1020jingji
|
১. নিজস্ব অর্থনীতির বলিষ্ঠতা ও বিশাল বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে চীনকে হারতে দেবে না। সম্প্রতি এমন মন্তব্য করেছেন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিবিএস'র '৬০ মিনিট' অনুষ্ঠানে এক একান্ত সাক্ষাত্কারে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধে টিকে থাকতে চীনের হাতে পর্যাপ্ত 'হাতিয়ার' নেই। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ নয়, বরং ছোটখাট সংঘর্ষ ঘটেছে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ঠিক আগের দিনই তিনি একে 'যুদ্ধ' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে, ট্রাম্প এ-কথা অস্বীকার করেন এবং 'ছোটখাট সংঘর্ষের উত্তেজনাও' কমিয়ে আনার কথা বিবেচনা করছেন বলে জানান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাণিজ্যযুদ্ধ কোনো 'সংখ্যার খেলা' নয়। এর সঙ্গে হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তাদের স্বার্থ জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র দেশি-বিদেশি বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে 'সবার আগে আমেরিকা' শ্লোগান দিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু চীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে-দেওয়া বাণিজ্য-যুদ্ধে অযৌক্তিক কোনো 'হাতিয়ার' ব্যবহার করতে চায় না। চীন দেশটির জনগণের স্বার্থ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য বিবেচনা করে, সংযমের পরিচয় দিচ্ছে ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
চীনের এই সংযমের অর্থ এই নয় যে, বাণিজ্যযুদ্ধে লড়াই করার মতো পর্যাপ্ত 'হাতিয়ার' দেশটির হাতে নেই। চীনের অর্থনীতি বলিষ্ঠ এবং এর বাজার বিশাল। বাণিজ্যযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য এই দুই 'হাতিয়ার'ই যথেষ্ট।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি টানা ১২ প্রান্তিক ধরে ৬.৭ থেকে ৬.৯ শতাংশের মধ্যে বজায় রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রফতানি ও বিনিয়োগের চাইতে কেনাকাটা ও পরিষেবার ওপর বেশি নির্ভর করে। এ ছাড়া, চীনের আছে নিজস্ব শিল্প-ব্যবস্থা, শিল্প-চেইন, বিশ্বের বৃহত্তম মধ্যবিত্তশ্রেণি, বিশ্বের বৃহত্তম ভোগ্যবাজার। সবমিলিয়ে চাপিয়ে দেওয়া বানিজ্যযুদ্ধে টিকে থাকার 'হাতিয়ারের' অভাব নেই চীনের।
২. যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ রবার্ট কান বলেছেন, কাল্পনিক 'চিপ কেলেঙ্কারি' প্রচার চীন-বিরোধিতারই নিকৃষ্ট উদাহরণ। রফতানিপণ্যে কম্পিউটার চিপ বসিয়ে হয়তো গোপন তথ্য পাওয়া যাবে, কিন্তু এই কাজের ঝুঁকি মারাত্মক। ধরা পড়লে গোটা শিল্পের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এতবড় ঝুঁকি নেওয়ার বোকামি কোনো দেশই করবে না। তিনি সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ বিজনিসউইকে প্রকাশিত এক প্রবন্ধের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এমন মন্তব্য করেন।
প্রবন্ধে দাবি করা হয় যে, গোপন তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে চীন একধরনের কম্পিউটার চিপ, ৩০টি মার্কিন কোম্পানির পণ্যের মধ্যে ইনস্টল করে দেয়। এই পণ্যগুলো চীনে তৈরি হয়েছে এবং চীন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা হয়েছে। কিন্তু প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার পরপরই অ্যাপল, অ্যামাজন ও এএমডি ইত্যাদি কোম্পানিগুলো ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করে। তাদের পণ্যে কোনো বিদেশি চিপ পাওয়া যায়নি বলে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় কর্তৃপক্ষও এক বিবৃতিতে জানায়, এসব কোম্পানির ঘোষণায় সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। প্রবন্ধে এই বিখ্যাত কোম্পানিগুলোর পণ্যেও চিপ বসানো আছে বলে দাবি করা হয়েছিল।
রবার্ট কান আরও বলেন, এমন ধরনের প্রচারণায় অনেক অসত্য তথ্য থাকে। আর মানুষ যা বিশ্বাস করতে চায়, সেটাই তারা বিশ্বাস করে। কাল্পনিক এই 'চিপ কেলেঙ্কারি' কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। কিন্তু চীন-বিরোধী গোষ্ঠী একেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
এদিকে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন গবেষক ডা: উইলিয়াম ওভারহোল্ট বলেন, চিপ আছে কি না তা আইটি বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে। ব্লুমবার্গ একটি নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম। তারা তথ্য প্রচারের আগে যাচাই-বাছাই করে থাকে। আবার অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলোদের ঘোষণাও উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। যে-কোনো ধরনের ঘোষণা তাদের শেয়ারমূল্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এখন, কিছুসময় অতিক্রান্ত হলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।
৩. চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ সম্প্রতি চীনের হাইনান প্রদেশের অবাধ বাণিজ্যের পরীক্ষামূলক অঞ্চল নির্মাণসংক্রান্ত সামগ্রিক পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছে। ফলে দ্বীপ-প্রদেশ হাইনানে টেলিকম, ইন্টারনেট ও অর্থসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্মুক্তকরণের মাত্রা বাড়বে।
হাইনান অবাধ বাণিজ্যের পরীক্ষামূলক অঞ্চল পর্যটনশিল্প ও আধুনিক সেবাশিল্পের উন্নয়ন ঘটাবে। তা ছাড়া, এখানে হাই-টেক শিল্পকে কেন্দ্র করে অন্যান্য শিল্পকেও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
প্রধানত আন্তর্জাতিক পুঁজিবাণিজ্য, বন্ড সরবরাহ এবং বন্ড রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন সেবা চালু করা হবে হাইনানের পরীক্ষামূলক অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলে। তা ছাড়া, সান ইয়া শহরে শুল্ক তত্ত্বাবধানের সুবিধায় পশুপাখির জন্য আলাদা অঞ্চল স্থাপন করা হবে। এর উদ্দেশ্য, প্রাণী ও উদ্ভিদসম্পদের রফতানি ও পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া যায়।
৪. চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে চীনের পণ্যবাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২২.২৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯.৯ শতাংশ বেশি। চীনের রাষ্ট্রীয় শুল্ক প্রশাসন সম্প্রতি এ-তথ্য জানায়।
প্রকাশিত তথ্যানুসারে, তিন প্রান্তিকে চীন থেকে রফতানি হয়েছে ১১.৮৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ান মূল্যের পণ্য এবং চীনে আমদানি হয়েছে ১০.৪২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান মূল্যের পণ্য। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৬.৫ শতাংশ ও ১৪.১ শতাংশ। ফলে, বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে চীনের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত থাকে ১.৪৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮.৩ শতাংশ কম।
প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, তৃতীয় প্রান্তিকে চীনের আমদানি-রফতানির পরিমাণ আগের দুই প্রান্তিকের তুলনায় বেশি ছিল।
৫. চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩.০৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ান, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬.৫ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চীনের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৩.৮ শতাংশ। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবেই রয়ে গেছে। চীনের রাষ্ট্রীয় শুল্ক প্রশাসনের মুখপাত্র লি খুই ওয়েন সম্প্রতি বেইজিংয়ে এ-তথ্য জানান।
মুখপাত্র আরও জানান, চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে চীন রফতানি করেছে ২.২৭ ট্রিলিয়ান ইউয়ান মূল্যের পণ্য। অন্যদিকে, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন আমদানি করেছে ৭৯৮ বিলিয়ন ১৩০ মিলিয়ন ইউয়ান মূল্যের পণ্য। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৭.৪ ও ৩.৮ শতাংশ।
এদিকে, প্রথম তিন প্রান্তিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আসিয়ানের সঙ্গে চীনের আমদানি-রফতানির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে যথাক্রমে ৭.৩ ও ১২.৬ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও কাজাখস্তানের সঙ্গে চীনের আমদানি-রফতানি বেড়েছে যথাক্রমে ১৯.৪, ১১.৯ ও ১১.৮ শতাংশ।
৬. বেলারুশে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩.৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আরও জানিয়েছেন, সরকারের অন্যান্য আর্থিক লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়েছে। ২০১৮ সালে বেলারুশ সার্বিকভাবে ৩.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। ২০১৭ সালে দেশটির অর্থনীতিতে ২.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
৭.চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসরাইলের বাণিজ্যঘাটতি বেড়েছে ৪.৮ শতাংশ। দেশটির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো এ-তথ্য জানিয়েছে।
মূলত আমদানি বৃদ্ধির কারণেই এমনটি ঘটেছে। প্রথম ছয় মাসে ইসরাইল আগের বছরের একই সময়কালের চেয়ে ১০.৫ শতাংশ বেশি পণ্য ও সেবা আমদানি করেছে।
অন্যদিকে, বছরের প্রথমার্ধে ইসরাইলের রফতানি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৫.৭ শতাংশ। ২০১৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে দেশটির রফতানি বেড়েছিল ৯.২ শতাংশ।
৯. আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের মাধ্যমে গেল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলো ১৪৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আয় করেছে। এর আগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ ছিল ১১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সেই হিসেবে এক বছরে স্থলবন্দরগুলোর আয় বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বিগত অর্থবছরে স্থলবন্দর থেকে যত আয় হয়েছে, এর ৮৪ শতাংশই এসেছে তিনটি স্থলবন্দর থেকে। স্থলবন্দরগুলো হলো বেনাপোল, বুড়িমারী ও ভোমরা। বরাবরের মতো গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মাশুল আদায় হয়েছে বেনাপোল স্থলবন্দরে। এই স্থলবন্দরের আয় ৪৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। বুড়িমারী ৪৬ কোটি ২৪ লাখ ও ভোমরা ২১ কোটি টাকা আয় করেছে।
অন্যান্য স্থলবন্দরের মধ্যে সোনামসজিদ স্থলবন্দর ৩ কোটি ৮২ লাখ, তামাবিল ৬ কোটি ৪৬ লাখ, হিলি ৬ কোটি ৭ লাখ, টেকনাফ ৪ কোটি ৭৪ লাখ, বাংলাবান্ধা ৪৭ লাখ, আখাউড়া ৫ লাখ, নাঁকুগাও ১১ লাখ ও বিবিরবাজার ১ লাখ টাকা আয় করেছে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়ায় এর সক্ষমতা বেড়েছে। এর পাশাপাশি বিগত অর্থবছরে তামাবিল ও সোনাহাট এই দুটি স্থলবন্দর চালু হয়েছে। এতে কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত হওয়ায় দ্রুত পণ্য খালাস হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও বেড়েছে। মূলত এসব কারণে স্থলবন্দরগুলোর আয় বাড়ছে।
(আলিমুল হক)