ডব্লিউটিও-তে যোগ দেওয়ার পর চীনের ১৭ বছর
  2018-07-11 10:34:15  cri


চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের তথ্য-কার্যালয় থেকে ২৮ জুন প্রথমবারের মতো 'চীন ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা' শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়। শ্বেতপত্রে বিগত ১৭ বছরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-তে চীনের শর্তাবলী পূরণ, বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক ব্যবস্থার পক্ষে চীনের দৃঢ় অবস্থান, বিশ্বের জন্য চীনের অবদান, এবং নিজেকে বিশ্বের জন্য আরও উন্মুক্ত করার আগ্রহ ও ইচ্ছা তুলে ধরা হয়।

২০১০ সালের অগাস্টে ডব্লিউটিও-তে যোগ দেওয়ার পর থেকেই চীন পণ্য-বাণিজ্য, সেবা-বাণিজ্য ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করে এসেছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার পর বিগত ১৭ বছরে চীন বিশ্বের বৃহত্তম রফতানিকারক ও দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। এই ১৭ বছরে চীন নিজেকে আরও উন্মুক্ত করেছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

২০০২ সালের পর বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে চীনের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ ছিল এবং এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। চীন বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

আজকের 'পুবের জানালা' আসরে আমরা গত ১৭ বছরে ডব্লিউটিও-র কাঠামোতে চীনের সাফল্য ও অবদান তুলে ধরছি।

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন

পয়লা জুলাই থেকে চীনের ভোক্তারা আমদানিকৃত গাড়ি কিনতে পারছেন আগের চেয়ের কম শুল্ক দিয়ে। আগে যেখানে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ করে। আগে গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের ওপর শুল্কের হার ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ৮ শতাংশ, ১৫ শতাংশ, ২০ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ করে। এখন সবক্ষেত্রে শুল্কের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬ শতাংশে। ডব্লিউটিও-তে যোগ দেওয়ার সময় চীন আমদানিশুল্ক কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। গাড়ির ওপর শুল্ক কমানো সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ। চীনের আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ডব্লিউটিও গবেষণালয়ের পরিচালক থু সিন ছুয়ান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ডব্লিউটিওর সদস্য হবার পর চীন সার্বিকভাবে শুল্ক কমানোর প্রতিশ্রুতি পালন করে আসছে এবং একটি সুষ্ঠু শুল্ক-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

আসলে ২০১০ সালেই চীন আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্কের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু করে। তখন শুল্কের হার ২০০১ সালের ১৫.৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯.৮ শতাংশ করা হয়।

শুল্ক কমানো ছাড়া, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চীন নিজেকে আরও অধিক উন্মুক্ত করতে থাকে। সেবা-বাণিজ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর থেকে বিধিনিষেধ ধাপে ধাপে শিথিল হতে থাকে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বোয়াও এশিয়া ফোরামে চীন উন্মুক্তকরণের ধারাবাহিক উদ্যোগের কথা ঘোষণা করে। স্টক, ব্যাকিং, আর্থিক সিকিউরিটিজ ও বীমা শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের অনুপাত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

ডব্লিউটিও-তে যোগ দেওয়ার পর চীন মেধাস্বত্ব রক্ষা আইন প্রণয়ন সম্পূর্ণ করে এবং চলতি বছর প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ব্যুরো। চীন এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ মেধাস্বত্ব আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং ২৩টি দেশ ও অঞ্চলের মেধাস্বত্ব পরীক্ষা সংস্থার সঙ্গে The Patent Prosecution Highway বা 'পিপিএইচ' চুক্তি স্বাক্ষর করে।

চীনা একাডেমি অফ সোসাল সায়েন্সের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতি গবেষণালয়ের গবেষক সুং হং বলেন, চীন শুধু সার্বিকভাবে নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে তা নয়, নিজেকে প্রতিশ্রুতির আওতার বাইরে গিয়েও আরও উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

নিজের উন্নয়ন, বিশ্বের কল্যাণ

চলতি বছরের গ্রীষ্মকালে, বিশ্বের কয়েক ডজন বহুজাতিক কোম্পানির সিইওরা বেইজিংয়ে বিশেষ গোলটেবিল শীর্ষ-সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তারা 'এক অঞ্চল, এক পথ', উদ্ভাবন ও স্মার্ট নির্মাণ, সবুজ উন্নয়ন ও বিশ্বপ্রশাসনসহ নানা বিষয় নিয়ে নিজ নিজ মন্তব্য প্রকাশ করেন।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী শিল্পপতিরা বলেন, গেল ৪০ বছরে চীনের সংস্কার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এবং চীনের উন্নয়ন থেকে উপকৃত হয়েছে। চীনের অর্থনীতির সঙ্গে কোম্পানিগুলোও বড় হতে চায়।

জার্মানির বিখ্যাত কোম্পানি সিমেন্স চলতি মার্চ মাসে বেইজিংয়ে প্রতিষ্ঠা করে 'বিশ্ব এক অঞ্চল এক পথ অফিস'। সিমেন্স বৈশ্বিক কর্মব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে এ-অফিস স্থাপন করে, 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি-কৌশলকে সার্বিক সমর্থন দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে।

পরিসংখ্যান অনুসারে, 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব উত্থাপিত হবার পর, বিশ্বের ৮০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা চীনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চীনের সঙ্গে 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যাতে কয়েক লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

চীনের জাতীয় তথ্যকেন্দ্রের অর্থনীতি পূর্বাভাস বিভাগের পরিচালক নিউ লি জানান, আরও উন্মুক্ত চীন বিশ্বের জন্য আরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে। আগামী ৫ বছরে চীন ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করবে এবং ৬০০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। তা ছাড়া, এসময়কালে চীন বিদেশে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং বিদেশে চীনা পর্যটকের সংখ্যা ৭০ কোটিতে পৌঁছাবে।

বিশ্বব্যাংকের সিইও ক্রিস্টেলিনা ইভানোভা জর্জিভা-কিনোভা মনে করেন, বিশ্বে চীন বড় একটি অবদান রেখেছে দারিদ্র্যবিমোচন খাতে। সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালুর পর, বিশেষ করে ডব্লিউটিও-তে যোগ দেওয়ার পর, চীনের অর্থনীতি দ্রুত উন্নত হয় এবং দেশটিতে ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়। ইতিহাসে এমন সাফল্য আগে কখনই অর্জিত হয়নি। বিশ্বের উন্নয়নে এ-অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চীন আরও উন্মুক্ত হবে; নিজের দরজা বন্ধ করবে না

বর্তমানে বিশ্বের মূল প্রবণতা হচ্ছে শান্তি, সহযোগিতা, উন্মুক্তকরণ, সংস্কার ও উদ্ভাবন। পাশাপাশি, উন্নয়নের চালিকাশক্তির অভাব, বিশ্ব অর্থনীতি প্রশাসনে অনগ্রসরতা, বিশ্বের ভারসাম্যহীন উন্নয়ন—ইত্যাদি সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। বিশ্বায়নের বিরোধিতা ও বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদ বিশ্বের অর্থনীতিতে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক রবার্তো আজেভেদো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব দেখা দিলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ থেকে বিচ্যুত হবে।

নিজেকে আরও উন্মুক্ত করার চীনা সিদ্ধান্ত

গত ৪০ বছরে চীন বহির্বিশ্বের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত করেছে। ভবিষ্যতে নিজেকে আরও উন্মুক্ত করতে চীন নিজ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনে এমন একটি কথা প্রচলিত আছে: "একা একা চললে দ্রুত এগোনো যায়; তবে সবার সঙ্গে চললে বেশিদূর যাওয়া যায়।" চীনের উন্মুক্তকরণের সিদ্ধান্ত বিশ্বেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

চীন-মার্কিন সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশই চীনকে বিশ্বের প্রথম তিনটি বিনিয়োগবান্ধব দেশের একটি মনে করে। বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ কোম্পানি ২০১৮ সালে চীনে তাদের বিনিয়োগ ১০ শতাংশ বা তারচেয়ে বেশি বাড়াবে বলেও জরিপে উঠে এসেছে। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ানের নানা প্রতিবেদনেও বিদেশি কোম্পানিগুলোর চীনের ওপর আস্থার কথা বলা হয়েছে।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একাডেমির বিশ্ব অর্থনীতি গবেষণালয়ের পরিচালক লিয়াং ইয়ান ফেন বলেন, অর্থনীতির বিশ্বায়ন অপরিবর্তনীয় প্রবণতা এবং চীনের উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া সামনে এগিয়ে যাবে। নতুন যুগের সূচনাস্থলে দাঁড়িয়ে চীন সার্বিকভাবে উন্মুক্ত একটি ক্ষেত্র তৈরি করবে এবং অর্থনীতির বিশ্বায়নকে আরও উন্মুক্ত, সহনশীল, বৈষম্যমুক্ত, ও সকলের জন্য কল্যাণকর করতে ভূমিকা পালন করে যাবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040