১৯৯৪ সালে উৎপাদন শুরুর পর বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উত্তোলন করা হয় ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন কয়লা। আর ব্যবহার হয়েছে ১ কোটি ২১ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন। কাগজে কলমে এখনো প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ থাকার কথা। গত মাসে খনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল তাদের কাছে ১ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা মজুদ রয়েছে। কিন্তু পরে দেখা যায় কয়লা মজুদ রয়েছে মাত্র ৫ হাজার টন।
এ বিপুল পরিমাণ কয়লা লোপাটের ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চ্যল্য দেখা দেয়। কয়লা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বেশিরভাগই সরবরাহ করা হত এ কেন্দ্র থেকে। এখন এ বিশাল ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে জেলাগুলোতে।
কয়লা লোপাটের ঘটনা প্রাকাশের পর ২৩ জুলাই সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, পিডিবি এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মজুদ রাখা কয়লা কোথায় গেল তা খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন তিনি। পেট্রোবাংলাকে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশও দেন প্রধানমন্ত্রী।
পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকও তদন্ত শুরু করে কয়লা লোপাটের ঘটনার। দুদকের পরিচালক শামসুল আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ২৩ জুলাই খনি কার্যালয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দুদক কয়লা লোপাটের প্রাথমিক সত্যতা খুঁজে পায়। ২৪ জুলাই তদন্ত দল পেট্রোবাংলা ও পিডিবি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা।
এদিকে, কয়লা লোপাটের ঘটনায় পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটিও তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় ২৫ জুলাই। পেট্রোবাংলার পরিচালক কামরুজ্জামানকে প্রধান করে গঠিত কমিটির তদন্তেও কয়লা খোয়া যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী জানান, দায়িত্বে থাকা প্রত্যেকেই এ জন্য দায়ী। পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খনির অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকোশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদ, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মহাব্যবস্থাপক নূর-উজ-জামান চৌধুরী ও উপ-মহাব্যবস্থাপক এ কে এম খালেদুল ইসলামসহ ১৯ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়।
২৭ জুলাই জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। বিদ্যুৎসচিব আহমদ কায়কাউস, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ ও পিডিবির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার খালেদ মাহমুদ প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জানান, খনিতে কয়লা ঘাটতির ব্যাপারে কর্মকর্তাদের সিস্টেম লসের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করতে দ্রুত কয়লা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।
কিন্তু সেপ্টেম্বরের আগে খনিতে নতুন ফেজের কয়লা উত্তোলন শুরু করা যাবে না। সরকার তার আগেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করতে চায়। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান বিদ্যুৎ সচিব আহমাদ কায়কাউস। ২৮ জুলাই রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই এলাহী কয়লা লোপাটের ঘটনায় সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানান। বলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব নিয়েছেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়লা লোপাটের ঘটনায় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন বড়পুকুরিয় কয়লা খনির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। কয়লা লোপাটে তাদেরও দায় আছে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। আর তদন্তে শুধু সরকারি আমলাদের ওপর নির্ভর না করে কয়লা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন তারা।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।