juchang
|
হঠাৎ যতীন এক সময়ে বলিয়া উঠিল,'মাসি,তোমাকে কি আমার সেদিনকার স্বপ্নের কথা বলেছি ।'
'কোন্ স্বপ্ন ।'
'মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল-- কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না,সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল,কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না । মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল । তাকে অনেক ক'রে ডাকলুম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না ।'
মাসি কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন । ভাবিলেন,'যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিঁকিল না । দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালো-- প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয় ।'
'মাসি,তোমার কাছে যে স্নেহ পেয়েছি সে আমার জন্মজন্মান্তরের পাথেয়,আমার সমস্ত জীবন ভ'রে নিয়ে চললুম । আর-জন্মে তুমি নিশ্চয় আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, আমি তোমাকে বুকে ক'রে মানুষ করব ।'
'বলিস কী যতীন,আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব ? নাহয়,তোরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম হবে-- সেই কামনাই কর-না ।'
'না,না, ছেলে না । ছেলেবেলায় তুমি যেমন সুন্দরী ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়েই তুমি আমার ঘরে আসবে । আমার মনে আছে,আমি তোমাকে কেমন করে সাজাব ।'
'আর বকিস্ নে,যতীন,বকিসনে-- একটু ঘুমো ।'
'তোমার নাম দেব লক্ষ্মীরানী ।'
'ও তো একেলে নাম হল না ।'
'না,একেলে নাম না । মাসি,তুমি আমার সাবেক-কেলে-- সেই সাবেক কাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসো ।'
'তোর ঘরে আমি কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসবে,এ কামনা আমি তো করতে পারি নে ।'
'মাসি,তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর ?-- আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও ?'
'বাছা,আমার যে মেয়েমানুষের মন,আমিই দুর্বল-- সেইজন্যেই আমি বড়ো ভয়ে ভয়ে তোকে সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি । কিন্তু,আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই করতে পারি নি ।'
'মাসি,এ জীবনের শিক্ষা আমি এ জীবনে খাটাবার সময় পেলুম না । কিন্তু ,এ সমস্তই জমা রইল,আসছে বারে মানুষ যে কী পারে তা আমি দেখাব । চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে ফাঁকি,তা আমি বুঝেছি।'
'যাই বল,বাছা,তুমি নিজে কিছু নাও নি,পরকেই সব দিয়েছ ।'
'মাসি,একটা গর্ব আমি করব,আমি সুখের উপরে জবরদস্তি করি নি-- কোনোদিন এ কথা বলি নি, যেখানে আমার দাবি আছে সেখানে আমি জোর খাটাব । যা পাই নি তা কাড়াকাড়ি করি নি । আমি সেই জিনিস চেয়েছিলুম যার উপরে কারো স্বত্ব নেই --সমস্ত জীবন হাতজোড় ক'রে অপেক্ষাই করলুম ; মিথ্যাকে চাই নি ব'লেই এতদিন এমন ক'রে বসে থাকতে হল-- এইবার সত্য হয়তো দয়া করবেন । ও কে ও-- মাসি,ও কে ।'
'কই,কেউ তো না ,যতীন ।'
'মাসি,তুমি একবার ও ঘরটা দেখে এসো গে,আমি যেন-- '
'না,বাছা,কাউকে তো দেখলুম না ।'
'আমি কিন্তু স্পষ্ট যেন--'
'কিচ্ছু না যতীন-- ঐ যে ডাক্তারবাবু এসেছেন ।'
'দেখুন,আপনি ওঁর কাছে থাকলে উনি বড়ো বেশি কথা কন । কয়রাত্রি এমনি করে তো জেগেই কাটালেন। আপনি শুতে যান,আমার সেই লোকটি এখানে থাকবে ।'
'না,মাসি,না,তুমি যেতে পাবে না ।'
'আচ্ছা,বাছা,আমি না হয় ঐ কোণটাতে গিয়ে বসছি ।'
'না,না,তুমি আমার পাশেই বসে থাকো-- আমি তোমার এ হাত কিছুতেই ছাড়ছি নে-- শেষ পর্যন্ত না । আমি যে তোমারই হাতের মানুষ,তোমারই হাত থেকে ভগবান আমাকে নেবেন ।'
'আচ্ছা বেশ,কিন্তু আপনি কথা কবেন না,যতীনবাবু । সেই ওষুধটা খাওয়াবার সময় হল-- '
'সময় হল ? মিথ্যা কথা । সময় পার হয়ে গেছে-- এখন ওষুধ খাওয়ানো কেবল ফাঁকি দিয়ে সান্ত্বনা করা । আমার তার কোনো দরকার নেই । আমি মরতে ভয় করি নে । মাসি,যমের চিকিৎসা চলছে, তার উপরে আবার সব ডাক্তার জড়ো করেছ কেন-- বিদায় ক'রে দাও, সব বিদায় করে দাও । এখন আমার একমাত্র তুমি-- আর আমার কাউকে দরকার নেই-- কাউকে না-- কোনো মিথ্যাকেই না।'
'আপনার এই উত্তেজনা ভালো হচ্ছে না ।'
'তা হলে তোমরা যাও,আমাকে উত্তেজিত কোরো না ।-- মাসি,ডাক্তার গেছে ? আচ্ছা,তা হলে তুমি এই বিছানায় উঠে বোসো-- আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে একটু শুই ।'
'আচ্ছা,শোও,বাবা,লক্ষ্মীটি,একটু ঘুমোও ।'
'না,মাসি,ঘুমোতে বোলো না-- ঘুমোতে ঘুমোতে হয়তো আর ঘুম ভাঙবে না । এখনো আর-একটু আমার জেগে থাকবার দরকার আছে । তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছ না ? ঐ যে আসছে । এখনই আসবে ।'
'বাবা যতীন,একটু চেয়ে দেখো-- ঐ যে এসেছে । একবারটি চাও ।'
'কে এসেছে । স্বপ্ন ?'
'স্বপ্ন নয়, বাবা, মণি এসেছে-- তোমার শ্বশুর এসেছেন ।'
'তুমি কে ?'
'চিনতে পারছ না,বাবা,ঐ তো তোমার মণি ।'
'মণি,সেই দরজাটা কি সব খুলে গিয়েছে ।'
'সব খুলেছে,বাপ আমার , সব খুলেছে ।'
'না মাসি,আমার পায়ের উপর ও শাল নয়,ও শাল নয়,ও শাল মিথ্যে,ও শাল ফাঁকি।'
'শাল নয়,যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে--ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর্।--অমন ক'রে কাঁদিস নে, বউ,কাঁদবার সময় আসছে-- এখন একটুখানি চুপ কর্ ।' (টুটুল)