0706ht.mp3
|
চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণনীতি 'লিয়াংচিয়াহ্য'র অধিবাসীদের জীবনে বয়ে এনেছে সুখ ও সমৃদ্ধি
লিউ রুই লিয়ান এমন একটি কন্যা শিশু, যার জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ। সে ও তার ছোট ভাইবোনরা গ্রীষ্মকালে কখনো জুতা পরতে পারতো না। রাতে চার শিশু কেবলমাত্র একটি লেপে শুয়ে থাকতো। এমনকি, সাদা পাউরুটি খাওয়া তার পরিবারের জন্য ছিলো এক বিলাসী ব্যাপার।
এরপর ১৭ বছর বয়সে লিউ রুই লিয়ান একই গ্রামের কুং চেং ফু'কে বিয়ে করেন। বিয়ের পরও তাদের আর্থিক অবস্থা ছিলো অনেক খারাপ।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র লিয়াংচিয়াহ্য কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পর, সি চিন পিংয়ের উদ্যোগে লোহা সংস্থা, এজেন্সি দোকান ও সেলাই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেলাই সংস্থায় তিনজন নারীকে নির্বাচন করা হয়। এতে নির্বাচিত হওয়ায় অনেক আনন্দ প্রকাশ করেন লিউ রুই লিয়ান। সারা রাত জেগে আনন্দ প্রকাশ করেন তিনি।
সেলাই সংস্থায় তৈরি পণ্যের সংখ্যা ও গুণগত মানের ভিত্তিতে টাকা বিতরণ করা হয়। অর্থাত্ যত বেশি পণ্য তৈরি করবে, ততবেশি টাকা পাবে। এই অবস্থা দেখে লিউ রুই লিয়ান দম্পতি টাকা ঋণ করে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। বেশি বেশি পণ্য তৈরি করার জন্য তাঁরা অনেক সময় তাড়াহুড়া করে খাবার খেতেন। এমন কি, হাতের কাজ বাসায় নিয়ে রাতেও তাঁরা এ কাজ করতেন।
১৯৮৪ সালের বসন্তকালে 'প্রতিটি পরিবারের জন্য কোটা নির্ধারণ' নীতি প্রথমবারের মতো শোনেন লিউ রুই লিয়ান। তখন তিনি স্পষ্টভাবে এই নীতি উপলব্ধি করতে পারতেন না। তিনি জানতেন না যে, চীনের গ্রামের ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
(রে)
অনেক কৃষকের মতো নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে লিউ রুই লিয়ানের পরিবারে সুখ চলে আসে। খাদ্যশস্যের সমস্যা সমাধান করা হয়, তবে পুরোপুরি টাকার অভাব দূর হয় না। অনেকেই গ্রামের বাইরে কাজ করতেন। তাদের অবস্থা দেখে লিউ রুই লিয়ানও বাইরে কাজ করার পরিকল্পনা করেন। কৃষি কাজ সম্পন্ন করার পর তিনি ও তাঁর স্বামী শহরে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। এভাবে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ ভালোর পথে এগিয়ে যায়। তাদেরকে 'লিয়াংচিয়াহ্য' গ্রামের 'প্রথম প্রজন্মের গ্রামীণ শ্রমিক' বলে অভিহিত করা হয়।
সংস্কারের কারণে গ্রামের অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। আর উন্মুক্তকরণনীতি এই পরিবর্তনে সীমাহীন সম্ভাবনাও প্রদান করে।
১৯৯৩ সালে সিপিসি'র ফু চৌ পৌর কমিটির সম্পাদক সি চিন পিং লিয়াংচিয়াহ্য'তে ফিরে আসেন। তিনি অধিবাসীদের অবস্থা দেখে অনেক খুশি হন। কারণ তখন অধিবাসীদের কারো থাকা-খাওয়ার সমস্যা ছিলো না। 'ক্ষুধামুক্ত' ছিল সি চিন পিংসহ সকল অধিবাসীর স্বপ্ন। তাই প্রতিটি পরিবারের অতিরিক্ত খাদ্যশস্য দেখে সি চিন পিং ভীষণ আনন্দ প্রকাশ করেন।
১৯৯৯ সাল হচ্ছে ইয়ানআন শহরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। দেশের 'কৃষি জমির পরিবর্তনে বনাঞ্চল গড়ে তোলা' শীর্ষক নীতির কল্যাণে ইয়ানআনে অনেক কৃষি জমি পরিবর্তিত হয়। গোটা শহরে শুরু হয় এক 'সবুজ' বিপ্লব।
(রে)
১৯৯৯ সাল থেকে 'কৃষি জমির পরিবর্তনে বনাঞ্চল গড়ে তোলা' শীর্ষক নীতির কল্যাণে ৬৬০ লাখ হেক্টর জমি পরিবর্তিত হয়। ইয়ানআনে জমির বিশাল পরিবর্তন ঘটে।
২০০৭ সালের ২৮ অগাস্ট গ্রামের অধিবাসীদেরকে চিঠির জবাব দেওয়ার সময় সি চিন পিং বলেন, 'আমি শুনেছি, লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের পর্বত এখন আগের চেয়ে অনেক সবুজ এবং পানি আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার'। এই ব্যাপারে ভীষণ আনন্দিত তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন, সিপিসি'র নেতৃত্বে গ্রামীণ অধিবাসীদের যৌথ প্রচেষ্টায় সকলের সুখী ও সচ্ছল জীবন নিশ্চিত হবে।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে ইয়ানআন শহরে ভয়াবহ বৃষ্টিপাত হয়। এটি ১৯৪৫ সালে লিখিত রেকর্ড থেকে সবচেয়ে দীর্ঘ এবং প্রবল ঝড়-জলোচ্ছ্বাস। ইয়ানআন শহরের ১৩টি জেলার ১৫ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। সরাসরি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১২০০ কোটি ইউয়ানেরও বেশি। এই ভয়াবহ দুর্যোগে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের ৮০ শতাংশ গুহা বাড়ি বিভিন্ন মাত্রায় নষ্ট হয়। কিছুটা ভেঙে যায়।
দুর্যোগত্তর পুনর্গঠনকাজ চালুর সময় বাড়িঘর হস্তান্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার। লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের শতাধিক পরিবারের সদস্য পর্যায়ক্রমে জেলা ও শহরে বসবাস করা শুরু করেন। সকল উপযোগী ছেলেমেয়েরাও 'ওয়েই আন ই' জেলায় লেখাপড়ার সুযোগ পায়। 'লিয়াংচিয়াহ্য'র অতীতের ভাবমূর্তি পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। পুনর্গঠনের পর লিয়াংচিয়াহ্য হয়ে ওঠে সিপিসি'র সদস্যদের শিক্ষাকেন্দ্র, যুব শিক্ষাদান কেন্দ্র এবং সুন্দর গ্রামের দৃষ্টান্তমূলক এক কেন্দ্র।
২০১৪ সালের জানুয়ারি সিপিসি'র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিংয়ের কাছে চিঠি লিখেন লিয়াংচিয়াহ্য গ্রাম কমিটি। চিঠিতে গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং দুর্যোগত্তর পুনর্গঠনকাজ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। একই বছরের ৫ মে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামবাসীর কাছে চিঠির জবাব পাঠান চীনা প্রেসিডেন্ট সি।
চিঠিতে তিনি বলেন, 'গেল বছরের গ্রীষ্মকালে ইয়ানছুয়ানে ভয়াবহ বৃষ্টিপাত হয়। আমি সবসময় গ্রামের অধিবাসীদের নিয়ে চিন্তা করি। সিপিসি ও চীন সরকারের নেতৃত্বে পুনর্গঠনকাজ সার্বিকভাবে চালু হয়। ফলে গ্রামীণ অধিবাসীদের আয় আগের চেয়ে আরও বেড়েছে, এতে আমি অনেক আনন্দিত। এ বছর গ্রামে আবারও উন্নয়ন কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি, সকল অধিবাসীর জীবনযাপনের মান আরও বাড়বে এবং গ্রামকে আরো সুন্দরভাবে গড়ে তোলা হবে।'
অধিবাসী লিউ চিন লিয়ান বলেন, কেউ অসুস্থ হলে তাকে নিশ্চয়ই হাসপাতালে যেতে হবে। ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে তার বাহুতে অপারেশন হয়। নতুন আকারের গ্রামীণ সহযোগিতামূলক চিকিত্সা ব্যবস্থা তার জন্য ৮ হাজারেরও বেশি ইউয়ান খরচ করে। এই সহযোগিতামূলক চিকিত্সা ব্যবস্থা ছাড়াও লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের অধিবাসীরা পেনশন বিমা লাভ করেন। ৬০ বছরের বেশি বয়স্করা প্রত্যেক মাসে বিভিন্ন মাত্রায় ভর্তুকি নিতে পারেন।
সচ্ছল লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের অধিবাসীরা শিশুদের শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গ্রামের অনেকেই ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
বর্তমানে লিউ চিন লিয়ান লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের সাংস্কৃতিক ও পর্যটন উন্নয়ন লিমিটেড কোম্পানির একজন পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। মাসিক বেতন ১২০০ ইউয়ান। এ ছাড়া, তিনি নিজের বাসার উদ্যানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করেন।
তখনকার সেলাই সংস্থার কর্মী লিউ রুই লিয়ান এখন হয়েছেন একজন গাইড। তাঁর ছেলের উদ্যোগে ১ লাখ ৫০ হাজার ইউয়ানের এক গ্রামীণ খামার বাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে আসা পর্যটকদের গাইডের দায়িত্ব পালন করেন লিউ রুই লিয়ান।
২০১৭ সালে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামীণ অধিবাসীদের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৮২৬ ইউয়ান, যা ২০১৬ সালের তুলনায় ১৫.৭ শতাংশ বেশি।
লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ও পর্যটন উন্নয়ন লিমিটেড কোম্পানি, পশুপাখি লালন-পালন বিশেষ সহযোগিতামূলক সংস্থা ও আপেল চাষ বিশেষ সহযোগিতামূলক সংস্থাসহ বিভিন্ন কমিউনিটি সম্মিলিতভাবে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামকে এক নতুন আকারের উন্নয়ন পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর, লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের অধিবাসীরা মিলিত হয়েছেন সিপিসি'র লিয়াংচিয়াহ্য কমিটির গ্রুপে। সবাই সিপিসি'র ঊনবিংশ জাতীয় কংগ্রেস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের প্রত্যাশা করছেন।
বেইজিংয়ে গণমহাভবনে হাততালি অব্যাহত রয়েছে। সিপিসি'র লিয়াংচিয়াহ্য কমিটির গ্রুপেও চলছে বিরামহীন হাততালি।
সিপিসি'র সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের রিপোর্ট শোনার পর, অধিবাসীরা প্রেসিডেন্ট সি'র প্রতিটি শব্দ গভীরভাবে মনে অনুভব করেন। এ নিয়ে তারা তুমুল আলোচনা করেন এবং আরও সুন্দর ভবিষ্যতে গঠনে আস্থাবান হয়ে ওঠেন।
লিয়াংচিয়াহ্য চীনের একটি খুব স্বাভাবিক ছোট্ট গ্রাম। একসময় এটি ছিল স্বপ্ন তৈরির জায়গা। এখন এটি হয়েছে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার জায়গা।
(রে)
কিশোর সি চিন পিংয়ের সাত বছরের লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের জীবনযাপন পর্যালোচনা এবং গ্রামটির অতীত ও বর্তমান তুলনা করে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই ছোট্ট গ্রামের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের জন্য একজন নেতার জীবনের শুরুর দিকের মানসিক অবস্থা কখনো ভুলে যাবার নয়। এখানে সি চিন পিংয়ের মনোযোগ দিয়ে কাজ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তুলে ধরা হয়। অব্যাহতভাবে সামনে এগিয়ে যেতে সকল যুবক এবং সিপিসি'র সকল সদস্যদের উত্সাহ দেয় এই শুরুর দিকের মানসিক অবস্থা।
মহা যুগে মহা স্বপ্ন
বর্তমানে লিয়াংচিয়াহ্য গ্রাম নতুন যুগান্তকারী বাতাসের মুখে নতুন যাত্রা সূচনা করেছে। একে 'দু'টি শতবছরের লক্ষ্য' বাস্তবায়নের জন্য আরও যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। (ওয়াং হাইমান/টুটুল)