চীনে সরবরাহ-কর্মীদের জীবন
  2018-09-12 13:50:24  cri

সরবরাহ-কর্মী বা ডেলিভারি-পারসন। মোবাইলে বা কম্পিউটারের সাহায্যে অনলাইনে কোনো পণ্যের অর্ডার দিলে তা এই সরবরাহ-কর্মীরাই আমাদের ঘরে পৌঁছে দেন। চীনে এদের 'সরবরাহ-ভাই' বলেও ডাকা হয়। কেমন কাটে তাঁদের জীবন?

চীনে পণ্যবিতরণ-ব্যবসা টানা ৪ বছর ধরে বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে প্রতিদিন চীনে গড়ে ১০ কোটির বেশি প্যাকেজ বিতরণ করা হচ্ছে। চীনে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ ডেলিভারি বা সরবরাহকাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সিয়াও ইউ তাদের একজন। তবে অধিকাংশ সরবরাহ-কর্মীর মতো তিনি পুরুষ নন; তিনি একজন নারী। ৩০ বছর বয়সী সিয়াও ইউ দুটি শিশুর মা। সরবরাহ-কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করার আগে তিনি ওয়েট্রেস, ক্যাশিয়ার, বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তবে কোনো কাজই তিনি দীর্ঘকাল করেননি। তবে সরবরাহ-কর্মী হিসেবে তিনি বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছেন এবং তিনি এই পেশায় দীর্ঘকাল থাকতে চান।

শুরুতে তিনিও 'সরবরাহ-কর্মীদের বেতন বেশি' এমন তথ্য শুনে এ-কাজ শুরু করেন। তবে এ-কাজ সহজ নয় বরং খুব কষ্টকর। সকাল ৬টায় সিয়াও ইউ জেগে ওঠেন এবং সব প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করেন। তাকে ৮টার আগেই কর্মস্থলে যেতে হয়। তার পর তিনি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সব প্যাকেজ যন্ত্র দিয়ে স্ক্যান করেন এবং নিজের ছোট যানে উঠিয়ে নেন। এভাবে তার দিন শুরু হয়।

প্রতিদিন তিনি অন্তত ১০ বার প্যাকেজ গ্রহণ করেন এবং ১৫০টির বেশি প্যাকেজ বিতরণ করেন। শুরুর দিকে তার খুব কষ্ট হতো। সারাদিন প্যাকেজ বিলি করার পর বাড়িতে ফিরে তার কথা বলার শক্তিও অবশিষ্ট থাকতো না। তিনি কোনো কোনো দিন ১২ ঘন্টার বেশি কাজ করেছেন। কখনও কখনও প্যাকেজের পরিমাণ খুব বেশি হলে, সময়মতো কাজ শেষ করতে পারতেন না। পরিবার থেকে তাকে এ-কাজ ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সরবরাহ-কর্মীর কাজ ছেড়ে দেননি।

সিয়াও ইউ চীনের কোটি কোটি সরবরাহ-কর্মীর একজন। তবে, তাকে দিয়েই আমরা অন্যদের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারি। সম্প্রতি সিপিএনডাটা এবং Suning Online Market যৌথভাবে সরবরাহ-কর্মীদের ওপর একটি জরিপ-প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুসারে, তরুণ, নারী, ও উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্নরা অধিক হারে এই পেশায় যোগ দিচ্ছেন। এ পেশার বড় আকর্ষণ হচ্ছে বড় অংকের অর্থ আয়ের সুযোগ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশের বেশি সরবরাহ-কর্মী প্রতিদিন ৮ ঘন্টা বা তারচেয়ে বেশি সময় কাজ করেন এবং প্রতিমাসে তারা জনপ্রতি গড়ে ২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করেন।

সিয়াও ইউ বলেন, এখন তিনি প্রতিটি রুটের সঙ্গে পরিচিত। প্রয়োজনে তিনি সময় বাঁচাতে নিজের মতো করে নতুন রুট তৈরি করে নেন। এখন তার সঙ্গে বহু ক্লায়েন্টের খাতির হয়েছে। তারা একে অপরকে চেনেন। প্রতিবার পণ্যের ডেলিভারি নেওয়ার সময় তারা সিয়াওকে ধন্যবাদ জানান। এটা তার ভালো লাগে।

একজন ভালো সরবরাহ-কর্মীর অপরিহার্য গুণ হচ্ছে দ্রুত ও সময়মতো কাজ করার দক্ষতা। প্রযুক্তির উন্নয়নও এ কাজের ওপর প্রভাব ফেলছে। ছাং সিয়াও লিয়াং একজন অভিজ্ঞ সরবরাহ-কর্মী। তিনি জানালেন, কয়েক বছর আগেও সব প্যাকেজে ঠিকানা লেখা হতো হাতে। হাতে লেখা তারা অনেকসময় বুঝতেন না। ফলে ভুল হতো; নষ্ট হতো সময়। পরে ব্যবহার শুরু হলো 'বার কোড সংগ্রাহক' নামক একটি যন্ত্রের। তবে এ যন্ত্রের ওজন কয়েক কেজি। মানে অসুবিধাজনক। এখন ছাং সিয়াও লিয়াং নতুন একটি যন্ত্র পেয়েছেন। যন্ত্রের আকার একটি মোবাইলের সমান। এ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রত্যেক প্যাকেজের কোড স্ক্যান করে সব তথ্য পাওয়া যায়; তথ্য সংরক্ষণ করা যায়; এবং ক্লায়েন্টের সঙ্গে এসএমএসের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে মাত্র ২০ সেকেন্ডে একটি প্যাকেজ নিবন্ধিত হতে পারে।

সরবরাহ-কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে আজকাল। ২০০৭ সালে চাও লি চিয়ে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা পাস করে সুন ফেং কোম্পানির একজন বিমানচালক হন। তিনি বিমানচালক হতে দু'বছর প্রশিক্ষণ নেন। অথচ শুরুতে তিনি একজন সাধারণ সরবরাহ-কর্মী ছিলেন। এখন তিনি কোম্পানির বিমান চালিয়ে হাজার কিলোমিটার দূরে পণ্য বিতরণ করেন। চলতি বছর পর্যন্ত তিনি ২৫০০ ঘন্টার বেশি বিমান চালিয়েছেন। ১৩ বছর আগে তিনি শুরু করেন সরবরাহ-কর্মীর কাজ এবং এখনও তিনি এ কাজের সঙ্গে জড়িত। শুধু তার কাজের ধরন পাল্টে গেছে। এখন তার দায়িত্ব বেড়েছে। তিনি অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত বিমান চালাতে চান।

এ বিশ্বে সহজ কোনো চাকরি নেই। নিজেদের চাকরিতেও সরবরাহ-কর্মীদেরও চিন্তা আছে, উদ্বেগ আছে, সমস্যা আছে। সরবরাহ-কর্মীরা চান, তাদের সরবরাহযানটি আটক করা হবে না; সময়মতো পণ্য বিতরণ করতে না-পারলে ক্লায়েন্ট সহনশীল আচরণ করবেন; তেমন ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট অসংগত কোনো দাবি করবেন না; এবং তাদের বিরুদ্ধে কোম্পানিতে অভিযোগ করবেন না। সরবরাহ-কর্মীর গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হলে সেটি এক থেকে দু'মাস আটক রাখা হয় আইনানুসারে। এই সময়টা তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। আবার ক্লায়েন্ট অভিযোগ করলেও সরবরাহ-কর্মীকে শাস্তি দেওয়া হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। কখনও কখনও সরবরাহ-কর্মীকে কয়েক হাজার ইউয়ান পর্যন্ত জরিমানা গুণতে হয়।

সিয়াও ইউ একবার একজন ক্লায়েন্টের প্যাকেজ বিতরণ করতে ভুলে যান। শাস্তিস্বরূপ তাকে প্যাকেজের মূল্য এবং অতিরিক্ত ৩০০ ইউয়ান জরিমানা দিতে হয়। ছাং সিয়াও লিয়াংও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীণ হয়েছেন। একবার তার বিরুদ্ধে ক্লায়েন্টের অভিযোগের কারণে তিনি কোম্পানির শ্রেষ্ঠ কর্মী হবার সুযোগ হারান।

বিতরণকৃত প্যাকেজের সংখ্যা অনুযায়ী একজন সরবরাহ-কর্মী বেতন পান। এক দিন কাজ না-করলে আয় কম হয়। তাই সারা বছর তারা প্রায় কখনও ছুটি নেন না। তবে সার্বিক দিক থেকে দেখলে, গেল কয়েক বছরে সরবরাহ-কর্মীদের কর্মপরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে এবং তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা-ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে।

সরবরাহ-কর্মীরা যে-কাজ করেন, তা অন্য অনেক কাজের মতোই একটা কাজ। তবে, তাদের কাজের সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। তাদেরকে সম্মান করলে এবং স্বীকৃতি দিলে আমাদের জীবন আরও সুন্দর ও সুবিধাজনক হয়ে উঠতে পারে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040