সফলতার জন্য চাই যথাযথ প্রস্তুতি: চীনা ফুটবলের জন্য বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা
  2018-08-15 15:34:13  cri

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হয়েছে প্রায় মাস খানেক আগে। ২০০৮ সালের পর ক্রোয়েশিয়া আবারও একবার বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল; উঠে গিয়েছিল ফাইনালে। এশিয়ার দলগুলোও বেশ ভালো করেছে এবারের বিশ্বকাপে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও ব্রিটেন তরুণ খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিল 'সোনালী প্রজন্ম'। রাশিয়া ৪৮ বছর পর আবার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

তবে ১৩০ কোটি মানুষের দেশ চীনের ফুটবল দল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ছিল অনুপস্থিত। অথচ চীনারা চায় তাদের খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে খেলুক। তারা এটাও চায় যে, চীন বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হোক।

উদ্বোধনী খেলায় সৌদি আরব ০-৫ গোলে রাশিয়ার কাছে হারে। তখন কেউ হয়তো ভাবেননি যে, এশীয় দেশগুলো সার্বিকভাবে টুর্নামেন্টে খুব ভালো করবে। তারাই পরে অবাক হয়ে দেখলেন যে, দক্ষিণ কোরিয়া ২-০ গোলে জার্মানিকে হারিয়ে দিল; জাপান শেষ ১৬-তে পৌঁছে গেল ও বেলজিয়ামকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল! ইরান ও পর্তুগালের খেলা ড্র হয়। এমনকি, সৌদি আরব গ্রুপের শেষ খেলায় জয়লাভ করে।

এবারের বিশ্বকাপে এশিয়া বা বিশ্বের অন্য যে-দেশগুলো ভালো করেছে, তাদের দৃষ্টি ছিল তরুণ ফুটবলার গড়ে তোলার দিকে। এসব খেলোয়াড় আবার বিদেশে বড় বড় লিগে খেলে পরিণত হয়েছেন। জাপান দলের ২৩ জনের মধ্যে ১৫ জনই ছিলেন বিদেশি ক্লাবের সদস্য। ইরানের ফরওয়ার্ড আলি রেজা জাহানবাকশি ২১টা গোল নিয়ে গত সিজনে ডাচ লীগে গোল্ডেন বুট পুরস্কার পান।

দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবল কমিটি স্পষ্টভাবে এমন নিয়ম প্রণয়ন করে যে, ক্রীড়া লটারির আয় তরুণ ফুটবলার গড়ে তুলতে ব্যয় হবে। প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক বিভিন্ন পর্যায়ে

ফুটবলারদের মান উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।

জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ক্রোয়েশিয়া, আইসল্যান্ড এবার বিশ্বকাপে চমত্কার নৈপুণ্য দেখিয়েছে। এবার সেমিফাইনালের চারটি দলই ইউরোপের। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফুটবলে বিশ্বব্যাপী ইউরোপ এগিয়ে আছে।

 

ইউরোপের অর্থনীতি দীর্ঘকাল ধরেই স্থিতিশীল ও উন্নত। আর তা সেসব দেশের তরুণ খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের জন্য ভালো পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপের যুবপ্রশিক্ষণ-ব্যবস্থা একটি 'কারখানা'র মতো যেখানে চাহিদা অনুযায়ী সেরা ক্রীড়াবিদ 'উত্পাদন' করা হয়।

বেলজিয়ামের 'সোনালী প্রজন্ম' বিশ্বকাপে আলো ছড়িয়েছে। তবে ১৬ বছর আগে, ২০০২ সালের বিশ্বকাপে তারা পুরোপুরিভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। পরের দু'তিনটি বিশ্বকাপে তারা ভালো করতে পারেনি। তবে দেশটিতে তরুণ প্রজন্মের ফুটবলারদের কঠোর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। জাতীয় ফুটবল কমিটি ক্লাবগুলোর যুবপ্রশিক্ষণে অর্থ সহায়তা দেয়। তারা অনেক যুব-ক্রীড়াবিদকে ইউরোপের ৫টি প্রধান লীগে খেলতে পাঠায়। দশ-বারো বছর পর বেলজিয়াম আবার শীর্ষে ফিরে আসে।

আইসল্যান্ড প্রথমবার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। এই দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজার। অথচ এক পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশটিতে কোচ আছে ৬ শতাধিক। এসব কোচ তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করেন।

বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের যুবপ্রশিক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত। ফ্রান্সের নিবন্ধিত খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৮ লাখ। ৮ বছরের বাছাই ও প্রশিক্ষণের পর মাত্র ৮০ জন পেশাদার খেলোয়াড় সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে আবার মাত্র ৩ জন জাতীয় দলে সুযোগ পায়।

অন্য এক ইউরোপীয় দেশ ব্রিটেনের মানুষ সব পর্যায়ে ও সব কমিউনিটিতে ফুটবল খেলে। তারা ২০১৭ সালে যথাক্রমে অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা অর্জন করে। এই তরুণরা জাতীয় দলের জন্য ভালো ভিত্তি গড়ে দেয়।

অন্যদিকে, চীনের ফুটবল লীগও গত কয়েক বছরে বেশ অগ্রগতি অর্জন করে। তবে আমাদের ক্রটিও স্পষ্ট। যেমন আমাদের ক্রীড়াবিদদের ইচ্ছাশক্তি কম এবং উদ্যোগের অভাব। আক্রমণ ও রক্ষণ—এই দুই ভাগেই চীনা ফুটবলাররা বাকি বিশ্ব থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।

২০০২ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী একজন চীনা ফুটবলার বললেন, এখন চীনের লীগে খেলোয়াড়দের বেতন দিন দিন বাড়ছে এবং প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়রা এমন আরামদায়ক পরিবেশ থেকে বাইরে গিয়ে উন্নত লীগে খেলে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দৃশ্যত আগ্রহী নয়। কেউ কেউ বিদেশে গেলেও, এক বা দু'বছরের মধ্যে আবার দেশে ফিরে আসে।

অন্যদিকে, উরুগুয়ে, বেলজিয়াম, আইসল্যান্ড এবং ক্রোয়েশিয়ার ভালো খেলোয়াড়রা যুব-প্রশিক্ষণ নিয়ে ইউরোপের উন্নত লীগে খেলে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী। ইউরোপের নিম্ন পর্যায়ের ছোট ক্লাব থেকে তারা সাধারণত খেলা শুরু করেন এবং নিজেদের ধাপে ধাপে উন্নত করার দিকে মন দেন।

এটা এখন স্পষ্ট যে, তরুণ খেলোয়াড় তৈরি করা একটা দেশের ফুটবলের সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য জরুরি। চীনের ফুটবলকে বিশ্বমানের করতে, এখানেও তরুণ ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি উন্নত প্রশিক্ষণ-ব্যবস্থা।

বিশ্বকাপের মাধ্যমে একটি দেশের ফুটবলের মান দ্রুত উন্নত হতে পারে এবং অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে একটি দেশ অনেক লাভবান হতে পারে। এবার বিশ্বকাপ রাশিয়াকে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছে। রুশ দল শেষ আটে পৌঁছানোয় গোটা দেশ উত্সাহিত হয়েছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বকাপ রাশিয়াকে ১৫০০ কোটি ডলার আয় করতে সাহায্য করেছে।

তা ছাড়া, বিশ্বকাপের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ রাশিয়াকে আরও ভালোভাবে জানতে পেরেছে। ডাচ ইরানি ৩৭ বছরের আফসিন রাশিয়ায় ইরানের তিনটি খেলা দেখেছেন। ২ বছর বয়সে তিনি পিতামাতার সঙ্গে হল্যান্ড গিয়েছিলেন। আফসিন সাংবাদিককে জানান, তিনি ব্রাজিল ও রাশিয়ায় দু'বার বিশ্বকাপের খেলা মাঠে বসে দেখেছেন। রাশিয়ার মানুষ বন্ধুত্বপূর্ণ এবং তারা একটি সফল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও বলেছেন, বিশ্বকাপের মাধ্যমে রাশিয়ার ব্যাপারে বাকি বিশ্বের মানুষের ধারণা পরিবর্তন হয়েছে।

বিশ্বকাপ থেকে চীন যথেষ্ট দীর্ঘ সময় বাইরে পরে আছে। চীনে একটি কথা আছে: "তাড়াহুড়া করে কোনো কাজ করলে সেটা ভালো হয় না। সাফল্য অর্জনে সময় লাগবে।" আমরা যদি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে চাই, তবে আগামী ১০ বছরকে টার্গেট করে পরিশ্রম করতে হবে। পাশাপাশি, বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়াও চীনের লক্ষ্য। ২০০৮ সালে চীন অলিম্পিক আয়োজন করেছে সফলভাবে। আশা করা যায়, একদিন চীন বিশ্বকাপ ফুটবলও আয়োজন করবে; তবে সেটার জন্য চাই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040