ঢাকায় চীনা কোম্পানি আয়োজিত এক বিশেষ বিদায় অনুষ্ঠান
  2018-05-18 15:34:35  cri


গত ১০ মে সকালে আমি ঢাকায় এক বিশেষ বিদায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানের প্রধান চরিত্র হলেন ৭৬ বছর বয়স্ক মো: মাহফুজুর রহমান। তিনি চীনের পরিবহন নির্মাণ লিমিডেট কোম্পানিতে ২৫ বছর কাজ করেছেন। তিনি এ কোম্পানির ব্যবস্থাপক নন, একজন সহকারী মাত্র। তিনি চীনা সহকর্মীদের সঙ্গে ২৫ বছর ধরে কাজ করলেও ইংরেজী তেমন বলতে পারেন না, চীনা ভাষা বলা দূরের কথা। তা সত্ত্বেও চীনা সহকর্মীরা তাঁকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মনে করেন।

চীনের পরিবহন নির্মাণ লিমিডেট কোম্পানির ঢাকা অফিসের ব্যবস্থাপকের সহকারী ফাং ডাং জিই বিদায় অনুষ্ঠানে বলেন, "মো: মাহফুজুর রহমান আমাদের অফিসে ২৫ বছর কাজ করেছেন। আমাদের কোম্পানির বাংলাদেশ কার্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে তিনি যোগ দেন। প্রথমে আমাদের কোম্পানি কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুক্তির ক্ষুদ্র সড়ক নির্মাণ করতো। এরপর বাংলাদেশে আমরা ছয়টি মৈত্রী সেতু নির্মাণ করি। এখন আমরা চট্টগ্রামে ৭০ কোটি মার্কিন ডলারের কর্ণফুলি নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করছি। গেল ২৫ বছরে মাহফুজুর স্বচক্ষে দেখেছেন, আমাদের কোম্পানি ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়েছে এবং এক একটি সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে আমাদের কোম্পানির বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা সবাই মাহফুজুরের সঙ্গে কাজ করেছেন।"

(মো: মাহফুজুর রহমানকে  বন্ধুত্বের পতাকা তুলে দিচ্ছেন পাং মিং) 

মাহফুজুর একটু কম কথা বলেন, তিনি সবার সঙ্গে সবসময় হাসি মুখে কথা বলেন। বিদায় অনুষ্ঠানে তাঁকে কিছু বলতে সুযোগ দিলে তিনি হাত দিয়ে গুণে দেখালেন কয়জন চীনা বস ও সহকর্মী তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে কোন সালে এ কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, "এ কোম্পানি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আসে, আমি ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কোম্পানিতে যোগ দিই। তখন থেকে এ পর্যন্ত আমি এখানেই আছি।"

(২৫ বছরের আগে পাং মিং আর মো: মাহফুজুর রহমানের ছবি)

মাহফুজুর এ কোম্পানিতে একজন দৃষ্টান্তমূলক কর্মী হিসেবে সকলের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কারণ তিনি সবসময় সবার আগে অফিসে আসেন। সবসময় হাসি মুখে কাজ করেন। তাঁর ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রের কারণে চীনা সহকর্মীরা তাঁকে যেকোন কাজ দিতে দ্বিধা করেন না। এমনকি, এ কোম্পানির ঢাকা অফিস প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে একটানা কয়েক বছর কেবল একজন চীনা কর্মী ছিলেন। সে সময় মাহফুজুর ছিলেন একমাত্র বাঙালী কর্মী। তাঁরা পরস্পরের সঙ্গী হয়ে সবসময় পরস্পরকে সহযোগিতা ও সাহায্য করতেন। সে সময় রাতের বেলা তিনি অফিসে থাকতেন। চীনা কর্মী বলেন, মাহফুজুরকে দেখে, একা একা বাংলাদেশে থাকলেও ভয় পেতাম না। তিনি খুব কম কথা বললেও তাকে নিজের পরিবারের সদস্যের মতো মনে করেন। বিশ বছর আগে কাজের মাঠে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গাড়ির ধাক্কায় এক চীনা সহকর্মী মাটিতে চাপা পড়ে যায়। মাহফুজুর খালি হাতে জোর করে চীনা সহকর্মীকে মাটি থেকে বের করে দ্রুত নিজেই গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে তিনি বেঁচে যান। এসব ঘটনা স্মরণ করতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছু বলেন না।

(পাং মিন মো: মাহফুজুর রহমানকে স্যাস পড়িয়ে দিচ্ছেন)

বিদায় অনুষ্ঠানে চীনা পরিবহন নির্মাণ লিমিডেট কোম্পানির বাংলাদেশ অফিসের প্রধান ফাং মিং মাহফুজুরকে স্মারক ব্যানার এবং অতিরিক্ত দু'বছর বেতনের চেক দিয়েছেন। তিনি বলেন, "ঢাকা অফিস প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে এখানকার চীনা কর্মীর সংখ্যা কম ছিল। মাহফুজুর আমাদের অফিসের তত্ত্বাবধায়কের মতো সব কাজে সাহায্য করতেন। এক রাতে অফিসের বিদ্যুতের তার থেকে ধোঁয়ার গন্ধ বের হয়। মাহফুজুর সময় মতো তা বুঝতে পেরে অগ্নিকাণ্ড রোধ করেন।"

মাহফুজুরের বড় ছেলে সার্জেন্ট শাহাজাহান চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বিদায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তিনি সিআরআই'র সংবাদদাতাকে বলেন, বাবার সম্মানে এমন একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে তিনি খুব খুশি। পরিবারের কেউ ভাবেননি, চীনা কোম্পানিতে বাবা এতো বছর ছিলেন এবং এখানে তিনি এত জনপ্রিয়। বাবার জন্য তিনি গর্বিত বোধ করেন।

 

(মো: মাহফুজুর রহমান ও তাঁর ছেলে)

চীনা এ কোম্পানিতে ঢাকা অফিসের প্রযুক্তি ব্যবস্থাপক অপুর্ব কুমার সাহা বিদায় অনুষ্ঠানে বাঙালী কর্মীদের প্রতিনিধি হিসেবে বলেন, "এই কোম্পানিতে আমরা কেউ চীনাও না, বাঙালীও না। আমরা এ কোম্পানির লোক, আমরা পরস্পরকে সম্মান করি। আমরা একই পরিবারের সদস্য।"

বাংলাদেশে অনেক চীনা কোম্পানি নানা প্রকল্পে কাজ করে আসছে। কাজের সুফল হিসেবে আমরা সড়ক, সেতু, সম্মেলন কেন্দ্রসহ নানা স্থাপত্য দেখতে পাই। আরো অনেক বিষয় আমাদের চোখ না পড়লেও সেটা বাস্তব অস্তিত্ব, সেটা হলো দু'দেশের জনগণের মৈত্রী আর সমঝোতা। আশা করি, ভবিষ্যতে এমন উষ্ণ মুহূর্ত আরো বেশি করে আপনাদের জানাতে পারব।

(আনন্দী/মহসীন)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040