সম্প্রতি নেপালে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী সাত দেশের জোট বিমসটেকের চতুর্থ শীর্ষসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমসটেকের চতুর্থ সম্মেলনে অংশ নেন। বিমসটেক সম্মেলনে ভাষণে শেখ হাসিনা মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল সৃষ্টি, বিনিয়োগ ও জ্বালানি খাতে যৌথ প্রচেষ্টা, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং অর্থায়ন প্রক্রিয়া গড়ে তোলার মাধ্যমে বিমসটেক ফোরামে সহযোগিতা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই উপআঞ্চলিক সংস্থাটি ১৯৯৭ সালের ৬ জুন ব্যাংকক ঘোষণার মধ্য দিয়ে গঠিত হয়। এই জোটের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা এ পাঁচটি দক্ষিণ এশিয়া এবং মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড এ দুটি হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।
বর্তমান নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সংস্থার প্রয়োজন বাড়ছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের ফলে প্রতিরক্ষা সংস্থার গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং তার পরিবর্তে অর্থনৈতিক আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে কোনো দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা এবং প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য আঞ্চলিক জোটগুলোই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে গঠিত হয়েছে আসিয়ান, অ্যাপেক, সার্ক প্রভৃতি আঞ্চলিক সংস্থা।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ৬ জুন ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-থাইল্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন বা বিসটেক (BISTEC)। ডিসেম্বরে মিয়ানমার এই সংস্থায় যোগ দিলে M যোগ করে নতুন নাম রাখা হয় বিমসটেক (BIMSTEC)। ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালের প্রথম দিকে নেপাল ও ভুটান এই সংস্থায় যোগ দেয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান এ সাতটি দেশ বিমসটেকের সদস্য। তাদের মিলিত আয়তন ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার এবং এ অঞ্চলের লোকসংখ্যা ১৩০ কোটি। কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের আদান-প্রদানের পরিমাণ মাত্র ৭৩০ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট বাণিজ্যের শতকরা চার ভাগ মাত্র।
গত ২০ বছরে বিমসটেকের চারটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিমসটেকের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, পর্যটন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবহন ও যোগাযোগ, ওষুধ, বস্ত্র, চামড়া, কৃষি প্রভৃতি খাতে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করা। ২০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এখনো কার্যকর অর্থনৈতিক ভূমিকা গড়ে ওঠেনি।
বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে আদিবাসীরূপে পরিচিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গুরুত্ব লক্ষণীয়। নিজস্ব রীতি, সংস্কৃতি যাপনের ধারা আঁকড়ে তাদের বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা। বিমসটেকের দেশগুলোতে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা বিমসটেকের জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ হলেও মোট দারিদ্র্য হারের ১৫ শতাংশ।
বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংশ্লিষ্ট দু'টি রাষ্ট্রে রোহিঙ্গা সঙ্কট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এটি বিশ্বের মারাত্মক মানবিক সঙ্কটগুলোর একটি। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা, যাদের বেশির ভাগই মুসলিম, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বর নিপীড়ন ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানকে জাতিগত নিধনের উদাহরণ বলেছে খোদ জাতিসঙ্ঘ।
পারস্পরিক সহযোগিতার প্রত্যয় ও লক্ষ্য নিয়ে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক এ সংস্থাটি শিগগিরি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এমনটিই সকলের প্রত্যাশা।