বন সৃজনে বৃক্ষপ্রেমী ওয়াং শু ছিং কোঁজ'র জীবন উৎসর্গের অসাধারণ গল্প
  2018-01-31 14:38:00  cri



শীতকালীন সময়। ঘন গাছ মুকুটের মধ্য দিয়ে পুরু তুষারে ঠিকরে পড়ছে চকচকে রোদ। বন্য হরিণ ছুটাছুটি,লাফালাঠি করে খেলছে। এ দৃশ্য দেখে ৭২ বছর বয়সি ওয়াং শু ছিং কোঁজ'র মুখে ফুটে ওঠে হাসি। দীর্ঘসময় উন্মুক্ত স্থানে কাজ করার কারণে তাঁর হাত দুটো কর্কশ আর বলিষ্ঠ। কৃত্রিম বনের দিকে হাত তুলে ওয়াং শু ছিং গর্বভরে বলেন, আমার এ জীবন স্বার্থক, সুযোগ্য।

চীনের হে লং চিয়াং প্রদেশের কিকিহার শহরের পাই ছুয়ান জেলা, চীনের 'সান পেই' আশ্রয়বেল্ট পূর্ব লাইনের গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা এবং চীনের সমতল ভূমিতে প্রথম এক'শ মু (৬.৬৭ হেক্টর) বড় কৃত্রিম বন।

৫০ বছর আগে পাই ছুয়ান জেলা ছিল বৃক্ষহীন ভূমি। গাছ ছাড়া বাতাস সরাসরি জমি থেকে বীজ উড়িয়ে নিয়েছে। এখানে ছিল উর্বর কালো জমি তবে কালো মাটিও বাতাসে হারিয়ে গিয়েছিল। একটি গ্রামের ৫০টি পরিবারের বাড়িঘর পানি ও ভূমি ক্ষয়ের কারণে ধস হয়েছে। ওয়াং শু ছিং ছিলেন পাই ছুয়ান জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক। তিনি বলেন, তখনকার সারা জেলায় ২০ হাজারটি ক্ষয়িষ্ণু পরিখা, এ জমিতে কোন ফসল চাষ অসম্ভব ছিল। তবে স্থানীয় মানুষ বৃক্ষ রোপণের ওপর তেমন গুরুত্ব দেয় নি। ওয়াং শু ছিং বলেন,১৭ বছর বয়স থেকে আমি বুঝতে পারি যে গাছ কত গুরুত্বপূর্ণ। আমার গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক গাছের ওপর গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর এ মানসিকতা আমার উপর প্রভাব ফেলে।

পরে ওয়াং শু ছিং নেতা হন এবং তিনি অন্যদের নিয়ে বৃক্ষ রোপণ করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। তবে কেউ তাকে সমর্থন দেননি। বন সৃষ্টি করতে চাইলে বেশ সময় লাগে এবং এটা জেলার নেতার দায়িত্বও নয়। তবে একরোখা মানুষ ওয়াং শু ছিং চেষ্টা পরিত্যাগ করেননি। প্রতি সকালে নিয়মিত সম্মেলন শেষ করে তিনি সাইকেল চালিয়ে গ্রামে এক একটি পরিবারের কাছে গিয়ে রাজি করান। সাধারণ মানুষদের সরকারের প্রতিজ্ঞা দেখানোর জন্য তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে কৃষকরা যত কাজ করে জেলার নেতারাও তত কাজও করে।

১৯৭৮ সালে চীনে চালু হয় সান পেই আশ্রয়বেল্ট প্রকল্প এবং ওয়াং শু ছিংয়ের নেতৃত্বে লক্ষ পার্টি সদস্য ক্যাডার ও সাধারণ মানুষ ৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমটার ভূমিতে বৃক্ষ রোপণ শুরু করেন। ওয়াং শু ছিং প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৩টায় জেগে উঠে বৃক্ষ রোপণ স্থলে যান। কী ধরণের গাছ রোপণ করা হবে, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ, তাঁর মাথায় কৃত্রিম বন ছাড়া আর কিছুই নেই।

দীর্ঘসময় এ কাজ করার ফলে ওয়াং শু ছিং বিশেষ দক্ষতা আয়ত্ত করেন। একবার স্পর্শ করলে তিনি বুঝতে পারতেন এ গাছ বেঁচে থাকতে পারেবে কি না।

১৯৭৯ সালে ওয়াং শু ছিং শেন ইয়াং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ৬ মাসের মতো লেখাপড়া করেন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো শুনেছেন ইকোলজি শব্দটি এবং মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সম্পর্কও তিনি বোঝেন। জেলায় ফিরে আসার পর ওয়া শু ছিং গাছ রোপণ নিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সারসংকলন করেন। তিনি আবিষ্কার করেন 'তিন প্রতিরক্ষা ব্যুহ' বৃক্ষ রোপণ পদ্ধতি। প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন হল পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের ওপরে গাছ রোপণ করা, তারপর চাষযোগ্য জমি ও বনের সীমান্তে পরিখা খনন, পাহাড়ের পানি এখানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইন হল সিড়ির ধাপের মত থাককাটা মাঠ। বৃষ্টির পানি পাহাড়ে জমা হয়ে রক্ষা হয়। তৃতীয়টি লাইন হল ক্ষয়িষ্ণু পরিখায় গাছ রোপণ করা। তিনটি লাইনের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার পানি পাহাড় থেকে অবশেষে প্রবাহিত হয় জলাধারে।

২০০৭ সালে ওয়াং শু ছিং কিকিহার শহরের উপ মেয়র হিসেবে অবসরে যান তবে তিনি বিশ্রাম নেননি। দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে তিনি ফিরেছেন পাই ছুয়ান জেলায় এবং একজন স্বেচ্ছাসেবক বনরক্ষী হন। তিনি বলেন, তিনি নানা পর্যায়ের নেতা ছিলন তবে তাঁর জন্য বনরক্ষী সবচেয়ে গর্বিত একটি উপাধি। বয়সের কারণে তিনি এখন যেখানে সেখানে যেতে পারেন না তবে নানা জেলা বা গ্রামে তাঁর অনেক 'সহকারী' আছেন। যদি একটি জায়গায় গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবাই ওয়াং শু ছিংকে ফোন করে জানান।

আরও বেশি মানুষকে পাই ছুয়ান জেলার প্রাকৃতিক নির্মাণের ইতিহাস জানাতে এবং সবুজ ধারণা প্রচার করার জন্য ওয়াং শু ছিং নিজের খরচে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রাকৃতিক সংস্কৃতি যাদুঘর।

কর্মীর সঙ্গে তিন তলা এ যাদুঘর নির্মাণ করেন ওয়াং শু ছিং। যেখানে লাগানো ছবিগুলো সব ওয়াং শু ছিং নিজের বাছাই করা। তিনি বলেন, এ ছবি দেখে যেন আবার তাঁর জীবনে ফিরে যান।

যাদুঘর নির্মাণের জন্য ওয়াং শু ছিংয় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। যাদুঘরে গাইড নিয়োগ করার অর্থ নেই, তিনি প্রতিবছর নিজে গাইড হিসেবে শতাধিক বারের মতো দর্শকদের কাছে তুলে ধরেন পাই ছুয়ান জেলার ইতিহাস।

৫০ বছর ধরে ওয়াং শু ছিংয়ের নেতৃত্বে নির্মাণ হয়েছে ১২.৩ লাখ মু (৮২ হাজার হেক্টর) কৃত্রিম বন। জেলার বনায়নের হার ৩.৭ শতাংশ থেকে বেড়েছে ২৩.৭ শতাংশ। ফসল উত্পাদনের পরিমাণ প্রতি মুতে ৫০ কেজি থেকে বেড়েছে ৪০০ কেজি।

পাই ছুয়ান জেলায় রাস্তা, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ বাড়িঘর নির্মাণের অর্থ গ্রামের বাসিন্দাদের নিজের খরচের বদলে সব কৃত্রিম বনের পাকা বৈধ গাছ বিক্রি থেকে এসেছে।

বনে এসেছে বন্য হরিণ এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বন্য হরিণ সংরক্ষণ অঞ্চল। বন্য হরিণের সংখ্যা দশ বারোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০০।

কৃত্রিম বন এখন মানুষকে প্রকৃতির উপহার প্রদান করছে।

ওয়াং শু ছিং এখন বৃদ্ধ, তাঁর সাদা চুলের বিনিময়ে পাওয়া গেছে পাই ছুয়ান জেলার সবুজ পাহাড় ও নদী ।

ওয়াং শু ছিং যেমন তরুণ, তাঁর মনোবল কখনও পুরাতন হবে না।

(শিশির/মহসীন)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040