চীনের কুয়াং চৌ'র প্রবীণ ক্যান্টিন
  2018-08-23 08:53:36  cri

চীনে প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ চীনে ৬০ বছর বয়সী বা তারচেয়ে বেশি মানুষের সংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ১০ লাখ, যা মোট লোকসংখ্যার ১৭.৩ শতাংশ। বড় নগর হিসেবে কুয়াং চৌতে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা ১৬ লাখ ১০ হাজার। এখানে প্রবীণসংশ্লিষ্ট সমস্যা প্রকট। ২০১৬ সাল থেকে কুয়াং চৌ'তে চালু হয় 'প্রবীণ ক্যান্টিন' প্রকল্প এবং কয়েক বছরের মধ্যে কুয়াং চৌ শহরের প্রায় সব কমিউনিটি ও গ্রাম এ-প্রকল্পের আওতায় আসে।

এই ক্যান্টিনে দুই পদের মাংস, একটি সবজি, এবং এক বাটি স্যুপের সমন্বয়ে গঠিত এক বেলার খাবারের দাম মাত্র ৯ ইউয়ান। কুয়াং চৌ শহরের ইয়ু সিউ বিভাগের লিউ রং কমিউনিটির বাসিন্দাদের মধ্যে ২০ শতাংশ প্রবীণ। এখানে প্রবীণ ক্যান্টিন প্রতিদিন গড়ে ৩০০টি অর্ডার পায়। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৮৮ বছর বয়সী লিউ জুং ইয়ান কয়েক মিনিট হেঁটে আসেন প্রবীণ ক্যান্টিনে। প্রবীণদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এখানে খাবার রান্না হয়। সাধারণত খাবার রান্না হয় স্টিমে; দেওয়া হয় কম তেল ও লবণ। প্রবীণরা এই খাবার পছন্দ করেন। স্বেচ্ছাসেবক ট্রেতে করে লিউ জুং ইউয়ানের সামনে খাবার পরিবেশন করেন। লিউ এক বাটি ভাত খাওয়ার পর আরেক বাটি চেয়ে নেন। তিনি সাংবাদিককে জানান, তার ছেলে ও ছেলের স্ত্রী ডাক্তার। তাই তারা খুব ব্যস্ত। আগে তিনি নিজেই বাড়িতে রান্না করতেন। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে। আর পারেন না। রান্না করতে গেলে কখনও কখনও গ্যাসের চুলা বন্ধ করতে ভুলে যান। তাই তার ছেলে চিন্তা করে। এখানে খেলে তার ছেলে চিন্তামুক্ত থাকেন। এখানে খাবার সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ। স্বেচ্ছাসেবকরাও খুব ভালো।

ক্যান্টিনে তিনটি নোটিশ ঝুলানো আছে। এসব নোটিশে বলা হয়েছে প্রবীণদের জন্য খাবার তৈরি করতে কোন কোন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। লাঞ্চ খাওয়ার আগে স্বেচ্ছেসেবকের উদ্যোগে সব প্রবীণ একসাথে আঙ্গুলের ব্যয়াম করেন। অনেক প্রবীণ দীর্ঘকাল ধরে এখানে খাচ্ছেন। তারা নির্দিষ্ট আসনে বসতে পছন্দ করেন। প্রবীণদের নতুন নতুন বন্ধ হয় এই ক্যান্টিনে। এখানে তারা একসঙ্গে খাবার খান, গল্প করেন, আনন্দ করেন।

খাওয়ার পাশাপাশি, অনেক প্রবীণ এখানে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। বাড়িতে তাদের নিসঙ্গ লাগে। এখানে এলে নতুন-পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়, কথা হয়। তাদের একা লাগে না।

একটি গোল টেবিলে বসে আছেন ৮ জন প্রবীণ নারী। তারা আগে পরস্পরের অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু ক্যান্টিনে খাওয়ার সুবাদে এখন তারা একে অপরের ভালো বন্ধু। ৬৫ বছর বয়সী লিন চিয়ে চেন সাংবাদিককে দেখান ৮ জনের তৈরি হস্তজাত শিল্প। তিনি বলেন, তারা এগুলো বিক্রয় করে সব টাকা স্বজনহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরকে দান করেন। উত্সবের সময় প্রবীণ ক্যান্টিনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। এসময় সবাই একসাথে চাও চি তৈরি করেন। কখনও কখনও প্রবীণদের জন্য জন্মদিনের অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়।

চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত কুয়াং চৌতে প্রবীণ ক্যান্টিনের সংখ্যা ছিল ৯৫২টি। হুয়াং হুয়া থাং কমিউনিটির ৫৫ বছর বয়সী বাসিন্দা চেন চু পিং অবসরপ্রাপ্ত। তার মা ৮৫ বছর বয়সী এবং রোগের কারণে তাকে সবসময় বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। প্রবীণ ক্যান্টিন চালু হবার পর থেকেই চেন চু পিং প্রতিদিন এখান থেকে খাবার কিনে বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, বাজারে গেলে তার মা নিজে বাড়িতে থাকেন। তিনি চিন্তিত থাকেন। এখন প্রবীণ ক্যান্টিনে গিয়ে খাবার কিনে বাড়ি ফিরতে তার মাত্র কয়েক মিনিট লাগে এবং দামও বেশি না। তাই তার বড় একটি সমস্যা সমাধান হয়েছে।

কুয়াং চৌ স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ১০-১৫ মিনিট হাঁটা-পথ দূরত্বে এবং উপকণ্ঠে ২০-১৫ মিনিট হাঁটা-পথ দূরত্বের মধ্যে ক্যান্টিন থাকতে হয়। কুয়াং চৌ শহরের সামাজিক সংস্থা প্রশাসন বিভাগের প্রধান ওয়াং ফু জুন বলেন, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থ বিভাগ, খাদ্য ও ওষুধ তত্ত্বাবধান বিভাগ, সামাজিক কল্যাণ বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ যৌথভাবে এ-ব্যবস্থা বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

লিউ রো কমিউনিটি প্রবীণ ক্যান্টিনের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা আছে প্রত্যেক দাতার নাম। তারা ১০০ থেকে ২০০০ ইউয়ান বা তেল-ডাল-চাল ইত্যাদি দান করেছেন। প্রবীণ ক্যান্টিনে সরকার ভর্তুকি দেয় এবং বিভিন্ন কোম্পানি ডিসকাউন্ট দেয়। এখানে স্ট্যান্ডার্ড খাবারের দাম ১৫ ইউয়ান। ক্রেতা দেন ৯ ইউয়ান, কোম্পানি ৩ ইউয়ান ডিসকাউন্ট দেয় এবং সরকার ৩ ইউয়ান ভর্তুকি দেয়। দরিদ্র প্রবীণদের জন্য বিনামূল্যে খাবার খাওয়ার সুযোগও আছে।

তাইওয়ান কোম্পানি ল্য ইউয়ান একটি কাস্ট ফুড কোম্পানি এবং তারা সাধারণত অফিসের কর্মীদের জন্য লাঞ্চ সরবরাহ করে। এখন তারা কুয়াং চৌর ৭টি কমিউনিটির ১০টি প্রবীণ ক্যান্টিনে খাবার সরবরাহ করছে। কোম্পানি প্রবীণদের জন্য কিছু রেস্টুরেন্টে 'প্রবীণ একালা' খুলেছে। প্রবীণরা একটু আগে খেতে পছন্দ করেন। তাই তারা লাঞ্চের সময় একটু আগেই খাবার সরবরাহ করে। কোম্পানির ম্যানেজার জানিয়েছেন, সাধারণত তারা একটি খাবার থেকে মুনাফা করেন ৩-৪ ইউয়ান। তবে প্রবীণদের সরবরাহ করা খাবার থেকে মুনাফা হয় ০.৫-১ ইউয়ান।

২০১৬ সাল থেকে সরঞ্জাম ক্রয়, সাইট উন্নয়ন, নেটওয়ার্ক নির্মাণ এবং খাবারসহ বিভিন্ন খাতে সরকার ১০ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানি ও সামাজিক সংস্থাগুলোকে এ-প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে সরকার উত্সাহ দিয়ে থাকে।

এ্য ল্য ম্য চীনের ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার দেওয়ার একটি প্লাটফর্ম। তারা নিজের অ্যাপ্লিকেশনে প্রবীণ ক্যান্টিন সেবা চালু করেছে। প্রবীণরা এ অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে প্রবীণ ক্যান্টিন থেকে খাবার অর্ডার করতে পারেন। অর্ডারকৃত খাবার বিনামূল্যে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

আগের ১৪৬০টি বৃদ্ধ-নিবাস ও ১৮৮টি পরিবার সেবাকেন্দ্রের আলোকে নির্মাণ করা হয়েছে প্রবীণ ক্যান্টিন। এতে পাবলিকের অর্থের সুব্যবহার করা হয়েছে। খাবার সরবরাহের ব্যাপারে সরকার সব কাজ নিজে করার বদলে সামাজিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। কমিউনিটি নিজের অবস্থা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এখন প্রবীণ ক্যান্টিনের খাবারের ৮৫ শতংশের জন্য সামাজিক শক্তির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে।

(শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040