রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোগল্প 'শেষের রাত্রি' (প্রথম পর্ব)
  2018-08-18 15:44:22  cri



'মাসি!'

'ঘুমোও,যতীন,রাত হল যে ।'

'হোক-না রাত, আমার দিন তো বেশি নেই । আমি বলছিলুম,মণিকে তার বাপের বাড়ি-- ভূলে যাচ্ছি, ওর বাপ এখন কোথায়--'

'সীতারামপুরে ।'

'হাঁ সীতারামপুরে । সেইখানে মণিকে পাঠিয়ে দাও, আরো কতদিন ও রোগীর সেবা করবে । ওর শরীর তো তেমন শক্ত নয় ।'

'শোনো একবার! এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইবেই বা কেন ।'

'ডাক্তারেরা কী বলেছে সে কথা কি সে--'

'তা সে নাই জানল-- চোখে তো দেখতে পাচ্ছে । সেদিন বাপের বাড়ি যাবার কথা যেমন একটু ইশারায় বলা অমনি বউ কেঁদে অস্থির ।'

মাসির এই কথাটার মধ্যে সত্যের কিছু অপলাপ ছিল, সে কথা বলা আবশ্যক । মণির সঙ্গে সেদিন তাঁর এই প্রসঙ্গে যে আলাপ হইয়াছিল সেটা নিম্নলিখিত-মতো ।

'বউ, তোমার বাপের বাড়ি থেকে কিছু খবর এসেছে বুঝি ? তোমার জাঠতুতো ভাই অনাথকে দেখলুম যেন ।

'হাঁ, মা ব'লে পাঠিয়েছেন, আসছে শুক্রবারে আমার ছোটো বোনের অন্নপ্রাশন । তাই ভাবছি--'

'বেশ তো বাছা, একগাছি সোনার হার পাঠিয়ে দাও, তোমার মা খুশি হবেন।'

'ভাবছি, আমি যাব। আমার ছোটো বোনকে তো দেখিনি, দেখতে ইচ্ছে করে।'

'সে কী কথা, যতীনকে একলা ফেলে যাবে? ডাক্তার কী বলেছে শুনেছ তো?'

'ডাক্তার তো বলছিল, এখনো তেমন বিশেষ--'

'তা যাই বলুক, ওর এই দশা দেখে যাবে কী ক'রে।'

'আমার তিন ভাইয়ের পরে এই একটি বোন, বড়ো আদরের মেয়ে --শুনেছি, ধুম ক'রে অন্নপ্রাশন হবে-- আমি না গেলে মা ভারি--'

'তোমার মায়ের ভাব, বাছা, আমি বুঝতে পারি নে। কিন্তু যতীনের এই সময়ে তুমি যদি যাও, তোমার বাবা রাগ করবেন, সে আমি ব'লে রাখছি।'

'তা জানি । তোমাকে এক লাইন লিখে দিতে হবে মাসি, যে কোনো ভাবনার কথা নেই-- আমি গেলে বিশেষ কোনো--'

'তুমি গেলে কোনো ক্ষতিই নেই সে কি জানি নে । কিন্তু তোমার বাপকে যদি লিখতেই হয়, আমার মনে যা আছে সব খুলেই লিখব ।''

'আচ্ছা, বেশ-- তুমি লিখো না । আমি ওঁকে গিয়ে বললেই উনি--'

'দেখো বউ, অনেক সয়েছি-- কিন্তু এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও, কিছুতেই সইব না । তোমার বাবা তোমাকে ভালো রকমই চেনেন, তাঁকে ভোলাতে পারবে না ।'

এই বলিয়া মাসি চলিয়া আসিলেন । মণি খানিকক্ষণের জন্য রাগ করিয়া বিছানায় উপর পড়িয়া রহিল।

পাশের বাড়ি হইতে সই আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,'এ কি সই, গোসা কেন ।'

'দেখো দেখি ভাই, আমার একমাত্র বোনের অন্নপ্রাশন-- এরা আমাকে যেতে দিতে চায় না ।'

'ওমা, সে কী কথা, যাবে কোথায় । স্বামী সে রোগে শুষছে ।'

'আমি তো কিছুই করি নে, করিতে পারিও নে; বাড়িতে সবাই চুপচাপ, আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। এমন ক'রে আমি থাকিতে পারি নে, তা বলছি!'

'তুমি ধন্যি মেয়েমানুষ যা হোক ।'

'তা আমি, ভাই, তোমাদের মতো লোক দেখানে ভান করতে পারি নে । পাছে কেউ কিছু মনে করে বলে মুখ গুঁজড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা আমার কর্ম নয়।'

'তা, কী করবে শুনি ।'

'আমি যাবই, আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না ।'

'ইস্‌, তেজ দেখে আর বাঁচি নে । চললুম, আমার কাজ আছে ।

বাপের বাড়ি যাইবার প্রসঙ্গে মণি কাঁদিয়াছে-- এই খবরে যতীন বিচলিত হইয়া বালিশটাকে পিঠের কাছে টানিয়া তুলিল এবং একটু উঠিয়া হেলান দিয়া বসিল । বলিল, 'মাসি, এই জানালাটা আর-একটু খুলে দাও,আর এই আলোটা এ ঘরে দরকার নেই।'

জানালা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতো রোগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইল । কত যুগের কত মৃত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল ।

যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল । সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মোটা মোটা জলের ফোঁটার ভরা-- সে জল যেন আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য ভরিয়া রহিল ।

অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিত হইলেন । ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে ।

এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, 'মাসি, তোমরা কিন্তু বারবার মনে করে এসেছ, মণির মন চঞ্চল, আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি । কিন্তু দেখো--'

'না,বাবা, ভুল বুঝেছিলুম -- সময় হলেই মানুষকে চেনা যায় !'

'মাসি!''

'যতীন, ঘুমোও,বাবা ।'

'আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও! বিরক্ত হোয়ো না মাসি ।'

'আচ্ছা, বলো, বাবা।'

'আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতে কত সময় লাগে! একদিন যখন মনে করতুম ,আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি । তোমরা তখন--'

'না, বাবা, অমন কথা বোলো না-- আমিও সহ্য করেছি ।'

'মন তো মাটির ঢেলা নয়, কুড়িয়ে নিলেই তো নেওয়া যায় না । আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনো বোঝে নি; কোনো একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর--'

'ঠিক কথা, যতীন ।'

'সেইজন্যই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে করি নি ।'

মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন ।

কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাট আসিয়াছে তবু ঘরে যায় নাই । কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া; একান্ত ইচ্ছা, মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয় । মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়োজন করিতেছে । তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে । সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়ো না -- ও একটু চাহিতে শিখুক -- মানুষকে একটু কাঁদানো চাই ।'কিন্তু এ-সব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বোঝে না । যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, এ কথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আশা পরাভব মানিতেছিল না ।

মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে, এমন সময়ে হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, 'আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি । তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি, সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতো, সমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায়। জীবনে কত ভুল করি, কত ভূল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি । কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে ।'

মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন । অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু বাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না ।

'আমি ভাবছি, মাসি,ওর অল্প বয়স,ও কী নিয়ে থাকবে ।'

'অল্প বয়স কিসের , যতীন ? এ তো ওর ঠিক বয়স । আমরাও তো, বাছা, অল্প বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে ভাসিয়ে অন্তরের মধ্যে বসিয়েছি-- তাতে ক্ষতি হয়েছে কী । তাও বলি সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের !'

'মাসি,মণির মনটি যেই জাগবার সময় হল অমনি আমি--'

'ভাব কেন যতীন? মন যদি জাগে তবে সেই কি কম ভাগ্য !'

হঠাৎ অনেক দিনের শোনা একটা বাউলের গান যতীনের মনে পড়িয়া গেল--

ওরে মন, যখন জাগলি না রে

তখন মনের মানুষ এল দ্বারে ।

তার চলে যাবার শব্দ শুনে

ভাঙল রে ঘুম,

ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে ॥

'মাসি,ঘড়িতে ক'টা বেজেছে ।'

'ন'টা বাজবে ।'

'সবে ন'টা? আমি ভাবছিলুম, বুঝি দুটো, তিনটে, কি ক'টা হবে । সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপুর রাত আরম্ভ হয় । তবে তুমি আমার ঘুমের জন্যে অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন ।'

'কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না ,তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি ।'

'মণি কি ঘুমিয়েছে ।'

'না,সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক'রে তবে ঘুমোতে যায়।'

'বলো কী, মাসি, মণি কি তবে--'

'সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে ।'

'আমি ভাবতুম,মণি বুঝি --' (বাকী অংশ আগামী পর্বে)

(টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040