লিয়াংচিয়াহ্য-২
  2018-07-02 16:16:49  cri



জীবন যেখানে নিয়ে যায়, সেখানেই আছে অনেক কিছু শেখার: সি চিন পিং


চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১৯৬৯ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছর লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে কাটিয়েছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিসি'র কাজে বেইজিং থেকে চীনের শানসি প্রদেশের ইয়ানআন শহরের 'লিয়াংচিয়াহ্য' নামের ছোট্ট গ্রামটির সাধারণ মানুষদের সঙ্গে সাতটি বছর অতিবাহিত করেন। গ্রামটির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সি'র আত্মার বন্ধন তৈরি হয় সে সময়। দীর্ঘ ৪০ বছর পর ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট অবস্থায় সি চিন পিং সেই গ্রামে ফিরে যান। প্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠানে সি চিন পিং-এর তরুণ জীবন এবং লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে শুনবেন বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠান 'লিয়াংচিয়া হ্য'।

গৃহকোণ: শান্তির আশ্রম!

অবশেষে তাঁরা ঘরে ঢোকেন। স্ত্রী ফেং লি ইউয়ানকে গ্রামে তাঁর ঘরে নিয়ে যান সি চিন পিং। আসলে গ্রামের চাং ছিং ইউয়ানের বাড়িটি ছিল সি চিন পিংয়ের প্রথম বসতি। সি চিন পিং আরো পাঁচ জনকে নিয়ে এখানে থাকতেন। তাঁদের সবাইকে এই গ্রামে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল। চাং ছিং ইউয়ান ও তার স্ত্রী লিউ চিন লিয়ানের প্রথম সন্তান জন্ম নেওয়ার সময় পর্যন্ত তাঁরা এই বাড়িতে ছিলেন।

বাড়ির উঠান ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ভুট্টার সোনালি মোচা আর লাল মরিচ ঝুলানো ছিল বাড়ির প্রবেশমুখে।

তাঁরা যখন উঠানে পা রাখলেন তখন ৬৪ বছর বয়সী বৃদ্ধা লিউ চিন লিয়ান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, "আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?"

"তুমি থাইপিংয়ের স্ত্রী! তোমরা যখন বিয়ে করো, সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা ছিলাম।" সি অন্য দুটি ঘরের দিকে ইশারা করে বলেন, "তোমার অভিভাবক এই ঘরে থাকতেন, আর তুমি স্বামীর সঙ্গে তার পাশের ঘরে থাকতে।"

অভিভূত হয়ে লিউ বলেন, "একদম ঠিক! এতগুলো বছর পর আপনি একদম ঠিক বলেছেন!"

"কীভাবে ভুলে যাব!" মিষ্টি হেসে জবাব দেন সি চিন পিং।

১৯৯৩ সালে সি চিন পিং যখন লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে যান, তখন চাং ছিংইউয়ান সি'কে মজা করে বলেছিলেন, "তুমি কীভাবে স্ত্রীকে না নিয়ে এখানে এলে!"

এরপর ২০১৫ সালে সি পুনরায় লিয়াংচিয়াহ্যতে ফিরে যান। কিন্তু চাং ছিংইউয়ান তখন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এই খবর পেয়ে সি জানতে চান, "তার কী হয়েছিল?"

লিউ জানায়, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন চাং।

"এগুলো তো প্রাণঘাতী রোগ না। তাহলে সে কেন সুস্থ হলো না...?"

দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্ন বের হয় সি'র ভেতর থেকে। "তোমাদের জীবন এখন কেমন চলছে?"

"এখানে আমার একটি সুন্দর জীবন আছে।" লিউ বলে, "খাবার, পোশাক, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস... আমাদের এখন যথেষ্ট আছে।"

সি তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নেন। যেন তাকে নিজের যত্ন নেওয়ার কথা বলছেন সি। নিজের চলে যাওয়ার কথা স্মরণ করে সি বলেন, "আমি আবারও সময় বের করে তোমাদের দেখার জন্য ফিরে আসব।"

গ্রামে সি চিন পিংয়ের দ্বিতীয় ঘর ছিল ল্যু হৌসেংয়ের বাড়ি। এটি লিউয়ের বাড়ি থেকে একটি নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন ছিল। নদীটি গ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে।

প্রেসিডেন্ট সি সেখানে পৌঁছালে ল্যু হৌসেং বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। সি মুচকি হেসে বলেন, "দারুণ পোশাক!"

চাং ওয়েইফাং বলে ওঠেন, "হবে না!, হৌসেং একটা ব্যবসার মালিক!"

"একটা তিন চাকার গাড়ির মালিক" খানিকটা বিব্রত হয়ে জবাব দেন হৌসেং।

হেসে ওঠেন সি চিন পিং। তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, "সে সময় হৌসেং ছিল মাত্র ১২/১৩ বছরের ছেলে। সে আমার ছায়ার মতো সঙ্গে থাকত।"

এবার ল্যুর উঠানে ভিড় জমল। ফেং লি ইউয়ানকে সি বলেন, "ওই দূরের শেষ মাথার ঘরে আমি থাকতাম। আমি আর হৌসেং কাছাকাছি বয়সের ছিলাম। তাই আমরা একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। সেই তরুণ বয়স থেকেই সে রান্নায় ভালো ছিল। সে আমাকে খাবার তৈরি করে দিত। সে সময় রান্নার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত তেল ছিল না। কিন্তু হৌসেং ছিল বুদ্ধিমান। সে কিছু কাঠবাদাম জোগাড় করে গুঁড়া করত। তারপর ওক গাছের আগুনে তাতে তাপ দিয়ে কিছু তেল বের করত। সেই তেলে আলু আর মিষ্টি কুমড়া ছেড়ে দিত হৌসেং। খাবারের স্বাদটাও ছিল দারুণ।"

গুহার মতো ঘরের যেটাতে তারা থাকতেন, সি চিন পিং ও ল্যু হৌসেং পাশাপাশি কাঁধ লাগিয়ে স্থানীয় বৈশিষ্ট্যময় এক ধরনের আসনে বসেন। এর নাম খাং, এটি এক ধরনের ইটের তৈরি বিছানা। এখানে বসে তাঁরা স্মৃতিচারণ করেন।

ল্যু'র হাত শক্ত করে ধরে থাকেন সি। তিনি বলেন, ল্যুকে নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। কারণ তিনি দেখতে পাচ্ছেন, ল্যু ঠিকমত হাঁটতে পারছে না। ল্যু বলেন, "সমান জায়গায় হাঁটতে তার কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু আমি আর ভারী কাজ করতে পারি না। এজন্যই আমি তিন চাকার গাড়িতে চড়ি।"

পুরানো বাড়ি দেখার পর সি হৌসেংয়ের বর্তমান বাসস্থান দেখতে চান। তাঁর বন্ধুর নতুন 'গুহা-বাড়িটি' সুন্দর করে সাজানো-গোছানো, আলোকিত। দেয়ালে ঝুলানো ছবির দিকে তাকিয়ে ল্যু'র পরিবারের প্রত্যেকের খবর জানতে চান।

বন্ধু ল্যুকে বিদায় দিয়ে সি চিন পিং গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকেন। চারদিকে অনেক মানুষ ভিড় করেছিল তখন। যদিও অনেক বছর পার হয়েছে, তারপরও চলার পথে আশে পাশে 'গুহা-বাড়ির' মালিকদের প্রত্যেকের নাম সি চিন পিংয়ের মনে আছে।

তাঁরা নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। এভাবে তারা আরেকটি গুহা-বাড়িতে পৌঁছলেন। এখানে সি চিন পিং টানা পাঁচ বছর ছিলেন। উঠানের চারদিকে ছয়টি গুহা-ঘরের একটিতে থাকতেন সি। স্থানীয় উৎপাদক দলের লোকজন ১৯৭০ সালে এগুলো তৈরি করেন। লিয়াংচিয়াহ্য ছাড়ার আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এতে বাস করেন সি।

গুহা-ঘরের দেয়ালে একটি ছবির ফ্রেম ঝুলানো রয়েছে। সেই ফ্রেমের ভেতর হাতে লেখা একটি কাগজ। গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির শাখা থেকে এটি লেখা হয়েছে। সেখানে লেখা আছে,

"১৯৭৪ সালের ১০ জানুয়ারি, পিপলস্‌ কমিউনের পার্টি কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, কমরেড শি ইউশিন, শি ফেংলান এবং সি চিন পিং এখন থেকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।"

মিথেন ট্যাংক প্রকল্পের একেবারের পাশে, গুহা-বাড়ির বাইরের দেয়ালে হাতে লেখা একটি পোস্টার দেখা যায়। তাতে লেখা রয়েছে একটি কথা, 'আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রম।'

এটি এমনই একটি কথা, যা সি চিন পিং মনে রেখেছে বিগত ৪০ বছর ধরে!

জনগণের সুন্দর জীবনযাপনে আনন্দিত সি চিন পিংয়ের হৃদয়

প্রতিটি পর্বত, প্রতিটি ধারা, প্রতিটি মানুষ-সবাইকে মনে রেখেছেন সি চিন পিং। নদীতে একটি বাঁধ ছিল। মুকুয়া পার্বত্য উপত্যকায় বাঁধটি তৈরি করা হয়েছিল। সিপিসি'র গ্রাম কমিটির প্রধান, সি চিন পিং ও তাঁর বন্ধুরা এই বাঁধটি তৈরি করেছিলেন সেই সময়। যা এখনও গ্রামের মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

ওয়াং সিয়ানচুন তাদের মধ্যে একজন, যিনি বাঁধটি তৈরি করার সময় ছিলেন। তিনি সেই সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে ভীষণ রকম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এতগুলো বছর আগে সি চিন পিংয়ের লেখা স্লোগান তিনি উচ্চারণ করেন, যা তাদের কাজে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

"এটা ৪০ বছর আগের কথা! তুমি এখনও তা মনে রেখেছো?" বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন সি চিন পিং।

সি বলেন, "সে সময় বরফশীতল নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার পরের কথা চিন্তা না করেই কাজ ঝাঁপ দিতাম।" এসব কারণে, বাঁধ তৈরি শেষ হলে ঠান্ডা পানিতে কাজ করার জন্য সি পায়ে ব্যথার কষ্টে ভোগেন।

"বাঁধ তৈরির পর তা কি কখনও নষ্ট হয়েছিল?" জানতে চান সি।

শি ছুনইয়াং বলেন, "হ্যাঁ হয়েছিল, তবে আমরা তা মেরামত করেছি।"

সি চিন পিং খুব তীক্ষ্ণভাবে বাঁধ পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি শি ছুনইয়াংকে বলেন বাঁধটির প্রতি খেয়াল রাখতে, বিশেষ করে বর্ষার দিনগুলোতে।

কাছাকাছি একটি আপেল বাগানের কথা জানতে পেরে খুব দ্রুত তা ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সি। বহু বছর আগে সি যখন এখানে ছিলেন, ওই স্থানটি ছিল অনুর্বর ভূমি; অথচ এখন তা লাভজনক ফলের বাগান।

আপেল বাগান করা, বাড়িতে বাড়িতে কলের পানি সংযোগ দেওয়া ও ইন্টারনেট সংযোগের জন্য লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা জানতে পেরে মিষ্টি এক টুকরা হাসি দেখা দেয় সি চিন পিংয়ের মুখে।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040