আলোচনা শুরুর আগে আমি আপনাদেরকে একটা দুঃখজনক গল্প শোনাবো। ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ১৬ মিনিটে একজন চীনা সুন্দরী ডাক্তার মারা যান। তিনি হচ্ছেন চীনের শা'ন সি প্রদেশের চিন চুং শহরের ইয়ু ছি জেলার গণহাসপাতালের শ্বাসক্রিয়া বিভাগের মহাপরিচালক চাও পিয়ান সিয়াং। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৩ বছর। তিনি প্রতিদিন টানা ১৮ ঘন্টা করে কাজ করছিলেন। একদিন রোগী দেখতে দেখতে তিনি হঠাত অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে দ্রুত অন্য চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলেও, বাঁচানো যায়নি। চিকিত্সকরা জানালেন, দিনের পর দিন একটানা কাজ করার জন্য তিনি শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন।
আসলে এই ডাক্তারের মতো অনেকেই দিন-রাত একটানা কাজ করে থাকেন। বিশেষ করে বছরের শেষ দিকে কাজ ভালভাবে সম্পন্ন করা বা আরও বেশি অগ্রগতি অর্জনের জন্য বেশি সময় নিয়ে কাজ করে থাকেন। কিন্তু, এর পরিমাণ কিন্তু অত্যন্ত খারাপ হয়ে থাকে বা হতে পারে। আসুন জেনে নিই বিশ্রামহীন একটানা কাজের ক্ষতিগুলো কী।
ক্ষতি ১. রক্তনালীতে রক্তের প্রবাহ কমে যাওয়া
লম্বা সময় বসে কাজ করলে আমাদের শরীরের রক্তনালীতে রক্তের প্রভাব কমে যায়। তখন হৃদপিণ্ড ভালভাবে কাজ করতে পারে না। তখন আপনি arteriosclerosis, হার্ট অ্যাটাক ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
ক্ষতি ২. বুকের রক্তনালীগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না
লম্বা সময় বসে কাজ করলে আমাদের বুকের রক্তনালীর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এতে হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কর্মদক্ষতা কমে যায়। মধ্য-বয়সী ও বৃদ্ধবৃদ্ধারা এক্ষেত্রে সহজে যে-কোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
ক্ষতি ৩. মস্তিষ্কের রক্তনালীর সমস্যা
লম্বা সময় বসে কাজ করলে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্তের প্রবাহ কমে যায়। আর মস্তিষ্কে পুষ্টির অভাব হলে মানুষ সহজেই ক্লান্তি বোধ করে। এতে অনিদ্রা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, আলজেইমার্সসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
ক্ষতি ৪. শরীরের পেশীতে ব্যথা হতে পারে
লম্বা সময় বসে কাজ করলে শরীরের পেশীতে ব্যথার অনুভূতি হতে পারে। এতে আপনার মাথা ব্যথা হতে পারে বা আপনি অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন। যদি আপনার কোমর ও মেরুদণ্ডে সমস্যা থাকে, তবে এই সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে।
ক্ষতি ৫. হজমের সমস্যা
লম্বা সময় বসে কাজ করলে পেটে হজমের প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। এতে আপনি সহজেই কোষ্টকাঠিন্য ও অজীর্ণতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
ক্ষতি ৬. প্রজনন-ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
নিয়মিত লম্বা সময় ধরে বসে কাজ করলে পুরুষদের প্রজনন-ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের শুক্রাণুর গুণগত মান কমে যাবে বা যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অন্যদিকে, নারীদের জন্যও এ-অভ্যাস বিপদ ডেকে আনতে পারে। গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে গর্ভপাতের আশঙ্কা আছে এবং এতে গর্ভস্থিত সন্তানের অস্বাভাবিক শারীরিক গড়ন নিয়ে জন্ম নেবার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
ক্ষতি ৭. অস্টিওপরোসিস হতে পারে
লম্বা সময়ে বসে কাজ করলে আপনার হাড়ের কোষের কার্যক্ষমতা কমে যাবে এবং হাড়ে প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেবে। এ অবস্থায় কখনো কখনো হাড় ভেঙে যেতে পারে বা হাড়ে ফ্রাকচার হতে পারে। আর কেতাবি ভাষায় বললে, আপনি অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।
অস্টিওপোরোসিস এক ধরনের হাড়ের অসুখ যাতে হাড় ক্ষয়িষ্ণু এবং শেষাবধি দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। বিশ্বে প্রথম কয়েকটি মারাত্মক রোগের মধ্যে অস্টিওপোরোসিসের অবস্থান তৃতীয়। অস্টিওপোরোসিস সরাসরি মৃত্যুর কারণ নয়; তবে অস্টিওপোরোসিসজনিত জটিলতার কারণে মানুষের মৃত্যু হয়। প্রধানত দুই ধরনের অস্টিওপোরোসিস হয়: প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি অস্টিওপোরোসিস। প্রাইমারি অস্টিওপোরোসিস দুটি কারণে হয়। একটি বয়সের বৃদ্ধির ফলে। একে বলা হয় "সিনাইল অস্টিওপোরোসিস"। আরেকটি হলো মহিলাদের মাসিক রজ:স্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সূচিত পোস্টমেনোপোজাল অস্টিওপোরোসিস। বিভিন্ন রকম ওষুধ গ্রহণজনিত কারণে সেকেন্ডারি অস্টিওপোরোসিস হয়ে থাকে। অ্যাজমা রোগীরা প্রচুর স্টেরয়েড গ্রহণ করার কারণে অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া হাইপোথাইরয়ডিসম, হাইপারথাইরয়ডিসম, ডায়াবেটিস খেলাইটাস হলেও ধীরে ধীরে সেকেন্ডারি অস্টিওপোরোসিস হয়ে থাকে। মহিলাদের ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন হাড়কে মজবুত করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যাওয়ায় হাড়ের ক্ষয় বেড়ে যায় এবং হাড়ের গঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। "বোন মিনারেল ডেনসিটি টেস্ট" এবং "এক্স-রে" ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের আক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ক্ষতি ৮. মানসিক চাপ বাড়ে
লম্বা সময় বসে কাজ করলে মানসিক চাপ বেড়ে যেতে সম্ভব। মেজাজও তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি, আশেপাশের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের প্রতিও আগ্রহ কমে যেতে পারে।
তো সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় ফুরিয়ে এলো। এখন বিদায় নেওয়ার পালা। 'জীবন যেমন' আপনাদের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা কিন্তু কোনো ব্যবস্থাপত্র দিই না। আমরা শুধু বিশেষজ্ঞদের বলা কথাগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরার (ওয়াং হাইমান/আলিম)