চীনের তিব্বত উত্তর মালভূমিতে অবস্থিত না ছু শহরের নি মা জেলার রং মা উপজেলা। অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এখানে দারিদ্র্যবিমোচন একটি কঠিন কাজ।
এ-কারণে সম্প্রতি স্থানীয় পশুপালকদের হাজার কিলোমিটার দূরে তিব্বতের রাজধানী লাসায় স্থানান্তর করা হয়। পশুপালকরা সেখানে নতুন বাড়ি পেয়েছেন; শুরু করেছেন নতুন জীবন। অন্যদিকে, তাদের ফেলে-আসা গ্রাম বন্য পশুদের নতুন স্বর্গে পরিণত হয়েছে।
এই পশুপালকদের একজনের নাম রেন চেং। লাসা শহরে যাওয়ার আগে একদিন তিনি দেয়ালে রাখা চাবুক নিয়ে শেষবারের মতো ছাগপালকের কাজ করেন। পরের দিন রেন চেং ও তার পরিবার তৃণভূমি ছেড়ে লাসার নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
মাথার উপর নীল আকাশ ও সাদা মেঘ। সূর্য অস্ত যায় যায়। ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন রেন চেং। তিনি জানান, কয়েক প্রজন্ম ধরেই গরু ও ছাগল তাদের নিত্যদিনের সাথী। তিনি নিজেও পশুদের সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় ৪০ বছর। এসব পশু ও নিজের বাড়ি ছেড়ে যেতে তার মন কাঁদছে।
রেন চেংয়ের বাড়ি না ছু শহরের নিমা জেলার রং মা উপজেলার চিয়া লিং চিয়াং তুং নামের একটি গ্রামে। তার বাড়ির সামনে আছে কাং তাং হ্রদ। দূরে মা ই চির-তুষারাবৃত পর্বতমালার ছায়া হ্রদের পানিতে পড়ে। একটি ১৪ ইঞ্চি টিলিভিশন ও একটি ঘি তৈরির যন্ত্র ছাড়া তার বাড়িতে কোনো ঘরোয়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নেই। প্রতিদিন কাছাকাছি একটি নদী থেকে ৪ বারের মতো পানি নিয়ে আসতে হয় তাকে। শীতকালে নদী বরফে পরিণত হলে তাকে আরও দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। ফোন করতে বা উইচ্যাট ব্যবহার করতে চাইলে মোটর-সাইকেল চালিয়ে ৩০ কিলোমিটার দূরে উপজেলার রাজধানীতে যেতে হয়। অবশ্য চুল কাটাতে পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করেন। ৪৯ বছর বয়সী রেন চেংয়ের জন্য এমন জীবন থেকে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব স্বপ্নের মতো।
রেন চেংয়ের স্বপ্ন এবং রং মা উপজেলার অন্যান্য মানুষের স্বপ্ন অভিন্ন। এখানকার জীবনের সঙ্গে আধুনিক জীবনের রয়েছে বেশ ব্যবধান। উপজেলার প্রাথমিক স্কুলে মাত্র তিনটি শ্রেণী আছে। সাশা শহরে একটি ডিমের দাম কয়েক চিয়াও হলেও, এখানে একটি ডিম ২ ইউয়ান। সারা উপজেলায় শাকসবজির কোনো দোকান নেই। এখানকার মানুষের গড় আয়ু ৬০ বছরের চেয়ে কম।
মালভূমিতে শীত বেশি ও অক্সিজেন কম। উপজেলার একজন ক্যাডার ঠাট্টা করে বলেন, এখানকার পরিবেশ মানুষের চেয়ে বন্যপ্রাণীর জন্য বেশি উপযুক্ত। রং মা উপজেলার দুটি গ্রাম আছে। চিয়া লিং চিয়া তুং গ্রাম ও চিয়াং ছু গ্রাম। রাজধানী সাশার সঙ্গে গ্রাম দুটির ব্যবধান যথাক্রমে ১১৯৭ ও ১২৪৭ কিলোমিটার। ২৬২টি পরিবারের ১১০২ জনের মধ্যে ৮১টি পরিবারের ৩২৩ জন দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করছিলেন।
গেল জুন মাসে রেন চেং একটি জরিপপত্র হাতে পান। জরিপপত্রে 'লাশা শহরে যেতে চান কি?'--এই প্রশ্নটি ছিল। এপ্রিল মাসে তিব্বত স্বায়ত্বশাসিত এলাকা দারিদ্র্যবিমোচন পরিচালনাকেন্দ্র রং মা উপজেলাকে পরীক্ষামূলক স্থান হিসেবে বাছাই করে। লোকজনকে অন্যত্র স্থানান্তরের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন এই পরীক্ষার লক্ষ্য।
লাসা গেলে তার ছাগলগুলোর কী হবে? কীভাবে ওরা বাঁচবে?—এমন ধারা চিন্তা করে রেন চিং প্রথমে যেতে চাইছিলেন না। তখন উপজেলার ক্যাডার তার বাসায় আসেন এবং বিস্তারিতভাবে 'স্থানান্তর পরিকল্পনা' ব্যাখ্যা করেন। ক্যাডার জানান, নতুন জায়গায় বাড়ি নির্মাণে সরকার সাহায্য দেবে এবং তাদের পশুপালনের ব্যবসাও চলবে। নতুন জায়গায় শিশুরা আরও ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারবে এবং প্রবীণরা পাবেন আরও ভালো চিকিত্সা। এ-সব শুনে রেন চেং চিন্তামুক্ত হলেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করার পর লাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সকাল ১০টায় একটি বড় ট্রাক রাস্তার পাশে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রেং চেং সব জিনিস ট্রাকে তুলেছেন। তার মুখে মৃদু হাসি।
রং মা উপজেলার ৫০ কিলোমিটার উত্তরে একটি জায়গা ছিল জান তুই নামক এক ব্যক্তির গোচারণভূমি। পশুপালনের জন্য তিনি ১০ হাজার ইউয়ান ব্যয় করে ভূমির চারপাশে বেড়া তৈরি করেন। এ-চারণভূমি অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকসময় তিব্বতের এন্টিলোপসহ বিভিন্ন মুক্ত বন্যপ্রাণী আহত হতো। জান তুই-ও লাসা শহরে স্থানান্তরিত হন। তিনি বলেন, "এ-ভূমি আগেও বন্যপ্রাণীদের ছিল। এখন আমরা এ-ভূমি তাদেরকে ফিরিয়ে দিলাম।"
রং মা উপজেলা ছিয়াং থাং জাতীয় প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চলের একটি অংশ এবং বন্যপ্রাণীদের স্বর্গ। তবে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ তেমন একটা সুবিধার নয়। এই প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানুষের জীবিকার মান উন্নয়ন—এই দুটি বিষয়ের মধ্যে সরকার ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে। তিব্বত স্বায়ত্বশাসিত এলাকার ভাইস চেয়ারম্যান বাই চিয়াং বলেন, স্থানান্তরের মাধ্যমে একদিকে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা হয় এবং অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ করা হয়। আলোচ্য চারণভূমির চার পাশের বেড়া ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখন বন্যপ্রাণীরা এ-ভূমিতে অবাধে দৌড়াতে পারে। রং মা উপজেলার মানুষ এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পর ৪৬৭.৭৯ হেক্টর ভূমি মুক্ত হয়েছে।
মানুষ চলে যাবার পর ছাগল ও গরুগুলোর কী হবে? রং মা উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত হবে একটি কৃষি সমবায় এবং লোকেরা নিজেদের জমি ও পশু দিয়ে সমবায়ে অংশ নিতে পারবে। যুবকরা এখানে থেকে অব্যাহতভাবে পশুপালনের সুযোগ পাবে এবং প্রতিবছরের শেষ নাগাদ বোনাস পাবে। আলোচনার পর রেন চেং ও তার স্ত্রী ও ছেলে প্রথমে লাসা শহরে যান এবং তার মেয়ে ও জামাতা এখানে থেকে সমবায়ের আওতায় পশুপালনের জন্য থেকে যান।
২০০ কিলোমিটার দূরে নি মা জেলার স্কুল। রং মা উপজেলার ৫৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক বিশেষ বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। এসব শিক্ষার্থী পরে পরিবারের সঙ্গে লাসা শহরে যাবে। সেখানে তারা আরও ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাবে।
১৭ জুন সকাল ৬টা। সূর্য পুরোপুরি ওঠেনি। লাসার উদ্দেশ্যে বাস রওয়ানা হয়েছে। রেং চেং ও তার গ্রামের বাসিন্দারা বাসে চড়ে লাসা যাচ্ছেন। রেন চেং সাংবাদিকদের জানান, তার গুরুতর গেঁটেবাত আছে এবং আগে উপজেলা বা জেলার হাসপাতাল গেলেও রোগ ভালো হয়নি। এবার রাজধানী লাসায় তিনি ঠিকভাবে চিকিত্সা করাতে পারবেন বলে আশা করছেন।
রেন চেংয়ের স্ত্রীর ৬টি শিশু-সন্তান বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও চিকিত্সাসংক্রান্ত বিরূপ পরিস্থিতির কারণে মারা যায়। রেন চেং বলেন, লাসার চিকিত্সার মান ভাল এবং তার বাকি সন্তানরা সেখানে নিরাপদ থাকবে; স্বাস্থ্যবান হিসেবে গড়ে উঠবে।
দু'দিনে হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর, বাস পৌঁছেছে লাসা শহরের তুই লং তে ছিং এলাকার কু রং জেলার কা ছুং গ্রামে। কু রং জেলার মানুষ তাদের নতুন প্রতিবেশী ও অতিথিদের জন্য একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। তারা নাচ-গানের মাধ্যেম তাদের বরণ করে নেয়। কা ছুং গ্রাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৮০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং এটি লাসার কেন্দ্র থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
কা ছুং স্থানান্তর প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২২.৬ কোটি ইউয়ান এবং রং মা উপজেলা থেকে আসা মানুষের জন্য নতুন বাড়িঘর, কিন্ডারগার্টেন নির্মাণ করা হয়েছে; গড়ে তোলা হয়েছে নতুন গ্রাম-কমিটি।
সদস্যের সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিটি পরিবার ৮০ থেকে ১৮০ বর্গমিটার আয়তনের বাড়ি পেয়েছে। সদস্যপ্রতি বাড়ি নির্মাণে পরিবারগুলোকে ব্যয় করতে হয়েছে ১০ শতাংশ তথা ৬০০০ ইউয়ান করে।
রেন চেং ১৫০ বর্গমিটার আয়তনের একটি বড় বাসা পেয়েছেন। তার ছেলে নতুন বাড়িতে হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে। পরের দিন তার ছেলে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়। লাসায় তার নতুন একজন সন্তানও জন্মগ্রহণ করে। রেন চেং বলেন, সরকারের সাহায্যে তারা খারাপ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং নতুন জীবন শুরু করেছেন। স্থানান্তরের স্মরণে তিনি তার নতুন বাচ্চাকে বিশেষ একটি নাম দেবেন বলে ঠিক করেছেন। (শিশির/আলিম)