লিয়াংচিয়াহ্য-১: ফিরে এসেছেন সি চিন পিং
  2018-07-01 16:24:43  cri


জীবন যেখানে নিয়ে যায়, সেখানেই আছে অনেক কিছু শেখার: সি চিন পিং

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১৯৬৯ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছর লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে কাটিয়েছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিসি'র কাজে তিনি গ্রামটির সাধারণ মানুষদের সঙ্গে সাতটি বছর অতিবাহিত করেন। গ্রামটির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সি'র আত্মার বন্ধন তৈরি হয় সে সময়। দীর্ঘ ৪০ বছর পর ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট অবস্থায় সি চিন পিং সেই গ্রামে ফিরে যান। প্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠানে শুনবেন বিস্তারিত।

ফিরে এসেছেন সি চিন পিং

২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় তিনটি বাস লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের প্রবেশপথে এসে দাঁড়ায়। কয়েকজন যাত্রী বাস থেকে নেমে গ্রামের দিকে দৌড় দেয়। তাদের কণ্ঠে শোনা যায় বিস্ময় মাখানো আনন্দ ধ্বনি, 'চিন পিং এসেছেন!'

এ খবর পাওয়া মাত্রই গ্রাম থেকে ছুটে আসে লোকজন। ৪০ বছর আগে ছোট্ট এই গ্রাম থেকে 'হারিয়ে যাওয়া' সি চিন পিং ফিরে এসেছেন গ্রামে। প্রেসিডেন্ট সি নিজেও খুব উত্সাহ বোধ করেন। এই সেই গ্রাম, যেখানে তিনি সাতটি বছর কাটিয়েছেন, যেখানে সঙ্গীদের নিয়ে তিনি দিনের পর দিন গ্রামের উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি সবার কথা মনে রেখেছেন।

কিছুটা দূর থেকেই ভিড়ের মধ্যে থাকা একজনকে লক্ষ্য করে ডাক দেন তিনি, 'এই সুইওয়া!' তাকে চিনতে মোটেই ভুল করেননি প্রেসিডেন্ট। সি তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করেন, কেউ তার হাত ছাড়তে চায় না।

সময় তাদের প্রত্যেকের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ এঁকে দিয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সি'র হৃদয় থেকে গ্রামবাসীর চেহারা মুছে দিতে পারেনি! সি চিন পিং তাদের ডাকনাম পর্যন্ত মনে রেখেছেন!

এবার সি চিন পিং তাঁর সফরসঙ্গীকে গ্রামবাসীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সফরে চীনের ফার্স্ট লেডি ম্যাডাম ফেং লি ইউয়ান তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সি বলেন, 'এই হচ্ছে আমার স্ত্রী, তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তাঁকে নিয়ে এসেছি।' স্থানীয় অঞ্চলের মানুষের মতো করে কথা বলতে শুনে সবাই দারুণ চমৎকৃত হন।

"চাং ওয়েই পাং, আপনি দেখি একদম আগের মতো আছেন!" এ-কথা বলে তিনি চাংয়ের হাত ধরেন এবং ম্যাডাম ফেংকে বলেন, "এই হলো লিয়াং উমিংয়ের শ্যালক।"

উৎসাহী গ্রামবাসীকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট সি এগিয়ে চলেন গ্রামের দিকে। অবশেষে সিপিসি'র গ্রাম কমিটির অফিসে পৌঁছান প্রেসিডেন্ট সি।

তবে, সেখানে পৌঁছানোর আগে সারা গ্রাম থেকে লোকজন ছুটে এসে ঘিরে ধরে প্রেসিডেন্ট সি দম্পতিকে। তিনি একটুও সামনে আগাতে পারছিলেন না। এমন সময় শি ছুনইয়াং উচ্চস্বরে বলেন, "একটি পরিবার আমাদের এখানে এসেছে, আর আমরা এভাবে দরজার বাইরে তাকে স্বাগত জানাচ্ছি! চলুন ভেতরে চলুন!"

সে সময় প্রেসিডেন্ট সি অনেকগুলো পরিবারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তিনি এখনও তাদের মনে রেখেছেন। তিনি সেসব পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। "তুমি কী কাজ করছ? সাধারণত তোমরা কী খাও? বয়স্করা কেমন আছে? বাচ্চাদের কী খবর? জীবনযাত্রা কেমন এখন? তোমরা কি ভাত খাও? প্রায়ই কি মাংস খেতে পারো?" ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করে তাদের খোঁজ নিতে থাকেন সি।

জবাবে তাঁর বন্ধুরা জানান, গ্রামের জীবন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। গমের ময়দা তাদের প্রধান খাবার। তবে প্রয়োজন হলে ভাত ও মাংস যোগাড় করা খুব সহজ।

"এটা খুবই খুশির বিষয়। আমাদের সঙ্গীরা উত্তম জীবন কাটাচ্ছেন-এ খবরে নিশ্চিন্ত হলাম।" আনন্দের সঙ্গে জবাব দেন সি চিন পিং।

আমার হৃদয় রয়ে গেছে এখানে

তখন ছিল বসন্তকাল! সূর্যের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। দূরের ওই পর্বতের বরফ গলতে শুরু করেছে। গ্রাম কমিটি অফিসের উঠানে দাঁড়িয়ে সি চিন পিং যেন আপনা-আপনি কথা বলতে শুরু করেন। "আজ এখানে আসতে পেরে আমি সত্যিই ভীষণ আনন্দিত! ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে আমার জীবনের প্রথম পদক্ষেপটি পড়েছিল এই লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামে। সাত বছর ছিলাম এখানে। কিন্তু এখনও আমার মনে হয়, আমার হৃদয় এখানে, তোমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে!"

গ্রামবাসী সি'র কথায় আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ লিয়াং ইয়ো ছাংয়ের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এদিকে আনন্দে তিনি হাততালি দিয়েই যাচ্ছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে সি বলেন, "আমি দেখতে পাচ্ছি লিয়াং এখন গ্রামের বয়স্ক মানুষ, সে এখন দাদু হয়েছে। হতে পারে এই প্রথম আমরা দেখা করেছি। কিন্তু এই সাক্ষাতের পেছনে রয়েছে লিয়াংচিয়াহ্য'র সঙ্গে আমার শক্তিশালী বন্ধন। আমি এখানে থাকতাম, তোমাদের দাদাদের সঙ্গে, তোমাদের বাবা-মা'র সঙ্গে কাজ করতাম। আমার জীবনের প্রথম প্রশিক্ষণ এই লিয়াংচিয়াহ্য গ্রাম থেকেই পেয়েছিলাম। তাই কাউকে লিয়াংচিয়াহ্যকে অবজ্ঞা করার সুযোগ দেবেন না; এটা প্রশিক্ষণের উত্তম ক্ষেত্র। যদি তুমি হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করো, তাহলে জীবন যেখানেই নিয়ে যাবে, সেখানেই রয়েছে অনেক কিছু শেখার।"

সি বলেন, "এখানে একটি উৎপাদক দলের পার্টি সেক্রেটারি হিসেবে পদোন্নতি হয়েছিল আমার। সে অবস্থা থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে, তখনই মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, লিয়াংচিয়াহ্য'র ভবিষ্যতে শুধু কল্যাণই রয়েছে। আমি আরও আশা করি, আমাদের সন্তানরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে এবং আরও ভালোভাবে মানুষের সেবা করবে।"

সি'র আন্তরিক কথাগুলি বসন্তের উষ্ণ বাতাসের মতো গ্রামবাসীর হৃদয় স্পর্শ করছিল এবং হৃদয়কে প্রশান্ত করছিল।

১৯৭৫ সালে সি চিন পিং লিয়াংচিয়াহ্য গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এরপর ১৯৯৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি এই গ্রামে ফিরে আসেন। সি চিন পিং তখন ফুচিয়ান প্রদেশের পার্টি কমিটির স্থায়ী সদস্য এবং ফুচৌ শহরের পার্টি সেক্রেটারি। প্রথমবার ১৮ বছর পর তিনি গ্রামটিতে ফিরে আসেন। তিনি গ্রামের প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদের কথা দেন, পরেরবার অবশ্যই তাঁর স্ত্রীকে লিয়াংচিয়াহ্যতে নিয়ে আসবেন।

তিনি সবাইকে বলেন, "আমাদের উচিত, পর্বত ও উপত্যকার তত্ত্বাবধান করা, পর্বতে বাণিজ্যিক বন ও ফলের বাগান করা। এগুলো থেকে আমাদের খাবার আসবে। কিন্তু একই সময়ে আমাদের শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে...।" সে সময় সি প্রতিটি পরিবারকে একটি করে 'অ্যালার্ম ঘড়ি' উপহার দেন। তিনি আশা করেন, এতে বাড়ির শিশুরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে যথাসময়ে স্কুলে যাবে এবং ভালো ফলাফল করবে।

দুপুরের খাবারের জন্য খাসির মাংসের আয়োজন করা হয়। সি চিন পিং একাই দুই বাটি খেয়ে নেন। তিনি বলেন, লিয়াংচিয়াহ্য গ্রাম থেকে যাবার পর এমন সুস্বাদু খাসির মাংস আর কোথাও খাননি তিনি।

এই গ্রামে তাঁর প্রথম সফর সম্পর্কে সি লেখেন, "১৯৯৩ সালে যখন গ্রামটিতে ফিরে যাই, তখন কেউ কেউ 'কামারশালা' স্থাপনে আমার উদ্যোগের কথা স্মরণ করেন। এতে গ্রামটিতে আয়ের পথ তৈরি হয়েছিল। কেউ কেউ মিথেন গ্যাসের কুপ খননের কথাও স্মরণ করেছিল। এতে সবাইকে নিয়ে আমি কাজ শুরু করেছিলাম। এর ফলে গ্রামটিতে রান্না করা ও ঘরবাড়ি আলোকিত করার ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে, আমি কিন্তু তাদের সহযোগিতা, আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া ও তাদের সততার মাধ্যমে আরও উৎসাহ দেওয়ার কথা মনে রেখেছি।"

সি লিয়াংচিয়াহ্য গ্রামের প্রতিটি মানুষকে মনে রেখেছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি তাদের জন্য উপহার হিসাবে চা নিয়ে যান। ২০১৫ সালে, বসন্ত উৎসবের কয়েকদিন আগে, তিনি চাল, ময়দা, রান্নার তেল, মাংস, নববর্ষের কাপলেট ও ছবি গ্রামের প্রতিটি পরিবারের জন্য নিয়ে যান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে একটি আনন্দময় বসন্ত উত্সব ও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান এবং তাদের সমৃদ্ধ জীবন প্রত্যাশা করেন!

গৃহকোণ: শান্তির আশ্রম!

অবশেষে তাঁরা ঘরে ঢোকেন। স্ত্রী ফেং লি ইউয়ানকে গ্রামে তাঁর ঘরে নিয়ে যান সি চিন পিং। আসলে গ্রামের চাং ছিং ইউয়ানের বাড়িটি ছিল সি চিন পিংয়ের প্রথম বসতি। সি চিন পিং আরো পাঁচ জনকে নিয়ে এখানে থাকতেন। তাঁদের সবাইকে এই গ্রামে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল। চাং ছিং ইউয়ান ও তার স্ত্রী লিউ চিন লিয়ানের প্রথম সন্তান জন্ম নেওয়ার সময় পর্যন্ত তাঁরা এই বাড়িতে ছিলেন।

বাড়ির উঠান ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ভুট্টার সোনালি মোচা আর লাল মরিচ ঝুলানো ছিল বাড়ির প্রবেশমুখে।

তাঁরা যখন উঠানে পা রাখলেন তখন ৬৪ বছর বয়সী বৃদ্ধ লিউ চিন লিয়ান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, "আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?"

"তুমি থাইপিংয়ের স্ত্রী! তোমরা যখন বিয়ে করো, সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা ছিলাম।" সি অন্য দুটি ঘরের দিকে ইশারা করে বলেন, "তোমার অভিভাবক এই ঘরে থাকতেন, আর তুমি স্বামীর সঙ্গে তার পাশের ঘরে থাকতে।"

অভিভূত হয়ে লিউ বলেন, "একদম ঠিক! এতগুলো বছর পর আপনি একদম ঠিক বলেছেন!"

"কীভাবে ভুলে যাব!" মিষ্টি হেসে জবাব দেন সি চিন পিং।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040