1012adda
|
সুপ্রিয় শ্রোতা আমি ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা। সাপ্তাহিক 'কফিহাউসের আড্ডা' অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। এ সপ্তাহে আড্ডার বিষয় হচ্ছে: জীবনকে কিভাবে বদলে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আজকের আড্ডায় আমার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন মো: শামীম রেজা, তিনি বাংলাদেশের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত । বর্তমান তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিকস স্কুলে স্ট্যাটিসটিক্যাল মেশিন লার্নিং এন্ড ইনটেলিজেন্স এ পি এইচ ডি অধ্যয়ন করছেন।
(১) যে সায়েন্স ফিকশনগুলোর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা আমরা জানলাম।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে 'আলফাগো' নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোবট চীনের 'গো দাবা'(ওয়েই ছি, অথবা গেম অব গো)-এর চ্যাম্পিয়ন লি শি শি'কে পরাজিত করে পৃথিবীর মানুষকে চমকে দিয়েছে। তারপর ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে 'মাস্টার' নামক অজানা প্রতিযোগী বিশ্বের বিভিন্ন 'গো দাবা' চ্যাম্পিয়নকে চ্যালেঞ্জ করে জিততে থাকে। পরে দেখা যায় যে, 'মাস্টার' আসলে গুগল কোম্পানির ডিপমাইন্ড অফিসের গবেষণায় তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। ২০১৭ সালের মে মাসে চীনের উচেনে আয়োজিত বিশ্ব 'গো দাবা' প্রতিযোগিতায় আলফাগো বিশ্বের প্রথম স্থানে থাকা চ্যাম্পিয়ন খ্য চিয়ে'কে পরাজয় করে এ খেলায় শিরোপা লাভ করে। এর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শব্দটি আমরা সায়েন্স ফিকশন মুভিতে কেবল দেখেছি। এবার তা সত্যি সত্যি আমাদের জীবনে এসে ধরা দিয়েছে।
আমি নিজেই আসলে সায়েন্স ফিকশন ফ্যান। সেই হাইস্কুল থেকে সায়েন্স ফিকশন পড়তে শুরু করি। চীনে তখন একমাত্র সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন ছিলো 'খ্য হুয়ান শি চিয়ে' অর্থাত্ সাই-ফাই ওয়ার্ল্ড। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সংস্করণ আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। বিদেশে থাকলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমার জন্য তা কিনে রাখার অনুরোধ করেছি। তা ছাড়া দেশে-বিদেশে অনেক সায়েন্স ফিকশন লেখকের উপন্যাস পড়েছিলাম। যেমন জুলভার্ন-এর টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি (১৮৭০), আইজ্যাক অজিমভ-এর 'রোবট সিরিজ ও 'গ্যালাক্টিক এম্পায়ার' সিরিজ, আর্থার চার্লস ক্লার্ক-এর 'রেন্দেভাজ-এর 'উইথ রামা', রবার্ট অ্যানসন হেইনলেন-এর 'দ্য গ্রিন হিলস অব আর্থ' ইত্যাদি। আজ এসব সাই-ফাই ফিকশন যেন একটি নতুন পৃথিবী খুলে দিয়েছে। এ অবস্থায়, যখন গত বছরে টিভিতে একদিন হঠাত্ দেখলাম একটি রোবটের বিজ্ঞাপন, তখন বিচিত্র অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল, সাই-ফাই ফিকশনগুলো আমরা বইতে পড়েছি বা টিভিতে দেখেছি, সেগুলো এবার সত্যিই জীবিত হয়ে উঠছে।
(২) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানে কি?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বলতে বোঝায় যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তাকে এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের সেই শাখাকে যা মানবনির্মিত যন্ত্রের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাঠ্যপুস্তকে এই ক্ষেত্রটিকে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে যে, এ হলো 'বুদ্ধিমান' কিছু নির্মাণ ও তার অধ্যয়নের একটি ক্ষেত্র। এখানে বুদ্ধিমান কিছু বলতে বোঝাচ্ছে এমন এক 'বস্তু' যা তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে অনুধাবন ও মূল্যায়ন করতে সক্ষম এবং তদানুসারে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম যা তার কার্যকারিতার সম্ভাবনাকে উন্নীত করবে।
(৩) আমাদের জীবনে কোন কোন ক্ষেত্রে এখন এআই-এর ব্যাপক ব্যবহার করা হচ্ছে?
এটুকু বলা যেতে পারে যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ই-মেইল, গাড়ি থেকে শুরু করে বিমান- এসব জায়গাতেই আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার। কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, রোবট। এ ছাড়া বিভিন্ন মেশিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার রয়েছে। গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফটসহ বিশ্বের ছোট-বড় অনেক কোম্পানি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে মেতে আছে। এর একমাত্র কারণ হলো, মেশিনকে বুদ্ধি দিয়ে নিজে নিজে কাজ করা শেখানো। এতে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আর এই জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে অনেক কোম্পানি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে চলেছে। শুধু কম্পিউটার টেকনোলজি ক্ষেত্রটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সীমিত নয়। মার্কেটিং, ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, রিসার্চ, আটোমোটিভ, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য, টেলিকমিউনিকেশনসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার রয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে ঘর করছেন না এমন লোকের দেখা মেলা আজ দুর্লভ। খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করা ব্যক্তির জীবনেও অন্ততপক্ষে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল ঢুকে পড়েছেই, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহারিক জিনিসের মতো। আর এই মায়াজালে যাঁরা জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরা আজকাল নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন কোনও এক অদৃশ্য বন্ধু যেন আপনার সেবায় সদাই মজুত রয়েছে। এ যেন সেই আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপের দৈত্যের মতো। ফেসবুকে ফোটো আপলোড করলে সে চিনে নেয় আপনার সঙ্গীকে, হোয়াটসঅ্যাপে আপনার বন্ধুকে মেসেজ লেখার সময় ভুল টাইপ করলে সে ঠিক করে দেয় নিমেষে, এমনকি আপনার রাতে ঘুম কম হলেও আপনাকে সাবধান করে দেয় পরম বন্ধুর মতো। এহেন বন্ধুর সেবায় ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে গেলেও আপনি নিশ্চয় কখনও কখনও ভেবেছেন কে এই বন্ধু! একবিংশ শতকের আলাদিনের দৈত্যের নাম 'এআই' বা 'আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স'।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অনেকাংশে কাজ করে আমাদের মানব বুদ্ধিমত্তা বা হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের মতোই। বিশেষ করে বুদ্ধিমত্তার একটা বড় অংশ, আইডেন্টিফিকেসন এবং ক্লাসিফিকেশন, যাকে আমরা বাংলায় বলি শনাক্তকরণ ও শ্রেণিবিন্যাস, সেটা কাজ করার পদ্ধতি প্রায় একই। একটি শিশু জন্ম গ্রহণের পর তাকে যেমন চারপাশের প্রাণী, উদ্ভিদ বা বস্তু বিশেষ চেনানো হয় উদাহরণ এর মাধ্যমে, এক্ষেত্রেও এআই সফটওয়্যার কে প্রথমে 'ট্রেইন' বা প্রশিক্ষিত করা হয় কয়েকটি উদাহরণ এর মাধ্যমে। তবে হ্যাঁ, উদাহরণের সংখ্যার হয়ত ফারাক আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, কারণ মানব বুদ্ধিমত্তা খুব কম সংখ্যক উদাহরণের উপরেই কাজ করে। আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য 'ট্রেইনিং সেট' বা প্রয়োজনীয় উদাহরণের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়! কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে একটি মানব শিশুর শিক্ষা হয় তার এক সার্বিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এবং সর্বোপরি ভাষা পরিচয়- এসব ব্যবহার করে হয় তার সার্বিক অভিজ্ঞতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এই সার্বিক অভিজ্ঞতাটা স্বাভাবিক নয়, একজন ইঞ্জিনিয়ারকে সেটা ডিজাইন করতে হয় ছোট ছোট অনেক আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্স সফটওয়্যার একত্রিত করে।
এ ছাড়া আরও অনেক দিক আছে, যেখানে খুবই সাফল্যের সঙ্গে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ হচ্ছে। আসলে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে মানুষের ঘর যত বাড়ছে, প্রতিনিয়ত ডিজিটাল ডেটা তৈরি হচ্ছে ততো বেশি। আর এই প্রভূত পরিমাণ ডেটা'র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মানুষের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। যেমন ধরুন আজকাল একদিনে যত হেলথ ব্লগ লেখা হচ্ছে, বা প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ রিসার্চ পেপার বা জার্নাল পাবলিশ হচ্ছে, কোনও মানুষের পক্ষে সেসব পড়ে একটা সম্যক ধারনা নিজের কাজে লাগানো প্রায় অসম্ভব তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া। আর সেখানেই ব্যাবহার হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আরেক বড় হাতিয়ার - "ন্যাচারাল ল্যাঙ্গোয়েজ প্রসেসিং" বা স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ। আজকের আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্ট সফটওয়্যার ইংরাজি ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর ভাষা অনেকাংশে বুঝতে সক্ষম আপনার আমার মতোই। তাই এই দুর্বার গতিতে তথ্য তৈরি হওয়ার যুগে, কোনটা কাজের খবর খুঁজে বার করে তার থেকে প্রয়োজনীয় অংশ উপস্থাপন করার একটা গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে বিভিন্ন আর্টিফিসিয়ালি ইনটেলিজেন্ট সফটওয়্যার।
এআই-এর আরেকটি বড় ব্যবহারিক দিক হল 'অটোমেশান' বা স্বয়ংক্রিয়তা। তথ্য প্রযুক্তির জগতে অটোমেশান নতুন কিছু না। তথ্য প্রযুক্তি জন্মের আদি যুগ থেকে আমরা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দেখছি। টিকিট কাটা বা টাকা তোলার ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মানুষের কাজের ভার লাঘব করেছে অনেকদিন। কিন্তু এই ধরণের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র সবটাই "ইন্সট্রাকশন বেসড" বা নির্দেশ ভিত্তিক। কয়েকটি পূর্বপরিকল্পিত উপায় এর মাধ্যমেই আমরা এইসব স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। আজকের দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এই স্বয়ংক্রিয়তাকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। হোটেলের রিসেপশন, কলসেন্টার বা অন্যান্য অনেক জায়গায় যেখানে আমরা উল্টোদিকের মানুষটির সঙ্গে সাধারণত কথা বলতে অভ্যস্ত, সেখানে ধীরে ধীরে প্রবেশ ঘটছে স্বয়ংক্রিয় রোবটের। আর হ্যাঁ, এসবই হচ্ছে কোনও সার্ভিস কম্প্রোমাইস না করেই। অর্থাৎ আপনি কথা বলবেন রিসেপশনে দাঁড়ানো কোনও এক যন্ত্রমানব বা যন্ত্রমানবীর সঙ্গেই, যেমনটি বলছিলেন আগে। এরই একটু ছোট সংস্করণ আপনার আইফোনের সিরি, বা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গুগল নাও, অথবা আপনার ড্রয়িং রুমে শোভা পাওয়া আমাজন ইকো।
একটা খবরে দেখলাম, চলতি বছরে স্মার্টফোনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। বাজারবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিটিকসের প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া মোট স্মার্টফোনের প্রায় অর্ধেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট চালিত হবে।
স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিটিকসের তথ্য মতে, ডিভাইসেই এআই রাখার প্রবণতা স্মার্টফোন নির্মাতাদের মধ্যে দ্রুত বাড়ছে। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া মোট স্মার্টফোনের ৪৭.৭ শতাংশ স্মার্টফোনেই কোনো না কোন ধরনের এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকবে। ২০১৭ সালে এই হার ছিল ৩৬.৬ শতাংশ, খবর আইএএনএস-এর। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের প্রায় ৯০ শতাংশ স্মার্টফোনে বিল্ট-ইন এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
এ দিকে এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে গুগল। ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি এআই অ্যাসিস্ট্যান্টগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থান ছিল গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের দখলে। এই এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতে ছিল বাজারের ৪৬.৭ শতাংশ শেয়ার। এরপরের অবস্থানে রয়েছে অ্যাপলের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরি, এর দখলে ছিল বাজারের ৪০.১ শতাংশ।
গুগলের এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের বাজার শেয়ার বেড়ে চলতি বছর ৫১.৩ শতাংশ আর ২০২৩ সালে তা ৬০.৬ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
(৪) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সুযোগ নাকি অশনিসংকেত/নতুন সভ্যতার শুরু, নাকি মানব সভ্যতার শেষ?
এআই ব্যবহারের সাথে সাথে হয়ত আশঙ্কাও করছেন এই বন্ধুই একদিন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে?
সাধারণত একটি আশঙ্কা হলো যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেকারত্ব বাড়াবে ব্যাপক হারে। আমি মনে করি এটি একটি সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ মানুষের কিছু দক্ষতার দাম যেমন কমবে, তেমনিই বাড়বে কিছু দক্ষতার কদর। কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা এবং উৎপাদিত দক্ষতা মধ্যে ফাঁক পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একটি ছোট পর্যায়ে অস্থিরতা থাকতে পারে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তা পূরণ হয়ে যাবে বলেই আমার ধারনা। তবে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঁধে গুরুদায়িত্ব থাকবে এই ফাঁক যথাসম্ভব পূরণের।অনেকে অবশ্য চিন্তিত হবেন এই ভেবে যে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা আসলে অনেক উচ্চমানের এবং সে দক্ষতা সকলের থাকবে না। তাদের জানা দরকার যে ক্রমশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি ও তার ব্যবহারের মধ্যে একটা তফাত তৈরি করা হচ্ছে। যত দিন যাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠবে বলেই আমার ধারণা। আর তার জন্য কাঙ্ক্ষিত দক্ষতাও হবে অনেক সহজ লভ্য।
বেকারত্বের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছেন অনেক চিন্তাবিদ— সেটি হলো বুদ্ধিমান মেশিনের উত্থানের ফলে ভবিষ্যতে মানব জাতির অস্তিত্ব বিলোপের আশঙ্কা। বুদ্ধিতে মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পর মেশিনের সঙ্গে মানুষের সংঘাত তৈরি হওয়া বা উভয়ের লক্ষ্যের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়। সে অবস্থায় মেশিনের হাতে মানবজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কাটি খুবই স্বাভাবিক; বিশেষ করে আমাদের টেক্কা দেওয়া মারণাস্ত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। সদ্য প্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসের মতো গুণী ভবিষ্যৎ-বিশ্লেষক এ ব্যাপারে কড়া সতর্কবাণী একাধিকবার দিয়েছেন।
দুনিয়ার অনেক চিন্তাবিদ সম্প্রতি এই একই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন অগ্রণী প্রযুক্তি ব্যবসায়ী এলোন মাস্ক, ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ মার্টিন রিজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিজ্ঞানী অধ্যাপক নিক বোস্ট্রম, এমআইটির মহাবিশ্ব-বিজ্ঞানী ম্যাক্স ট্যাগমার্ক প্রমুখ। তাদের সবার কথা এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার জন্য এখনই বিশ্ব-ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। ইতিহাস বলে প্রযুক্তির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কখনো পুরোপুরি সফল হয়নি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
(স্বর্ণা/তৌহিদ)