মরুভূমি ও তিন প্রজন্মের মানুষ
  2018-07-04 11:18:09  cri



মরুভূমিকে ফুলের বাগানে পরিণত করা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু চীনে ৩৭ বছরের প্রচেষ্টায় এই স্বপ্নের মতো কাজটি করেছেন একদল লোক। তিন প্রজন্ম ধরে তাঁরা এ-কাজ করছেন। তাঁরা এই ৩৭ বছরে মরুভূমির সাড়ে তিন লাখ মু এলাকাজুড়ে প্রায় তিন কোটি গাছ লাগিয়েছেন।

কান সু প্রদেশের কু লাং জেলা থেংকেলি মরুভূমির সীমান্তে অবস্থিত। এই জেলা জাতীয় মরুকরণ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোর অন্যতম। জেলায় মরুভূমিতে পরিণত হওয়া জমির পরিমাণ ২৩৯৮ হাজার মু। এখানে ১৩২ কিলোমিটার পর্যন্ত বালি আছে। পা পু সে এই জেলার বৃহত্তম বালিঝড়-অঞ্চল এবং গত শতাব্দীর ৭০ ও ৮০-র দশকেও এখানে বালিঝড়ের কারণে কোনো ফসল জন্মাতো না। তবে তীব্র বালিঝড় একদল মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

১৯৮১ সালে কু লাং জেলায় চালু হয় মরুকরণ প্রতিরোধ-ব্যবস্থা। কুও চাও মিং, হ্য ফা লিন, সি মান, লুও ইউয়ান খুই, ছেং হাই এবং ছাং রুন ইউয়ান নামক ছয় জন পঞ্চাশ বছর বয়সী পুরুষ একটি চুক্তিনামায় লাল কালিতে আঙুলের ছাপ দিয়ে পা পু সে বন-খামার ঠিকা নেন।

প্রথম বছরে তাঁরা ১০ হাজার মু গাছ রোপন করেন। তবে পরবর্তী বসন্তকাল পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ গাছ বেঁচে ছিল। বন-খামার নেতা সি মান ও তার ৫ সঙ্গি বন পরিদর্শন করে দেখেন বালিঝড়ে ছোট একটি বন টিকে আছে; এমনকি সেখানে ফুল পর্যন্ত ফুটেছে। হলুদ, বেগুনি, লাল, সাদা—নানা রঙের ফুল দেখে তাঁরা অবাক হয়ে যান। ছয় জনের কাছে সে-দৃশ্য ছিল স্বপ্নের মতো। ফুল স্বপ্নের প্রতীক। ফুল দেখে তাদের মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, তাদের পক্ষে এই মরুভূমিতে বন সৃষ্টি করা সম্ভব। ছয় জন বালির উপর একটি অস্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করলেন। ছাং রুন ইউয়ান জানান, বহুবার এমন হয়েছে যে, ঝড়ো বাতাসে তাদের বাড়ির চাল উড়ে গেছে এবং তারা ছয় জন গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে শীত কাটানোর চেষ্টা করেছেন। ১৯৮৩ সালে জেলার বন বিভাগের সহায়তায় তারা তিনটি মজবুত ঘর নির্মাণ করেন।

মরুভূমিতে গাছ রোপন করার পর সেগুলো বাতাসে নষ্ট হওয়া, আবার রোপন করা এবং আবার বাতাসে নষ্ট হওয়া—এভাবে চলেছে ৫ থেকে ৬ বছর। একসময় তারা বুঝতে পারলেন যে, গাছের চারার নীচে কিছু খড় রাখলে বালি আটকে থাকে। গাছের চারা রোপন সহজ হলেও, সেগুলো সংরক্ষণকাজ সহজ নয়। বালিঝড়ে নষ্ট হওয়া ছাড়াও, মাঝে মাঝে ছাগলও ছোট গাছ খায়। প্রতিদিন সূর্যাস্তের পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বনে ছয় জন কাজ করতে থাকেন। বসন্তকাল গাছ রোপন করা, শরত্কালে বালিঝড় প্রতিরোধ করা, এবং গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে গাছের সংরক্ষণকাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে ৬ জন ও তাদের পরিবারের মোট ৪০ সদস্য এ-কাজে অংশ নেয়। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১০ বছর পর ৪২ হাজার মু মরুভূমি এলাকা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদে সবুজ হয়ে ওঠে।

১০ বছরে ৬ জনের দু'জন মারা গেছেন। তারা নিজেদের জীবন উত্সর্গ করেন মরুভূমিকে সবুজ করার জন্য। ছয় জনের একজন হ্য ফা লিন। তিনি একবার গাছের যত্ন নেওয়ার সময় অচেতন হয়ে পড়েন। হাসপাতালে পাঠানোর পর জানা গেল যে তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অসুখটি শেষ পর্যায়ের। হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি তার কাজ ছেলেকে বুঝিয়ে দেন।

আরেকজন সি মানও ১০ বছরের মধ্যেই মারা গেছেন। তার অনুরোধ অনুযায়ী, তাকে পা পু সে অঞ্চলে কবর দেওয়া হয়। তিনি বলেছেন, তিনি সবসময় পা পু সের বনকে দেখতে চান।

মরুভূমিতে ফুল ফোটানোর প্রচেষ্টা এই ৬ জন কখনও পরিত্যাগ করেননি। পরে বাকি ৪ জনের মধ্যে দু'জন মারা গেছেন। বাকি দু'জনের অনেক বয়স হয়েছে। তাঁরা এখন আর বনে কাজ করতে পারেন না। তাদের কাজ বুঝে নিয়েছেন তাদের ছেলে বা জামাতা। ছয় জনের পরিবারের সদস্যরা উত্তরাধিকারসূত্রে বনের দায়িত্ব পেয়েছেন। মরুভূমিতে পা পু সে বনের ব্যবস্থাপনাকাজ এভাবেই অব্যাহত আছে।

৬৬ বছর বয়সী কুও ওয়ান কাং। তার বাবা প্রথম ৬ জনের একজন। ১৯৮৩ সালে তার বাবা তাকে মরুভূমিতে বনের কাজে লাগিয়ে দেন। শুরুতে বাবার সিদ্ধান্ত তার পছন্দ হয়নি। তিনি ভাবলেন, হয়তো বাবার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। তখন তাকে অন্য কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। কিন্তু ১৯৯৩ সালের একটি ঝড় তার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে দেয়।

১৯৯৩ সালের ৫ মে। তখন বসন্তকাল। বিকেল ৫টায় হঠাত করে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। তখন বনে কাজ করছিলেন কুও ওয়ান কাং। প্রচণ্ড বাতাসে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল। তিনি হাত দিয়ে নিজের চোখ-মুখ বালি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। বালিঝড়ের মধ্যেই তিনি আধা ঘন্টার মতো হাঁটলেন। শেষ পর্যন্ত বালিঝড় থেকে তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি শোনেন যে, এলাকায় বালিঝড়ে ২৩ জন নিহত হয়েছেন। এ-ঘটনা তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। তিনি মরুভূতিতে তার বাবার মতো কাজ অব্যাহত রাখেন।

২২ বছর বয়সে সি ইন শানও তার বাবার অনুরোধে বন-খামারে কাজ শুরু করেন। তিনি তিন জনের একটি দল নিয়ে বনের ২৫ কিলোমিটার ভিতরে একটি বন-সংরক্ষণকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন। বসন্ত উত্সবের সময়ও তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পরিবারের সঙ্গে উত্সব পালন তার করা হয়ে ওঠে না। ২০০৫ সালের শরত্কালে তার দু'টি পা গুরুতর চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলেন না। এ-অবস্থায় তিনি মাত্র ৩ দিনের ছুটি নেন এবং পরে স্ক্রাচে ভর করে মরুভূমিতে তার কর্মস্থলে ফিরে আসেন। এখন সি ইন শানের বয়স ৪৮ বছর। ৩০ বছর আগে তার বাবা যখন মরুভূমিতে কাজ শুরু করেন, তখন তার বয়সও ৪৮ ছিল।

প্রথম ৬ জনের ছেলেরা এখন প্রবীণ হয়েছেন। এখন বনে যেসব গাছ ও ফুল দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলোর সবই এই ছেলেরা রোপন করেছেন। কুও ওয়ান কাং জানান, তারাও এ-সব গাছের মতো। ২০১৭ সালে কুও ওয়ান কাংয়ের ভাতিজা কুও সি তাদের দলে যোগ দেন এবং তিনি এই ৬ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের মানুষ।

১৯৯৩ সালের আগের কথা। স্থানীয় সরকার প্রতিমাসে জনপ্রতি ৪৫ ইউয়ান ভাতা বরাদ্দ করে। ১৯৯৩ সালের পর জাতীয় নীতিতে পরিবর্তনের কারণে এ-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে ভাতার অভাবে মরুভূমির বন-খামারটি বন্ধ করে দিতে হয়। ওই সময় সবার বিরোধিতার মুখে কুও ওয়ান কাং একটি সিদ্ধান্ত নেন। তিনি খামারের কাছে ৩০০ মু পতিত জমি ক্রয় করেন। তিনি সেখানে কুয়া তৈরি করেন এবং মুরগি, গম, তরমুজ, টমেটো চাষ শুরু করেন। তিনি বিকল্প কাজ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে খামারটি চালু রাখতে চাইলেন। ১৯৯৭ সালে ধার-করা ৩ লাখ ইউয়ান দিয়ে ৬ জন ব্যবসা শুরু করেন এবং ওই বছরে তারা ২ লাখ ইউয়ান আয় করেন। মরুকরণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাঁরা নিজস্ব ব্যবসা দাঁড় করান। ২০০৪ সালে এই ৬ জন পা পা সা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে তিনটি মরুভূমিতে রূপান্তরিত হওয়া এলাকার দায়িত্ব নেন। ১০ বছর পর সেই তিনটি অঞ্চল সবুজে ছেয়ে যায়।

২০০৯ সালে বন-খামারভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় পা পু সা সবুজবর্ণ কোম্পানি। ২০১০ সাল থেকে কোম্পানির আয় দিয়ে বন-খামার উন্নয়নের কাজ চলতে থাকে।

২০১৫ সালে ৬ জন কান সু প্রদেশ ও ইনার মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে ১৫৭ হাজার মু মরুভূমি ঠিকা নেন। বর্তমানে সেখানকার ৩০ হাজার মু মরুভূমি সবুজায়নের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৭ সালে কোম্পানির আয় ২ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যায় এবং দিন দিন তা বাড়ছে।

বৃক্ষরোপন ও মরুভূমি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তাদের কি আর কোনো শখ আছে? কুও ওয়ান কাং জানালেন, তিনি ফুল পছন্দ করেন। তিনি জানান, মরুভূমিতে প্রতিটি ফুলের নিজস্ব সুগন্ধ আছে। হ্য জুং ছিয়াং বলেন, প্রতিবছরের এপ্রিল ও মে মাসে এখানে ফুল ফোটার সময় এবং এ-ফুল দেখলে ও সেগুলোর ঘ্রাণ নিলে সব চিন্তা ও কষ্ট ভুলে থাকা যায়।

পা পু সা অঞ্চলে ৬ জন পুরুষ ও তাদের পরবর্তী দুই প্রজন্মের সন্তানেরা ৩৭ বছরের একটি অপূর্ব গল্প রচনা করেছেন যেন। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040