মানবতার নামে: চীনে অঙ্গদান ও অঙ্গ-প্রতিস্থাপন
  2018-08-08 09:00:46  cri

গত ৭ জুন ৪২ বছর বয়সী লি ইউ চিয়া মৃত্যুবরণ করেন। তবে, তার মৃত্যুর পরও তাঁর শরীরের একটি অংশ অন্য একজন মানুষের শরীরে বেঁচে আছে। তাঁর রেখে যাওয়া অঙ্গটি সেই মানুষটিকেও বাঁচিয়ে রেখেছে।

৪ বছর আগের কথা। রেনাল ব্যর্থতার রোগী লি ইউ চিয়া বেইজিংয়ের একটি হাসপাতালে একজন দাতার কাছ থেকে কিডনি গ্রহণ করেন। তিনি তখন বলেন, মৃত্যুর পর তিনিও তার অঙ্গ দান করে দিয়ে যেতে চান। তাই চলতি বছর যখন লি ইউ চিয়া মারা গেলেন, তখন তার স্বজনরা অঙ্গদান নিবন্ধন ফর্মে স্বাক্ষর করেন। ফলে মৃত্যুর পর তাঁর লিভার আন হুই প্রদেশের একজন মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়; চোখের কর্ণিয়া দেওয়া হয় অন্য দু'জন মানুষকে; এবং অগ্ন্যাশয় দেওয়া হয় একজন গুরুতর ডায়াবেটিক রোগীকে। চার জন মানুষ লি ইউ চিয়ার শরীরের অঙ্গ পেয়ে উপকৃত হন।

বর্তমানে চীনে অঙ্গ-প্রতিস্থাপনে ব্যবহৃত মানব-অঙ্গের সবই আসে স্বেচ্ছাদানের ভিত্তিতে। ২০১৭ সালে চীনে ৫১৪৬টি মানব-অঙ্গদানের ঘটনা ঘটে এবং ১৬ হাজার অঙ্গ-প্রতিস্থাপন সার্জারি করা হয়। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ অঙ্গ নেওয়া হয়েছে স্বেচ্ছায় দানকারীদের মৃত্যুর পর তাঁদের শরীর থেকে এবং বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট রোগীদের স্বজনদের দান-করা।

জীবিতদের কল্যাণে বিনামূল্যে নিজ নিজ মৃতদেহ দান করার প্রবণতা চীনের জনগণের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে। আর অঙ্গদান ও অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে চীনে আছে কার্যকর ও কঠোর নিয়মকানুন। কম্পিউটারের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী নিবন্ধিত রোগী খুঁজে পাওয়াও যায় চীনে। চীনের আইন অনুযায়ী, এই কম্পিউটার-ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে অঙ্গদান বা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। অর্থাত অঙ্গ দান করতে বা গ্রহণ করতে সরকারি এই সিস্টেমের মধ্যে থেকেই করতে হবে, অন্য কোনো উপায়ে বা পদ্ধতিতে নয়।

অঙ্গদান ও অঙ্গ-প্রতিস্থাপন কাজের ক্ষেত্রে চীনে বেশ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। তবে, এখনও বিদেশে এ-ব্যাপারে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। যেমন, বলা হয় চীনে প্রতিবছর ৬০ হাজার থেকে এক লক্ষ অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। ৭০ বছর বয়সী হুয়াং চিয়ে ফু তাঁর গোটা জীবন উত্সর্গ করেছেন চীনের অঙ্গ-প্রতিস্থাপন কাজে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে বছরে ৬০ থেকে এক লাখ অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটে। এই সবগুলো অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের ঘটনা চীনে ঘটে বলে দাবি করা হাস্যকর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৭,০৮৫ জন চীনা মানুষ মরণোত্তর দেহ দান করেন।

বিদেশে কেউ কেউ এমনও প্রচার করে থাকেন যে, চীনে জীবিত মানুষের শরীর থেকে অঙ্গ কেটে নিয়ে অন্যদের দেহে স্থাপন করা হয়। এই গুজব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গ-প্রতিস্থাপন কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, চীনে অঙ্গ-প্রতিস্থাপনসংশ্লিষ্ট কাজের স্বচ্ছতা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব-অঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে কাজ করেন এমন একজন গবেষক বলেন, "আমি নিজে চীন সফর করেছি। আমি একজন গবেষক হিসেবে বলতে পারি, চীনে মানব-অঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় হয় বলে যে অভিযোগ করা হয় তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং বিগত কয়েক বছরে, অঙ্গ-প্রতিস্থাপন বিষয়ে অর্জিত চীনের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে।" বস্তুত, ২০১৭ সালের 'মানবাধিকার প্রতিবেদনে' এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও স্বীকার করেছে যে, চীনের অঙ্গ-প্রতিস্থাপনকাজের উন্নয়ন ও সংস্কারে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

ইউন নান প্রদেশের তিয়ান ছি হ্রদের পাশে সি শান পাহাড়ের মাঝখানে ইউন নানের অঙ্গ-দানকারীদের স্মরণে পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে অঙ্গ-দানকারীদের নাম এখানে স্থাপিত একটি স্মৃতিস্তম্ভে লিখে রাখা হচ্ছে। প্রতিদিন অনেকে এই স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।

চীনের মানব-অঙ্গ দান ও প্রতিস্থাপন কমিটির সদস্য ইয়ে ছি ফা বলেন, অঙ্গ-দানের মাধ্যমে অন্য মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। মানুষ মরে গেলে তাঁর শরীরও নষ্ট হয়ে যায়। অথচ এই অঙ্গ জীবিত মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এতে জীবিত মানুষটিও উপকৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা প্রকাশিত হয়। এই প্রক্রিয়া একটি দেশের সভ্যতারও প্রতীক।

একটা সময় ছিল যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গ-প্রতিস্থাপন মহলে চীন ছিল অচ্ছুত। চীনের ক্লিনিক্যাল অঙ্গ-প্রতিস্থাপন ফলাফলকে আন্তর্জাতিক মহল স্বীকৃতি দিত না; চীনের বিশেষজ্ঞরা বিশ্ব অঙ্গ-প্রতিস্থাপন সংস্থায় যোগ দিতে পারতেন না; এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে চীনা গবেষকদের নিবন্ধও প্রকাশিত হতো না। তখনও চীন হাল ছেড়ে দেয়নি। চীন সরকার বুঝেছিল যে, দেশে একটা স্বচ্ছ মানব-অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। ২০০৭ সালে চীনে মানব-অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন জারি করা হয়; ২০১০ সালে শুরু হয় মানব-অঙ্গদান কার্যক্রম। ২০১১ সালে মানব-অঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হয়। ২০১৫ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের অঙ্গ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।

সংস্কার সহজ একটি ব্যাপার নয়। ২০১০ সালে অঙ্গদান-ব্যবস্থা চালুর পর, ওই বছর মাত্র ৩৪ জন মরণোত্তর দেহদান করেন। বিশেষজ্ঞ হুয়া চিয়ে ফু বলেন, পুরাতন একটি ব্যবস্থা ভেঙে দিতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তবে পশ্চাত্পদতার জন্য সাধারণ মানুষ দায়ী নয়, দায়ী ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা।

এ-খাতে সংস্কারের ফলে মানব-অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অনুমতিপ্রাপ্ত হাসপাতালের সংখ্যা ৬০০ থেকে কমে দাঁড়ায় ১৬৪টিতে। তা ছাড়া, ৩২টি অবৈধ এজেন্সি ও ১৪টি অবৈধ অঙ্গ-প্রতিস্থাপনকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পাশাপাশি এ-ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগও নেয় সরকার। ফলে জনগণের মধ্যে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৮ সালের ৮ জুনের একটা ঘটনা। শাংহাই থেকে উ হান যাবে একটি বিমান। ১৪৭ জন যাত্রী অপেক্ষা করছেন বিমানের টেকঅফের জন্য। কিন্তু বিমান দেরি করছে এবং দেরি করল দেড় ঘন্টা। দেরির কারণ, একজন মৃত ব্যক্তির দান-করা-হার্ট শাংহাই থেকে যাবে উ হানে অন্য একজন জীবিত ব্যক্তিকে বাঁচাতে, যার হার্ট প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। যাত্রীদের একজনও দেরির জন্য অভিযোগ করলেন না।

০১৭ সালে অঙ্গ-দান ও প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সাল নাগাদ চীন এক্ষেত্রে বিশ্বে এক নম্বর স্থানে উন্নীত হবে।

হুয়াং চিয়ে ফু বলেন, অঙ্গ-দান শুধু চিকিত্সা ও প্রযুক্তির ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে রাজনীতি, আইন প্রয়োগ ও নীতিও জড়িত। অঙ্গ-প্রতিস্থাপনকাজ ভালভাবে করতে পারে এমন দেশ অবশ্যই একটি উন্মুক্ত, সভ্য, ও আত্নবিশ্বাসী দেশ।

এবার আন্তর্জাতিক অঙ্গ-প্রতিস্থাপন সম্মেলনে বিশ্বের বৃহত্তম অঙ্গ-দানকারী দেশ স্পেনের অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপন গবেষণালয়ের পরিচালক বলেন, চীনের চলমান অঙ্গদান ও অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা বিশ্বের সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবার সম্মেলনে চীনের ১৫০ জনের বেশি অঙ্গ-প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ অংশ নিয়েছেন এবং ২০১৭ সালে চীনের উত্থাপিত প্রস্তাব অনুযায়ীই গঠিত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 'অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপন বিশেষ কমিটি।

সম্মেলনে হুয়াং চিয়ে ফু বলেন, চীনের উচিত শেখানোর পাশাপাশি নিজেও শেখা। চীন নিজের পদ্ধতি অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেবে না, বরং নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে এবং অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেও শিখবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040