'লিয়াংচিয়াহ্য'-৫
  2018-07-05 09:01:10  cri

 


'গত শতাব্দীর ৬০'র দশকের শেষ দিকে, তখন আমি একজন কিশোর। বেইজিং থেকে চীনের শা'ন সি প্রদেশের ইয়ান আন শহরের 'লিয়াংচিয়াহ্য' গ্রামে গিয়ে কৃষক হিসেবে সাত বছর কাজ করি।' হ্যাঁ, এটি 'লিয়াং চিয়া হ্য' সম্পর্কে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র সাধারণ সম্পাদক ও দেশের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কথা। তিনি ঐ গ্রামটিকে স্মরণ করে এ কথা বলেন। এর মধ্য দিয়ে মহান নেতার জীবনের শুরুর দিকের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করা যায়। সেই সঙ্গে কাজ এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যে আস্থার প্রয়োজন সে ব্যাপারে সকলকে উত্সাহও প্রদান করে এই গল্পটি।

এখন শুনবেন 'লিয়াংচিয়াহ্য'-র পঞ্চম পর্ব।

যিনি গুহা ঘরের বাইরে গায়ে এলোমেলো কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর নাম উ হুই। তিনি বয়সে সি চিন পিংয়ের চেয়ে এক বছরের ছোট। ঐ সময় উ হুই ছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তাঁর বয়স ছিলো ১৪। হ্যাঁ, তখন সি চিন পিংয়ের মতো গ্রামে কাজ করা কিশোররা এই ধরনের গুহা বাড়িতে বাস করতেন।

শীতকালে গুহা ঘর যেন বরফের মতো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে উঠতো। কিশোররা বাইরে দাঁড়িয়ে উ হুইকে জিজ্ঞাস করেন, 'ঘর গরম করার ব্যবস্থা কি নিতে পারেন?' 'হ্যাঁ, অবশ্যই'। উ হুই বলেন।

এভাবেই কিশোরদের সঙ্গে উ হুই'র বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক ভাষা বোঝার সমস্যা হলে সবাই উ হুই'র সহায়তা নেন। 'অনুবাদকের ভূমিকার' কারণে উ হুই আরও বেশি আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। কিশোরদের সঙ্গে আড্ডা ছাড়াও উ হুইকে আরো বেশি আকৃষ্ট করে তাদের 'ঘরের' গ্রন্থ।

(রে)

ঋণ হিসেবে উ হুই প্রথম বই পড়ার সুযোগ পান সি চিন পিংয়ের কাছ থেকে। বইয়ের নাম 'হান্ড্রেড থাউজেন্ডস হোয়াই'। এই বই উ হুই'র জীবনে বিশ্বকে জানার জানালা খুলে দেয়। তিনি খুব মনোযোগ এবং অনেক আগ্রহ নিয়ে এ বইটি পড়েন।

এই বই পড়ে শেষ করার পর, সি চিন পিংয়ের কাছ থেকে আবারও 'তিন রাজ্যের কাহিনী', 'মা' ও 'নিখুঁত নদী' সহ অনেক বই ঋণ নেন উ হুই। এর মাধ্যমে সি চিন পিংয়ের সংযম ও বাস্তবতা উপলব্ধি করেন তিনি।

সি চিন পিংয়ের প্রভাবে জ্ঞানের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন উ হুই।

১৯৭৩ সালে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন উ হুই। ইয়ান আন নর্ম্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন উ হুই। পারিবারিক কারণে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাখ্যাত হন সি চিন পিং। 'লিয়াং চিয়া হ্য' গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সময় উ হুইকে ৫০০ গ্রামের খাদ্যের টিকিট দেন সি চিন পিং। আরেক কিশোর ওয়াং ইয়ান শেং, তিনি লিয়াংচিয়াহ্য থেকে চলে যাওয়ার সময় সি চিন পিংকে নীল রংয়ের উলজাতীয় ওভারকোট দেন, সেটি আবার উ হুইকে দেন সি চিন পিং। তিনি উ হুইকে বলেন, 'এই ওভারকোট বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে পারবেন, আবার রাতে লেপ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন'।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে উ হুই পর্যায়ক্রমে 'ইয়ান ছুয়ান' জেলার শিক্ষাদান কার্যালয়, 'ইয়ু চু' মাধ্যমিক বিদ্যালয়, 'ইয়ুং ফিং' জেলার শিক্ষা কমিটি ও 'ইয়ুং ফিং' মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ইউনিটে কাজ করেন। তিনি শিক্ষাদান খাতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন এবং স্থানীয় শিক্ষা উন্নয়নে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাহায্যে স্থানীয় 'ইয়ু চু' ও 'ইয়ুং ফিং' মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিশাল পরিবর্তন ঘটে। ফলে বিদ্যালয় দুটি স্থানীয় সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শীর্ষস্থান দখল করে।

২০১৪ সালে অবসর নেওয়ার আগে উ হুই আবারও বিদ্যালয়ে আসেন। তিনি ক্যাম্পাসের চার দিকে ঘুরে বেড়ান। তিনি বলেন, 'মানুষের সারাজীবন এভাবেই কাটানো উচিত, "যখন আপনি জীবনের পিছনে ফিরে তাকাবেন, তখন যেন অতীতের কোনো সময় নষ্ট করার জন্য আপনাকে দু:খ করতে না হয়"। উ হুই মনে করেন, তিনি জীবনের তাত্পর্য বৃথা হতে দেননি।

১৯৭৫ সালে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার সুযোগ পান সি চিন পিং। তাঁর বাবা সি চুং সুন কারখানা থেকে এক পরিচয়পত্র পাঠান। এই পরিচয়পত্রের মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যা সমাধান করা হয়। অবশেষে সি চিন পিং ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কয়েকদিন পরও সি চিন পিং 'লিয়ান চিয়া হ্য' গ্রামে কাজে ব্যস্ত। তাঁর পরিবর্তে সিপিসি'র 'লিয়ান চিয়া হ্য' গ্রামে সম্পাদকের দায়িত্ব কে বহন করবেন, সেটি নিয়ে অনেক চিন্তা করেন তিনি।

'লিয়ান চিয়া হ্য' গ্রামের সিপিসি'র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পর, সি চিন পিং শি ছুন ইয়াংকে গ্রুপের সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। নিঃসন্দেহে শি ছুন ইয়াং হচ্ছেন সি চিন পিংয়ের মনের বাছাই। কয়েকদিন পর, গ্রামের সকল সদস্যদের বৈঠক হয়। বৈঠকে সি চিন পিং বলেন, 'আমার যাওয়ার সময় আসন্ন। পরবর্তী দফার সম্পাদক কে হতে পারেন, তা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে। আমি সুপারিশ করি শি ছুন ইয়াংকে। অবশেষে সবাই শি ছুন ইয়াংয়ের নাম লিখেন। এ সম্পর্কে শি ছুন ইয়াং বলেন, 'এই ফলাফল প্রকৃতপক্ষে আমি কত ভাল তার সঙ্গে জড়িত নয়, ‌এটি সি চিন পিং'র প্রতি সবার বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আমাকে সুপারিশ করেছেন, তাই, সবাই আমাকে নির্বাচন করেছেন'।

একটি ব্যাপার শি ছুন ইয়াংয়ের মনে গভীর ছাপ ফেলে এবং কখনই তা ভুলতে পারেন না।

একবার গ্রামে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হবে। কিভাবে বিতরণ করা হবে তা নিয়ে অনেকের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়। তখন সকলের জীবনযাপনের অবস্থা এমন ভাল ছিলো না। সুতরাং, সি চিন পিং প্রস্তাব করেন, 'এখন আমরা বিভিন্ন পরিবারে গিয়ে বাস্তব অবস্থা দেখবো, প্রতিটি পরিবারে অবস্থা দেখে আমরা বিতরণ করবো, তখন সব সহজ হয়ে যাবে'।

এভাবেই রাত ১০টা থেকে দ্বিতীয় দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত, সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে বিতরণকারীদল প্রতিটি পরিবারের বাস্তব অবস্থান সম্পর্কে জানেন। যাদের পরিবারে খাদ্যশস্য কম, তাদের জন্য বেশি বরাদ্দ করা হয়। বাস্তব অবস্থা জানার পর সবাই এই বিতরণের উপায় গ্রহণ করেন।

এই ব্যাপারটি শি ছুন ইয়াংয়ের মনে গভীর ছাপ ফেলে। তিনি বলেন, 'এতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করার পদ্ধতি কাউকে সুবিধাবাদী হওয়ার সুযোগ দেবে না। প্রত্যেকের মধ্যে স্বার্থপরতা আছে, তবে কাজ বিতরণের সময় আপনাকে সমান হতে হবে। না হলে কেউ আপনাকে বিশ্বাস করবে না। একটি বোতলের পানি সমভাবে বণ্টন করা অর্থাত্ বৈষম্যহীনভাবে সবার সঙ্গে আচরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য'।

১৯৭৫ সালের ৭ অক্টোবর সি চিন পিং 'লিয়াং চিয়া হ্য' গ্রাম ছেড়ে আসেন। এদিন ভোরে তিনি গুহা বাড়ির বাইরে চলে আসার সময় উদ্যান, রাস্তা, থেকে শুরু করে সবখানে গ্রামবাসীরা দাঁড়িয়ে পড়েন। অনেকেই লাল বড়ুই ও চাল হাতে রেখে সি চিন পিংকে বিদায় জানান। এ অবস্থা দেখে পানিতে ভেসে যায় সি চিন পিংয়ের দু'চোখ।

এদিন গ্রামের সব কৃষক কাজ বন্ধ রেখে লাইনে দাঁড়িয়ে সি চিন পিংকে বিদায় জানান।

বহু বছর পর, 'লিয়াং চিয়া হ্য'কে শান্তভাবে স্মরণ করেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তিনি মনে করেন, 'লিয়াং চিয়া হ্য' হচ্ছে তাঁর জীবনের এক সন্ধিক্ষণ। তিনি বলেন, 'জনগণের সঙ্গে কাজ করে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। লিয়াং চিয়া হ্য গ্রামের জীবন আমার অটল ধারণা লালন-পালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য আমাকে ওই গ্রাম ত্যাগ করতে হয়, তবে আমার মন পড়ে থাকতো ওখানে, সবার কাছে'।

সি চিন পিং 'লিয়াং চিয়া হ্য' থেকে চলে আসার পর একটি বোতলের পানি সমভাবে বণ্টনের ধারণা কখনো ভুলে যাননি শি ছুন ইয়াং। তিনি আবিষ্কার করেন, ত্রাণসংকটের দশকে এই ধারণা ন্যায্যতার ওপর গুরুত্বারোপ করে। অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নের দশকে এই ধারণা বেশি 'পানিকে' গুরুত্বারোপ করে। তাহলে কীভাবে বোতলে বেশি 'পানি' রাখা সম্ভব? স্থানীয় অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মসূচি অনুযায়ী, 'লিয়াং চিয়া হ্য' গ্রামে আপেল উত্পাদন এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেন তিনি।

(রে)

২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি 'লিয়াং চিয়া হ্য' গ্রামে ফিরে অধিবাসীদের খোঁজ নেন সি চিন পিং। তিনি আপেল পার্ক পরিদর্শন করেন। এ সময় শি ছুন ইয়াং সঙ্গে ছিলেন এবং বিস্তারিত পরিস্থিতি সি'কে জানান।

শি ছুন ইয়াং বলেন, ০.০৬ হেক্টর আপেল গাছে ওষুধ ও রাসায়নিক উপাদানে এক হাজার ইউয়ান ব্যয় যথেষ্ট। ৫ বছর পর আপেল ফল পাওয়া যায়। এভাবেই প্রতিবছর কয়েক হাজার ইউয়ান উপার্জন করা সম্ভব। প্রচুর ফলন হলে বার্ষিক আয় হবে ২০ হাজার ইউয়ান। শি ছুন ইয়াংয়ের কাছ থেকে এ খবর জানার পর সি চিন পিং হাসিমুখে বলেন 'অধিবাসীদের জন্য টাকা উপার্জনের পথ অনুসন্ধান করেছো তুমি'। এই বোতলের 'পানিও' অধিক থেকে অধিকতর বেশি হয়েছে।

২০১৪ সালের পর থেকে 'লিয়াং চিয়া হ্য' গ্রামে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক ও পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছে স্থানীয় সরকার। ২০১৫ সালের ১ মে গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ও পর্যটন উন্নয়ন লিমিটেড কোম্পানি গড়ে তোলা হয়। কোম্পানির সুসংহত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য বিশেষভাবে সংশ্লিষ্টদেরকে আমন্ত্রণ জানান শি ছুন ইয়াং। সেই সঙ্গে, গ্রামবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়। গ্রামবাসীরা এই কোম্পানির কর্মীতে পরিণত হন। ৬০ শতাংশেরও বেশি গ্রামবাসী কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।

যুগান্তকারী উন্নয়ন আরও চলছে। একটি বোতলের পানি সমভাবে বণ্টন অর্থাত্ বৈষম্যহীনভাবে সবার সঙ্গে আচরণ করার গল্প কখনো শেষ হবে না।

(ওয়াং হাইমান/টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040