0606
|
চলতি বছর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন চালুর ৭০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এ-উপলক্ষ্যে, শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে এ-মিশনকে সাহায্যকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে জাতিসংঘ। এই প্রামাণ্যচিত্রে জাতিসংঘের সাধারণ ছয়টি অফিসিয়াল ভাষা এবং সোহেলি ও পর্তুগিজ ভাষা ব্যবহার করা হয়।
১৯৯০ সাল থেকে চীন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ শুরু করে এবং এ-পর্যন্ত ৩৭ হাজার চীনা সৈন্য বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করেছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ-পর্যন্ত চীনের ১৩ জন সৈন্য প্রাণও হারিয়েছেন। বর্তমানে ২৫০৭ জন চীনা জাতিসংঘের ৭টি কর্মঅঞ্চলে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। এঁদের মধ্যে ২৪১৯ জন্য সৈন্য এবং ৮৮ জন সামরিক পর্যবেক্ষক ও স্টাফ অফিসার।
২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে চীনের দ্বিতীয় শান্তিরক্ষা দলটি লেবানন থেকে দেশে ফিরে আসে। এক বছরে এই দলটি ২৮১৫ বর্গমিটার এলাকা থেকে ৭৫৭টি মাইন অপসারণ করে, ৯৯টি স্থাপনা নির্মাণ করে, এবং দশ থেকে বারো হাজার লোককে চিকিত্সাসেবা প্রদান করে। জাতিসংঘ এ-বাহিনীকে শান্তির গৌরবময় পদকে ভূষিত করে।
গেল ২৮ বছরে চীন বড় দেশের দায়িত্ব পালন করেছে, বিশেষ করে বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে বিশ্বকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পালন করেছে বেইজিং।
১
৯৯০ সালে চীন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে প্রথম অংশগ্রহণ করে। মিশনে যুদ্ধবিরতির পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠানো হয় পাঁচ চীনা কর্মকর্তাকে। ১৯৯২ সালে ক্যাম্বোডিয়ায় ৪০০ সদস্যের চীনা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড যায় শান্তিরক্ষা মিশনে। এটিই ছিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে চীনের প্রথম বাহিনী।
বর্তমানে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্যদেশের মধ্যে চীনের শান্তিরক্ষীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। চীনা শান্তিরক্ষীরা এ-পর্যন্ত জাতিসংঘের ২৪টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয়; ১৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ বা পুনর্গঠন করে; ৯০০০টি মাইন বা অবিস্ফোরিত বস্তু অপসারণ করে; ২ লাখ মানুষকে চিকিত্সাসেবা দেয়; ১৩৫০ হাজার টন সামগ্রী ও উপকরণ পরিবহন করে; এবং এ-কাজে ভ্রমণ করে ১৩০০০ হাজার কিলোমিটার পথ। বর্তমান বিশ্বে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে চীনা শান্তিরক্ষীদের বিবেচনা করা হয় মূল শক্তি হিসেবে।
'
আমার কতোটা বিপদ হতে পারে, তা আগে বুঝতে পারিনি' বলেছেন চীনা শান্তিরক্ষী হাও ছাং ছিং। তিনি মালিতে চীনের চতুর্থ শান্তিরক্ষা বাহিনীর একজন সদস্য। একবার কর্তব্যরত হাও ছাং ছিং তার সামনে একটি পরিখায় অস্বাভাবিক নড়াচড়া দেখে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টা জানান। পর্যবেক্ষণে দেখা গেল, একজন জঙ্গি পরিখা থেকে তাদের ফাঁড়ি লক্ষ্য করে বন্দুক তাক করে বসে আছে। পরে এই জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার আস্তানা থেকে বিপুলসংখ্যক হাতবোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।
মালিতে চীনের চতুর্থ শান্তিরক্ষা বাহিনী ৫টি গাড়িবোমা হামলা ও ২০টি সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ করে। সুদানের দার্ফুরে চীনা বাহিনী হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনীর জন্য সৈন্য ও সামগ্রী পাঠায়। কঙ্গো কিনশাসার আদিম বনে চীনা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সৈন্যরা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে স্থানীয় মানুষদের জন্য রাস্তা নির্মাণ করে। লাইবেরিয়ায় সংক্রামক রোগের হুমকির মুখে দূরবর্তী গ্রামে গিয়ে বিনামূল্যে চিকিত্সা সেবা দেয় এবং বহু নারী ও শিশুর প্রাণ উদ্ধার করে চীনা শান্তিরক্ষীরা।
জাতিসংঘের নিরাপত্তাবিষয়ক উপ-সচিব বলেন, 'চীনা শান্তিরক্ষা বাহিনীর সৈনিকরা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাদের গুণগত মান ভাল এবং সাজসরঞ্জাম প্রথম শ্রেণীর। শান্তি রক্ষার কাজে চীনের অবদান উল্লেখযোগ্য।'
গেল কয়েক বছর ধরে চীন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে। চীনের ৮০০০ স্ট্যান্ডবাই শান্তিরক্ষী আছে এবং আছে ২টি স্থায়ী শান্তিরক্ষা পুলিশদল। ২০১৭ সালে এরা জাতিসংঘে নিবন্ধিত হয়।
স্ট্যান্ডবাই শান্তিরক্ষা বাহিনীতে রয়েছে ২টি ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড, ২টি পরিবহন ব্রিগেড, ৪টি চিকিত্সা ব্রিগেড, ২টি হেলিকপ্টার ব্রিগেড, এবং দুটি পরিবহন বিমান ব্রিগেড। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা প্রশিক্ষণ কোর্স এবং বিদেশে বিশেষজ্ঞ পাঠানোর মাধ্যমে নানা দেশের ১০০০ জনকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে চীন। বস্তুত চীন ব্যাপক ও গভীরভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে অংশ নেয় এবং বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ব্লু লাইন হচ্ছে লেবানন ও ইসরাইলের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি লাইন। লেবানন ও ইসরাইল এখানে কয়েক লাখ মাইন পুঁতে রেখেছে। খুব বিপজ্জনক এ-অঞ্চলকে 'মৃত্যু-উপত্যকা' বলে ডাকা হয়। লেবাননে নিযুক্ত চীনা শান্তিরক্ষা বাহিনী এখানকার ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা থেকে প্রায় এক হাজার মাইন অপসারণ করেছে। লেবাননে শান্তিরক্ষা মিশনের কোনো বাহিনীই এতো বেশি মাইন অপসারণ করেনি।
কয়েক কেজি ওজনের প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে একেকজন শান্তিরক্ষীকে অনেকটা সময় ধরে হাঁটু গেড়ে বসে মাইন তোলার কাজ করতে হয়। প্রতিদিন তারা ৭ ঘন্টার বেশি কাজ করেন এবং এ-কাজে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সামান্য ভুল তাদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।
২০১৮ সালের বসন্ত উত্সবের সময়টায় চীনা শান্তিরক্ষীদের অবস্থান করতে হয়েছিল লেবাননে। লিয়াও ছিং হুয়া তাদের মধ্যে একজন সাধারণ সৈনিক। তিনি বলেন, পরিবারের সঙ্গে উত্সব উপযাপন করতে না-পারলেও একজন চীনা সৈনিক হিসেবে তিনি গর্বিত। কারণ, তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অথচ অর্থবহ দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
২০১৬ সালের পয়লা জুন ভোর ৪টা ৫০ মিনিট। ঠিক তখন মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের অফিস বোমা-হামলার শিকার হয়। এতে ২৯ বছর বয়সী চীনা সৈন্য সেন লিয়াং লিয়াং প্রাণ হারান। দু'বছর পর, একই দিনে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরহিস মালিতে একটি স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং বিভিন্ন সময় শান্তি রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণদানকারী সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
২০১৮ সালের মে মাসে চীনের ৬ষ্ঠ শান্তিরক্ষা দলটি মালিতে পৌঁছায়। সৈনিক ইউয়ে চেন ইন চতুর্থবারের মতো বিদেশে এ-দায়িত্ব পালনের জন্য আসেন। তিনি বলেন, "চীনা শান্তিরক্ষীরা দেশের ভাবমূর্তির প্রতীক। চীনা সৈনিকরা কোনো কষ্ট বা বিপদে ভয় পায় না। তাঁরা বিশ্বের সামনে চীনা মানুষের আন্তরিকতা তুলে ধরে এবং দায়িত্বশীল বড় দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।"
(শিশির/আলিম)