কেনাকাটা করতে পারেন, কাজ করতে পারেন, টাকা উপার্জন করতে পারেন। সবমিলিয়ে গ্রামবাসীরা সুখে আছেন। (শিশির/আলিম)