চীনের অন্তঃর্মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের খু পু ছি মরুভূমির অভ্যন্তরে একটি মূর্তি আছে। এই মূর্তিটি দেখলে মনে হবে একটি সবুজ গাছ গোটা পৃথিবীকে ধারণ করে আছে। এ মূর্তি শুধু খুপুছি মরুভূমি নিয়ন্ত্রণকাজের সাফল্যের কথা বলে না; বরং এ-কাজে যারা অবদান রেখেছেন, তাদের কথাও স্মরণ করে।
খুপুছি মরুভূমি বিশ্বের একমাত্র সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রিত মরুভূমি। ১৮.৬ হাজার বর্গ-কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই মরুভূমি। এই মরুভূমি নিয়ন্ত্রণ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে; ব্যবহার করতে হয়েছে উন্নত প্রযুক্তি।
খুপুছি একটি সেকেন্ডারি মরুভূমি। তার মানে দুই হাজার বছর আগে এখানে ছিল তৃণভূমি। চারণভূমি হিসেবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার একে মরুভূমিতে রূপান্তরিত করে।
খুপুছি মরুভূমির নিয়ন্ত্রণে প্রথমে এর চারপাশে কৃত্রিম বন তৈরি করা হয়। তারপর মাঝখানের ভূমিতে তৈরি করা হয় বিশেষ বস্তু দিয়ে তৈরি বাধের গ্রিড। তারপর সেখানে বপন করা হয় গাছপালা।
কাসাভাকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা নতুন ধরনের বাধের গ্রিড চীনের নিজস্ব আবিষ্কার। এই কৌশলের আবিষ্কারক ইউ ই সাংবাদিককে বলেন, "ঘাস দিয়ে তৈরি বাধের গ্রিডের মেয়াদ দু'বছর এবং স্যালিক্স দিয়ে তৈরি গ্রিড ৩-৫ বছরের মতো কার্যকর থাকতে পারে। আর আমাদের পণ্য দিয়ে তৈরি গ্রিড ১০ বছর কার্যকর থাকবে। তা ছাড়া, এমন বাধ ১০ বছর পর প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে মিশে যাবে; কোনো দূষণ সৃষ্টি করবে না।"
মরুভূমিতে বন সৃষ্টির আরেকটি প্রযুক্তি হচ্ছে, দ্রুত গাছ রোপণের প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মরুভূমিতে দ্রুত গর্ত করে চারা রোপণ করা যায়। এ পদ্ধতিতে একটি গাছ লাগাতে মাত্র ৩ কেজি পানি লাগে।
গাছ রোপণের এই পদ্ধতির আবিষ্কারক কোম্পানি ইলি মরুভূমি গবেষণালয়ের উপ-পরিচালক ছাং লি সিন বলেন, "আগে একটি গাছ রোপণ করতে চাইলে প্রথমে গর্ত করা, চারা গর্তে রাখা, তাতে পানি দেওয়া, এবং মাটি ভরাট করা লাগত। এতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে একটা চারা রোপণ করতে। এখন আমাদের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দু'জন কর্মী একসাথে দশ সেকেন্ডে একটি চারাগাছ রোপণ করতে পারেন। নতুন প্রযুক্তি কার্যকর এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ই লি কোম্পানি এ প্রযুক্তির মাধ্যমে গেল ৯ বছর ১ লাখ হেক্টর বন সৃষ্টি হয়েছে এবং ১৫০ কোটি ইউয়ান সাশ্রয় হয়েছে।"
২০০৯ সালে অন্য একটি নতুন প্রযুক্তিও ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাতাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা হয় এবং যেভাবে চারা রোপণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে, সেভাবে চারা রোপণ করা সহজতর হয়। আগে মরুভূমিতে গাছ রোপণ করতে চাইলে প্রথমে ট্র্যাক্টর দিয়ে বড় বড় বালির টিলাকে সমতল করতে হতো। ৬০০ বর্গমিটার মরুভূমি সমতল করতে খরচ হতো ১৫০০ থেকে ২০০০ ইউয়ান। এখন নতুন প্রযুক্তি ব্যয় কমিয়েছে। নতুন প্রযুক্তির ফলে মরুভূমির টিলাগুলোর উচ্চতা প্রাকৃতিকভাবেই ৫০ শতাংশ কমেছে।
মরুভূমির যেসব স্থানে মানুষ সহজে যেতে পারে না, সেসব জায়গায় এখন ড্রোনের মাধ্যমে চারাগাছ রোপণ করা সম্ভব হচ্ছে। বর্ষাকাল শুরুর আগে ড্রোন বীজ নিয়ে মরুভূমিতে প্রবেশ করে এবং বীজগুলো নীচে ছড়িয়ে দেয়। একেকটি ড্রোন একেকবারে ১০ কেজি বীজ বহন করতে পারে এবং ৬.৬ হেক্টর মরুভূমিতে বীজ ছড়িয়ে দিতে এর মাত্র ১০-১২ মিনিট লাগে।
ইলি কোম্পানির একজন গবেষক হান মেই ফেই সাংবাদিককে জানান, মরুভুমি নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির অধিকাংশই পরীক্ষাগার থেকে আসেনি। বরং মানুষ মরুভুমি নিয়ন্ত্রণকাজের অনুশীলন থেকে ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসব প্রযুক্তি আয়ত্ব করেছে। তিনি বলেন, তারা এসব প্রযুক্তির স্বত্ব সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেননি। কারণ, মরুভূমির নিয়ন্ত্রণ একটি কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এসব প্রযুক্তি উন্মুক্ত থাকা দরকার।
এখন খুপুছি মরুভূমির অভিজ্ঞতা চীনের অন্য কয়েকটি মরুভুমিতে কাজে লাগছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনামূল্যে এ অভিজ্ঞতা বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ছে।
খুপুছি মরুভূমি নিয়ন্ত্রণের সাফল্য শুধু প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে হয়েছে, তা নয়; স্থানীয় মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম এতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। খুপুছি মরুভূমির সীমান্তে বাস করেন 'মো এ কেন তাও এ চি'(মঙ্গোলিয়া জাতির মানুষ) নামে একজন পুরুষ। তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে মরুভূমিতে গাছ রোপণ শুরু করেন। শুরুতে তিনি এক বছরে ২-৩ মু ভূমিতে গাছ রোপণ করতেন। ২০০৩ সাল থেকে সরকার গাছ-রোপণকারীদের ভাতা দিতে শুরু করে এবং 'মো এ কেন তাও এ চি' আরও বেশি গাছ রোপণ করতে শুরু করেন। তিনি একা এ পর্যন্ত ৬৬০ হেক্টর জমিতে গাছ রোপণ করেন এবং সৃষ্টি করেন একটি বিশাল কৃত্রিম বন। প্রতিবছর গাছের চারা বিক্রির মাধ্যমে তিনি বেশ আয়ও করছেন।
আও থে কেং হুয়া নামে একজন নারীও স্থানীয় জনপ্রিয় একজন বৃক্ষ আবাদকারী। তার একটি ডাক নাম আছে, 'মরুভূমির গোলাপ'। তার নেতৃত্বে পেশাদার একটি দল আছে। তারা যেমন অভিজ্ঞ তেমনি তাদের আছে পেশাদার সরঞ্জাম। তার এ দল দুটি অংশ নিয়ে গঠিত হয়। একটি মঙ্গোলিয়া জাতির মানুষ, আরেকটি তিব্বতি জাতির মানুষ। কয়েক বছর আগে, ট্রেন স্টেশনে আও থে কেং হুয়া কয়েকজন তিব্বতি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন। তারা চাকরির খোঁজে এসেছেন জানতে পেরে আও থে কেং হুয়াং তাদের নিজের দলে নিয়ে নেন। তখন থেকেই কয়েকজন তিব্বতি কর্মী প্রতিবছর খুপুছি মরুভূমিতে এসে তাদের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। এখন আও থে কেং হুয়ার দল খুপুছি মরুভুমির বাইরে গিয়ে সিন চিয়াং, ছিংহাইসহ নানা জায়গায় বৃক্ষরোপণের কাজ করছে। এখন তার দল তিব্বতে গিয়ে ওখানে অর্থকরী ফসল চাষের পরিকল্পনা করছে। তিনি নিজে ৩০০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে অন্তঃর্মঙ্গোলিয়া থেকে যাবেন তিব্বতে। তিনি সাংবাদিককে জানান, দশ বছর আগে তারা সিনচিয়াংয়ে গিয়ে মরুভূমিতে গাছ রোপণ করেন এবং কয়েকজন স্থানীয় মানুষ নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। তবে তারা গাছ রোপণের কথা শুনে শুরুতে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ, তখন তাদের ধারণা ছিল মরুভুমিতে গাছ বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু আও থে কেং হুয়ার দল ওখানে গাছ রোপণ করেন এবং পরবর্তী বছর স্থানীয় মানুষ জীবিত গাছ দেখে অবাক হয় এবং তাদের কাজে অংশ নিতে শুরু করে।
মেং কে তা লাইও খুপুছি মরুভুমির স্থানীয় মানুষ। এখন তিনি স্থানীয় পর্যটন শিল্পে জড়িত আছেন। তিনি বলেন, আগে তারা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের জন্মভূমিকে 'মৃত্যু সমুদ্র' বলে আখ্যায়িত করতেন। তবে এখন তারা নিজের জন্মস্থানকে ডাকেন 'সুন্দর মরুভূমি' বলে। (শিশির/আলিম)