মিলু হরিণ: একমাত্র চীনেই দেখা মেলে বিরল প্রজাতির এই প্রাণীটি
  2018-06-27 14:56:37  cri


আপনারা কখনও Pere David's Deer বা মিলু হরিণ (Milu)-র নাম শুনেছেন? এই বিরল প্রজাতির হরিণের মাথা ঘোড়ার মতো, শিঙ হরিণের মতো, ঘাড় অনেকটা উটের মতো, এবং লেজ গাধার মতো। মিলু হরিণ শুধু চীনে দেখা যায়। এটি একটি বিরল প্রজাতির পশু।

আজকাল তুং থিং হ্রদ জলাভূমির ভিতরে, ঘাস ও শিশিরের মধ্যে একদল মানুষ মিলু হরিণের বাচ্চাদের দেখাশোনা করছেন; এগুলোকে বড় করে তুলছেন যত্ন সহকারে।

জলাভূমির ভিতরে সাধারণত অন্য মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে শোনা যায় পাখিদের কলকাকলি, ব্যাঙের ডাক, আর গাছের ডালপালার সর সর শব্দ। তবে সুং ইউয়ু ছেং এখানে অন্যরকমের একটি কণ্ঠ খুঁজছেন। এ-কণ্ঠ মিল হরিণের। ডক্তার সুং ইউয়ু ছেং মিলু হরিণের বাচ্চাদের যত্ন নিয়ে থাকেন।

মিলু হরিণ চীনের বিশেষ একটি পশু। একসময় ছাংচিয়াং নদী অববাহিকায় এই হরিণ ছিল অসংখ্য। কিন্তু শিকারীদের আক্রমণ ও বনের ক্ষয়ক্ষতির কারণে মিলু হরিণ বলতে গেলে বন থেকে হারিয়ে ঠাঁই পায় কয়েকটি রাজকীয় বাগানে। চীনের ছিং রাজবংশ আমলের শেষ দিকে ৮টি দেশের যৌথ বাহিনী চীনে আগ্রাসন চালা। তখন চীনের সবকটি বেঁচে-থাকা মিলু নানাভাবে মারা যায়। বিশ্বের একমাত্র ১৮টি মিলু হরিণ বৃটেনের একটি চিড়িয়াখানায় রক্ষা টিকে থাকে। ১৯৮৫ সালে চীন ব্রিটেনের চিড়িয়াখানা থেকে মিলু হরিণ আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। মিলু হরিণ ফিরে আসে তার জন্মভূমিতে।

এরপর বেইজিং, চিয়াং সু ও হু পেই প্রদেশে লালনপালন করা হয় মিল হরিণগুলো; ঘটানো হয় এদের প্রজনন। তবে আবহাওয়ার

সঙ্গে খাইয়ে নেওয়ার সমস্যাসহ অনেক সমস্যায় পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। ১৯৯৮ সালে চীনের ছাংচিয়াং নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। তখন একদল মিলু হরিণ হু পেই প্রদেশের সি সৌ শহর থেকে নদীপথে পৌঁছে যায় তুং থিং হ্রদে। ১১ বছর পর, ডাক্তার সুং ইউয়ু ছেং তুং থিং হ্রদে প্রথমবারের মতো মিলু হরিণের সন্ধান পান। সুং ইউয়ু ছেং এগুলোকে দেখে প্রথমেই মিলু হরিণ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এগুলো রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

ডাক্তারি পড়ার সময়ও সুং ইউয়ু ছেং বহুবার তুং থিং হ্রদে এসেছেন এবং পরে তিনি পূর্ব তুং থিং জাতীয় প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চলে কাজ করেন। বইয়ে মিলু হরিণ সম্পর্কে বর্ণনা কম। তাই তিনি নিজে থেকেই এই বিরল প্রাণীটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে নামেন। তিনি হ্রদ-এলাকায় একজন কৃষকের বাড়িতে বাস করা শুরু করেন এবং প্রতিদিন ৫ ঘন্টা মিল হরিণের খোঁজখবর করতেন। বিরূপ আবহাওয়ায়ও তাঁর রুটিনে পরিবর্তন হতো না। একবার তিনি টানা ৬ মাস মিলু হরিণের বিচরণক্ষেত্রে বসবাস করেন। একসময় মিলু হরিণগুলো তাঁকে খেয়াল করে। কিন্তু হরিণগুলো ভয় পায়নি। মিলু হরিণের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে সুং ইউয়ু ছেং একবার হু পেই প্রদেশের সি সৌ থেকে ৯টি জেলা ও শহর অতিক্রম করে পৌঁছান হু নান প্রদেশে। তিনি জানালেন, একবার মিলু হরিণকে অনুসরণ করে তিনি পৌঁছান একটি বাঁধের সামনে। রাতের গভীর অন্ধকারে তিনি কিছুই দেখতে পারছিলেন না। সামনে পানি, অথচ তিনি সাঁতার জানেন না; জানেন না জলাশয়ের পানির গভীরতা কতো! তথাপি তিনি পানিতে নামলেন এবং সামনে এগুতে লাগলেন। ভাগ্যক্রমে জলাশয়ের গভীরতম স্থানটি ছিল তার গলা পর্যন্ত গভীর।

 

শুধু মাঠে-ময়দানে মিল হরিণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হননি সুং ইউয়ু ছেং। তিনি বিপন্ন মিলু হরিণ উদ্ধার করে সেগুলোর লালনপালনকাজও করেছেন। তিনি বলেন, "মিলু হরিণের বাচ্চা খুবই মজার। এগুলর গায়ের রঙ হলুদ এবং গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ আছে। যদি মা আশেপাশে না-থাকে, তবে মিলু হরিণের বাচ্চা আপনাকে অনুসরণ করবে।"

সুং ইউয়ু ছেং মিলু হরিণের বাচ্চাকে দুধ পান করান। মিলু হরিণের একটি বাচ্চা প্রতিদিন ৭-৮ বার দুধ খায়। প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার আগ পর্যন্ত প্রতিটি বাচ্চার দুধের পেছনে গড়ে খরচ হয় ২০ হাজার ইউয়ান। তিনি যে বাচ্চাটিকে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে লালনপালন করছেন সেটির নাম তিয়ান তিয়ান। ২০১২ সালের মার্চ মাসে কেউ একজন ফোন করে জানান যে, মিলু হরিণের একটি বাচ্চাকে কুকুর তাঁড়া করেছে। সুং ও তার সহকর্মী সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যান এবং সেই বাচ্চাটিকে উদ্ধার করেন। মাত্র সপ্তাহ খানেক বয়স বাচ্চাটির। তখন থেকেই সুং ইউয়ু ছেং ও তার দল বাচ্চাটির দেখাশোনার দায়িত্ব নেয় এবং বাচ্চাটির নাম রাখেন তিয়ান তিয়ান। সেই বাচ্চাটি এখন বড় হয়েছে এবং তার নিজেরই সন্তান হয়েছে।

সুং জানান, তিয়ান তিয়ান মানুষ পছন্দ করে। মানুষ দেখলে সে ভয় পায় না। সে বন্য-জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। ফলে দীর্ঘকাল ধরে তাদের সঙ্গেই আছে। সাধারণত নারী মিলু হরিণ ৩ বছর বয়সে সন্তানধারণক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু তিয়ান তিয়ানকে কয়েকবার পুরুষ মিল হরিণের সঙ্গে মিলনের ব্যবস্থা করলেও, সে সন্তানধারণে ব্যর্থ হয়। সৌভাগ্যক্রমে, চলতি বছরের মার্চ মাসে তিয়ান তিয়ান মা হয়েছে এবং সবাই এতে খুব খুশী।

তুং থিং হ্রদে-এলাকায় বাস-করা মিলু হরিণের জন্য বৃহত্তম হুমকি হল বন্যা। বিশেষ করে বাচ্চা মিলু হরিণগুলোর জন্য। প্রতিবছর বন্যার মওসুমে সুং ও তার কর্মী সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। তারা বন্যায় আটকে-পড়া মিলু হরিণ বা হরিণের বাচ্চা খুঁজে বের করতে দিন-রাত নৌকায় করে ঘুরে বেড়ান। তারা বন্যা-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং কখনও কখনও মিলু হরিণদের জন্য খাবার সরবরাহ করেন।

অন্ত্রের রোগ মিলু হরিণের মৃত্যুর প্রধান একটি কারণ। মিলু হরিণের অবস্থা জানার জন্য সুং এগুলোর মল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। কোনো সমস্যা ধরা পড়লে তিনি হ্রদের পানিও পরীক্ষা করেন এবং মিলু হরিণের আবাসস্থলের কাছাকাছি হ্রদের পানিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ ছিটিয়ে দেন।

সুং ও তার সহকর্মীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিলু হরিণের অকাল মুত্যু এখনও সাধারণ ব্যাপার। তিনি বলেন, বন্য পরিবেশে বাস করা পশুদের চেয়ে মিলু হরিণ ভিন্ন। এগুলো মানুষের তত্ত্বাবধানে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন এগুলোর পক্ষে বন্য পরিবেশে টিকে থাকা কঠিন।

১৯৮৬ সালে মিলু হরিণ চীনে ফিরিয়ে আনা প্রকল্প চালুর পর থেকেই এদেশে মিল হরিণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন সেই সংখ্যা প্রায় ৪০০০। ২০১৫ সালে তুং থিং হ্রদ-এলাকায় মিলু হরিণের দলটি চীনে সবচেয়ে তরুণ ও টেকসই গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন তুং থিং হ্রদ-এলাকায় মিলু হরিণের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তিং মিং হ্রদ-এলাকার একজন কৃষক। তিনি পূর্ব তুং থিং হ্রদ মিলু সংরক্ষণ কমিটির একজন সেচ্ছাসেবকও বটে। তিনি জানিয়েছেন, হ্রদ অঞ্চলে তার মতো সেচ্ছাসেবক শতাধিক। মিলু হরিণের কোনো সমস্যা দেখতে পেলে তারা দ্রুত প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানান। মিলু হরিণবিষয়ক গবেষক তিং ইউয়ু হুয়া বলেন, "মিলু হরিণ চীনের বিশেষ একটি পশু। এরা একসময় চীনে মুক্ত জীবন যাপন করত। ছিং রাজবংশ আমলে এরা 'গৃহহারা' হয়ে গেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর এরা আবার মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছে। এদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে চীনা জাতির পুনরুত্থানের তুলনা চলে।"

সুং ইউয়ু ছেং সাংবাদিককে বলেন, "অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, মিলু হরিণের জন্য আমি কেন এতোকিছু করছি। আমি উত্তরে সবসময় বলি, মিলু র মতো দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী রক্ষার জন্য আমি আমার সবকিছু উত্সর্গ করতে প্রস্তুত।" (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040