লিয়াংচিয়াহ্য ৩
  2018-07-03 16:35:30  cri



চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১৯৬৯ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছর লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে কাটান। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র কাজে বেইজিং থেকে চীনের শানসি প্রদেশের ইয়ান'আন শহরের 'লিয়াংচিয়াহ্য' নামের ছোট্ট গ্রামটির সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেটেছে তাঁর সাতটি বছর। ফলে গ্রামটির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সি'র আত্মার বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। দীর্ঘ ৪০ বছর পর ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সি চিন পিং সেই গ্রামে ফিরে যান। প্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠানে সি চিন পিং-এর তরুণ জীবন এবং লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে শুনবেন বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠান 'লিয়াংচিয়াহ্য'। আজ শুনুন তৃতীয় পর্ব।

যে-বন্ধুত্ব পুরাতন হয় না

লিয়াংচিয়াহ্য'র ছোট্ট জাদুঘরের দেয়ালে একটি ছবি টানানো আছে। ছবিটিতে সি চিন পিংয়ের গ্রাম-ত্যাগের মুহূর্তটি ধরে রাখা হয়েছে। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রাম-ত্যাগের সময় গ্রামবাসীরা তাকে বিদায় জানিয়েছিলেন।

গ্রামবাসীদের সঙ্গে থাকার সময় সি কখনই কর্মকর্তার মতো আচরণ করতেন না। গ্রামবাসীদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন কর্মঠ, বাস্তববাদী, গ্রন্থপ্রেমিক একজন যুবক।

২০০৯ সালের শেষের দিকের কথা। ইয়ান'আন পরিদর্শনকালে ওয়াং সিয়ানফিং নামক একজন গ্রামবাসীর সঙ্গে সি চিন পিংয়ের দেখা হয়ে যায়। ওয়াং প্রচুর কথা বলতেন। কিন্তু তখন সি চিন পিংয়ের সঙ্গে করমর্দনের সময় তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে, পুরাতন বন্ধুকে কী নামে সম্বোধন করা উচিত! তিনি কি তাকে 'মিস্টার ভাইস প্রেসিডেন্ট' বলবেন, নাকি আগের মতো 'চিনপিং' বলে ডাকবেন? তখন সি চিন পিংই তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন: "সিয়ানফিং! শেষবার যখন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তখনকার তুলনায় তুমি অনেক মোটা হয়েছ!"

দুই বন্ধু তখন লিয়াংচিয়াহ্য'র দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। মাঝেমাঝে তারা কুস্তি লড়তেন। ওয়াং বলেন: "ওটা ছিল সত্যিকারের সুখ। আমরা দু'জনই তরুণ ছিলাম। আমি যদি জানতাম যে তুমি একসময় এতো বড় নেতা হবে, তবে তোমার সঙ্গে কুস্তি লড়ার সাহস আমার হতো না!" সি চিন পিং অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন, বলেন: "তুমি এভাবে কেন বলছ!"

পরিদর্শনকালে গ্রামের পার্টি-সেক্রেটারি শি ছুনইয়াং কর্ম-প্রতিবেদন পেশ করার সময় সি চিন পিংকে 'সম্মানিত ভাইস প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং' বলে সম্বোধন করেন। সি চিন পিং তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন: "আরে ধুর! তুমিও আমাকে এভাবে সম্বোধন করছ!"

১৯৬৯ সাল। লিয়াংচিয়াহ্য-তে থিতু হবার কয়েক মাস পরের কথা। চাং ওয়েইফাং নামক একজন গ্রামবাসী বিয়ে করলেন। তখন চাংয়ের হাতে টাকাপয়সা তেমন ছিল না। সি চিন পিং নববিবাহিত দম্পতির সঙ্গে তার নিজের রেশন ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং নিয়মিত তিনি তাদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে শুরু করলেন। চাংয়ের মনে সেই স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। তিনি বলেন: "আমার স্ত্রী যা রান্না করতেন, সি চিন পিং তা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন। তিনি কখনও গরীবদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন না!"

আরও কয়েক বছর পর। সি চিন পিং কলেজে পড়ার জন্য বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। যাবার আগে তিনি চাং ওয়েইফাংকে দুটি লেপ, দুটি কোট, এবং সেলাই করার সরঞ্জাম উপহার হিসেবে দেন। এসব সি চিন পিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯৯৩ সালে যখন সি লিয়াংচিয়াহ্য-তে ফেরেন, তখন চাং ওয়েইফাং একটি পাহাড়ে কাজ করছিলেন। তিনি দৌড়ে পাহাড় থেকে নেমে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। চাং বলেন: "আমার ময়লা কাপড়কে চিনপিং পাত্তাই দিলেন না। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ও আমার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বললেন। আমি এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে, কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।"

সুস্বাদু আচার

সেদিনগুলোর কথা স্মরণ করে সি চিন পিং বললেন: "কীভাবে জীবন যাপন করতে হয়, কীভাবে কৃষিকাজ করতে হয়, তা গ্রামবাসীরা আমাকে শিখিয়েছিলেন। আমি তখন কিছুই জানতাম না। কিন্তু আমি তাদের কাছ থেকে সবকিছু শিখেছি; শিখেছি কীভাবে নুডলস, বান ও আচার তৈরি করতে হয়। বিশেষ করে সেখানকার আচার আমি খুব মিস্‌ করি।"

২০১৫ সালে গ্রাম পরিদর্শনকালে রাতের খাবারের সময় সি চিন পিং ও তার সঙ্গিদের সামনে আচার পরিবেশন করা হয়। একজন সঙ্গি বলেন: "তিনি বেশ খানিকটা আচার ও মিষ্টিকুমড়া খেলেন!"

গ্রামের স্থানীয় আচার সি চিন পিংয়ের সবসময়ের পছন্দ। কয়েক বছর পর তিনি এক সাংবাদিককে বলেছিলেন: "শুরুর দিকে সেখানকার খাবার আমাকে আকর্ষণ করত না মোটেই। কিন্তু তখন ওসবই খেতে হতো এবং না-খেলে আপনাকে উপোস করতে হবে। গ্রামবাসীরা তখন তাদের খাবার আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তারা আমাকে গমের রুটি ও জোয়ারের বান খেতে দিতেন। এগুলো খেতে সুস্বাদু ছিল। তবে সবচেয়ে সুস্বাদু ছিল আচার। আমি সেই আচার খুবই মিস্‌ করি।"

২০১৪ সালের মার্চ মাস। কুইচৌ প্রদেশের জাতীয় গণকংগ্রেস প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরকারের বার্ষিক কর্মরিপোর্ট নিয়ে কথা বলছিলেন সি চিন পিং। তখন তিনি তাঁদেরকে জানান, কেন গ্রাম তার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন: "আমি সবসময় গ্রাম পছন্দ করি। ১৯৬৯ সালে যখন আমি প্রথম গ্রামে যাই, তখন গ্রামবাসীরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁরা যাকিছু খেতেন, আমাকে তার ভাগ দিতেন। সেসময় এক বাটি আচার ছিল চমৎকার খাবার। দরিদ্র গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলোর জন্য আমি সত্যিই খুব ফিল করি। সিপিসি'র সদস্য হিসেবে আমাদের উচিত তাদেরকে হৃদয়ে ধারণ করা এবং তাদের জন্য কাজ করা। তা না-হলে, আমাদেরকে বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে!"

হৃদয় থেকে হৃদয়ে

এলভি হাউশেং নামক একজন গ্রামবাসীল সঙ্গে কিছুকাল ছিলেন সি চিন পিং। ১৯৯৪ সালে হাউশেং কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। তিনি নিজের চিকিৎসায় দুই মাসে ৬ হাজার ইউয়ান ব্যয় করেন, কিন্তু তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। তিনি সি চিন পিংকে একটি চিঠি লেখেন। সপ্তাহ-দুয়েক পর সি চিন পিং তাকে ৫০০ ইউয়ান পাঠান এবং ফুচৌতে একজন ডাক্তারের কাছে তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ফুচৌতে সি চিন পিং প্রায় প্রতিরাতে এলভি'র সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তিনি বলতেন: "হাউশেং, তুমি সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত যত টাকা লাগে আমি ব্যয় করব। তুমি চিন্তা কর না!"

একসময় এলভির অবস্থার উন্নতি ঘটল এবং তিনি বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হলেন। সি চিন পিং তাকে বাড়ি যাবার জন্য প্লেনের টিকিট কেটে দিলেন এবং হাতে গুজে দিলেন নগদ আরও ২ হাজার ইউয়ান। এলভি বললেন: "চিন পিং আমি সত্যি দুঃখিত। আমার অসুখের জন্য তোমার হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল।" সি চিন পিং বললেন: "আমরা পরস্পরের বন্ধু, তাইনা?"

আরও কয়েক বছর পরের কথা। সি চিন পিং জানলেন এলভি'র পা-য়ে অপারেশান করাতে হবে। সি চিন পিং তার পুরাতন বন্ধুর অপারেশানের সব খরচ বহন করলেন এবং স্থানীয় বন্ধুদেরকে অনুরোধ করলেন তার দেখাশোনা করতে। অশ্রুসজল চোখে হাউশেং বলেন: "চিন পিং আমার প্রতি এতো সদয় ব্যবহার করেছেন! আমার অসুস্থতার সময় তিনি আমার অনেক যত্ন নিয়েছেন।"

এলভি এবং অন্যান্য গ্রামবাসীকে অসুস্থতার সময় অর্থ দিয়ে সাহায্য করার পাশাপাশি, সি চিন পিং লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের উন্নয়নে অন্য অনেকভাবেই বছরের পর বছর ধরে কাজ করেছেন। তিনি গ্রামে বিদ্যুত এনে দিয়েছেন, বিদ্যালয়গুলো মেরামতের ব্যবস্থা করেছেন এবং একটি সেতু নির্মাণ করে দিয়েছেন।

গ্রামবাসী উ হুই বলেন: "যখনই আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন হতো, তিনি হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি আমাদের প্রতিটি চিঠির জবাব দিতেন।" উ হুই ২০০০ সালে ফুচিয়ান গেলে সি চিন পিং তাকে নিজের বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণ জানান। ডিনারের জন্য সি চিন পিংয়ের স্ত্রী ফেং লিইয়ুয়ান নিজ হাতে রান্না করেন। উ হুই বললেন: "মাদাম ফেংও খুবই যত্নশীল। তিনি আমাদের স্থানীয় স্টাইলে রান্না করার চেষ্টা করেছিলেন!"

লিয়াংচিয়াহ্য চীনের উন্নয়নের দর্পণ

২০১৫ সালে সি চিন পিং যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল সফর করেন। সেখানে তিনি তার আমেরিকান বন্ধুদের লিয়াংচিয়াহ্য'র গল্প বলেন। তিনি বলেন: "গ্রামবাসীদের সঙ্গে আমি গুহায় বাস করতাম এবং রাতে ঘুমাতাম কাদামাটি দিয়ে তৈরি ইটের বিছানায়। মাংস খাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হতো না বললেই চলে। তখন আমি বুঝেছিলাম গ্রামবাসীর সত্যিকারের চাহিদা কী। আমি তথন গ্রামের পার্টি-সেক্রেটারি ছিলাম। আমি গ্রামবাসীকে নিজেদের মাতৃভূমি উন্নত করতে সাহায্য করেছি। আমি তখন একটা লক্ষ্য মাথায় রেখে কঠোর পরিশ্রম করতাম, আর সেটা হচ্ছে: গ্রামবাসীরা যেন মাংস খেতে পারে। তখন সে-স্বপ্ন পূরণ ছিল বলতে গেলে অসম্ভব। কিন্তু গেল বসন্ত উৎসবে আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম, গ্রামে এখন পাকা রাস্তা হয়েছে, ইটের দালান হয়েছে। গ্রামবাসীরা এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। গ্রামের প্রবীণরা এখন পেনশন পান। গ্রামের সবার স্বাস্থ্যবীমা আছে। তাদের সন্তানরা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে। আর অবশ্যই, মাংস খাওয়া এখন আর কোনো সমস্যা নয়!"

"এই ছোট্ট গ্রামটিকে দেখলেই আপনারা বুঝবেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম চালুর পর থেকে চীন কীভাবে অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে আমাদের ৩০ বছর সময় লেগেছে। এখন চীনের ১৩০ কোটি মানুষের কোনো অভাব নেই; তারা মধ্যমমানের সমৃদ্ধ জীবন যাপন করছেন এবং আগে ছিল না—এমন অধিকার ও সম্মান ভোগ করছেন। শুধু চীনা মানুষের জন্য এটা একটা বড় পরিবর্তন, তা নয়; এটা মানবজাতিরও তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। বিশ্ব শান্তি ও অগ্রগতিতে এভাবেই চীন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।"

(অনুবাদ: আলিমুল হক)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040