চীনের ইউয়ুননান প্রদেশের 'বরফ বালকের' গল্প
  2018-01-22 13:45:35  cri

 


বন্ধুরা, সম্প্রতি চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত একটি ছবি বিশ্বের কোটি কোটি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি ছেলে হাল্কা কাপড় পড়ে মাইনাস ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে তার ক্লাসরুমে পৌঁছায়। এসময় তার সারা শরীর ও মাথায় তুষার জমে যায়। তুষার জমা বন্ধুটিকে দেখে সহপাঠীরা অবাক হয়ে ওঠে। তারা ওই বন্ধুর ছবি তুলে তা বিভিন্ন মাধ্যমে শেয়ার করে। এভাবে ওই ছেলেটির ছবি বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের নজরে আসে। এরপর চীনের গণমাধ্যমগুলো ওই ছেলে ও তার বাবার সাথে যোগাযোগ করে এবং সাক্ষাত্কার নেয়। আজ আমরা তাদের গল্প আপনাদের সঙ্গে একটু শেয়ার করবো।

এই ছেলের নাম ওয়াং ফু মান। তার বয়স মাত্র ৮ বছর। সে চীনের ইউয়ুননান প্রদেশের লুতিয়ান জেলার সিনচিয়ে উপজেলার চুয়ানশানবাও প্রাথমিক স্কুলের একজন ছাত্র। প্রতিদিন তাকে বাসা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। সেদিনও এই ছেলেটি মাইনাস ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায়। এসময় তীব্র শীতে তুষার জমা হয় তার মাথায়।

চীনের গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে দূরবর্তী এলাকায় ওয়াং ফু মানের মতো অনেক ছেলেমেয়ে আছে। তাদের বাবা জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে বড় শহরে চাকরি করে এবং এ জন্য পুরো পরিবার একসাথে থাকতে পারে না।

বর্তমানে এ ধরনের পরিবারের শিশুদের জীবনযাপনের অবস্থার ওপর ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে চীনা সমাজ। এ ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর স্থানীয় অঞ্চলের সরকার ঠাণ্ডা পাহাড়াঞ্চলের স্কুলে প্রয়োজনীয় হিটিং ব্যবস্থা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা শীতের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে সুন্দরভাবে শীতকাল কাটাতে পারে।

আসলে শুধু মাথায় বরফ জমে থাকাই এ ছেলেটির বিখ্যাত হবার একমাত্র কারণ নয়, এর পিছনে আরো অনেক বিষয় যুক্ত আছে। তার বাবা-মা বাইরে থাকে বলে পরিবারের সব কাজ তাকেই করতে হয়। নিজের জামাকাপড় পরিষ্কার করা, রান্না করা এসব কাজ সে নিজেই করে থাকে।

অন্যান্য দিনের মতো সেদিন সে তার মোটাকাপড় পরিষ্কার করে শুকাতে দিয়েছিলো। কিন্তু তীব্র শীতের কারণে সে জামাকাপড় শুকাতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই সে সেদিন মাইনাস ৯ ডিগ্রি তাপমাত্রায় হাল্কা কাপড় পড়েই স্কুলে যায়। তীব্র শীতে জামাকাপড় পরিষ্কার করা ও হাতে কোনো কিছু না পড়ে স্কুলে আসার কারণে তার হাত ফুলে ওঠে।

আসলে ওয়াং ফু মানের অদম্য ইচ্ছাশক্তিই মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে। সবাই তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যান।

পরিবারের সদস্য সম্পর্কে ওয়াং ফু মান বলে, বর্তমানে তার পরিবারে শুধু নানী ও বোন আছে, তবে নানী নিয়মিত আত্মীয়স্বজনের বাসায় যান। সেজন্যে অধিকাংশ সময় শুধু তার বোন ও সে বাসায় থাকে। তারা নিজেরাই সংসারের সব কাজ করে ও নিজেদের যত্ন নেয়। বোনের স্কুলের হোমওয়ার্ক বেশি থাকলে ফু মান রান্না করে, আর যদি তার হোমওয়ার্ক বেশি থাকে, তাহলে বোন রান্না করে।

বাসা থেকে স্কুল যাওয়ার সময় সম্পর্কে ফু মান বলে, হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে প্রায় ৪২ মিনিট সময় লাগে, তবে রাস্তাটি পাকা নয়, কাঁচা। রাস্তাটি শীতকালে অনেক পিচ্ছিল হয়, অনেক সাবধানে হাঁটতে হয়। সে এক সেমিস্টারে দশবারেরও বেশি এ রাস্তায় পড়ে গেছে।

ছবি তোলার দৃশ্যকে স্মরণ করে ফু মান বলে, 'আমি সকাল ৭টা ৫০ মিনিট বাসা থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই, সেইদিন স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো। এদিন প্রচণ্ড শীত ছিলো আর রাস্তাও ছিলো পিচ্ছিল, অনেক কষ্ট করে স্কুলে পৌঁছাই। ছবিতে আমার দুটি হাল্কা কাপড় দেখা যায়, আমার তিনটি বড় কাপড় আছে, তবে পরিষ্কার করা হয় নি, সেই জন্যে শুধু হাল্কা কাপড় পড়ে স্কুলে যাই।'

ফু মান বলে, ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে কাপড় পরিষ্কার করতে পারিনি, মাথায় জমে থাকা বরফও খেয়াল করিনি। আমি শুধু ঠাণ্ডা অনুভব করেছি। মাথার চুলের কি অবস্থা তাও খেয়াল করিনি, আমি শুধু তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে চেয়েছি, কারণ পরীক্ষা শুরু হবে।

ক্লাসরুমে সহপাঠীরা তার মাথা দেখে কি করেছে, সে সম্পর্কে ফু মান বলে, তখন আমি ক্লাসরুমে প্রবেশ করেছি, সবাই আমাকে দেখে হাসাহাসি করে এবং এবং শিক্ষক আমার ছবি তোলেন। তখন আমার কোনো অনুভূতি নেই, কারণ ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আমার হাত ও শরীর ইতোমধ্যে জমে গেছে। মাথার বরফ স্পর্শ করার সময় প্রচণ্ড শীত অনুভব করি।

স্কুলের পরিবেশ ও হিটিং ব্যবস্থা নিয়ে ফু মান জানায়, তাদের স্কুল অনেক ঠাণ্ডা, ক্লাসরুমে কোনো হিটিং ব্যবস্থা নেই, বাসায় তারা চুলা জ্বালিয়ে রাখতে পারে, তবে ক্লাসরুমে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।

এমন কঠোর পরিস্থিতিতে কেন স্কুলে যেতে চায় সে? এ সম্পর্কে ফু মান বলে, আমি লেখাপড়া করতে চাই, আমি গণিত বেশ পছন্দ করি, গণিত শিখতে আমার বেশ মজা লাগে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিজের ছবি বিখ্যাত হয়ে ওঠার ব্যাপার নিয়ে ফু মানের খুব বেশি ধারণা নেই। লোকজন এ ঘটনা জানার পর কি ধরনের পরিবর্তন ঘটবে তা নিয়েও তেমন ভাবনা নেই তার।

ফু মান বলে, আমি শুধু ভালোভাবে লেখাপড়া করতে চাই। তাড়াতাড়ি শীত্কালীন ছুটি আসবে, তখন আমি খুনমিংয়ে বেড়াতে চাই, আর পরীক্ষায় পাস করে বড় হওয়ার পর বেইজিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই।

ফু মানের বাবা ওয়াং কাং খুই দীর্ঘদিন ধরে ইউয়ুননান প্রদেশের রাজধানী খুনমিংয়ে চাকরি করেন। ফু মানের ছবি ওয়েবসাইটে জনপ্রিয় হওয়ার পর অনেকে তাঁর পরিবারকে অর্থ সহায়তা দিতে চান। তবে এ সম্পর্কে তিনি নিজের মতামত প্রকাশ করেন। অন্যদের সাহায্য পেয়ে তাঁর ছেলের উপার্জন না করার অভ্যাস তৈরি হোক, তা তিনি চান না। তিনি চান তাঁর ছেলে নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করুক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিজের ছেলের ছবি দেখে কি ভেবেছেন? এ সম্পর্কে ফু মানের বাবা বলেন, কয়েক দিন আগে আমি খুনমিংয়ে নির্মাণ প্রকল্পে বালি সরানোর কাজ করছিলাম, তখন আমার সহকর্মী আমাকে এ ছবি দেখান, তখন আমি একটু অবাক হয়েছি, এটা আমার ছেলের ছবি! তখন ভাবি, তার মাথায় সাদা বরফ জমে গেছে, আমি বুঝতে পারি তার কত ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি তখন মনে অনেক আঘাত পাই এবং রাতে বাসায় ফিরে যাই।

পরিবারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে ফু মানের বাবা বলেন, আমাদের বাসায় একটি গাড়ি কেনা হয়, তবে পরে সেটা আটক রাখা হয়। ফলে সস্তা দামে একটি ভ্যান গাড়ি কেনা হয় এবং তা প্রতিদিন নির্মাণ প্রকল্পে বালি সরানোর কাজে ব্যবহার করি। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০০ ইউয়ান পাওয়া যায়, মাসিক বেতন ৩০০০ ইউয়ান।

নিজের বাচ্চাদের জীবনযাপন সম্পর্কে বাবা বলেন, আমি খুনমিংয়ে যাওয়ার আগে বাসায় চালসহ বিভিন্ন খাবার কিনে রেখে এসেছি। বাসায় শাকসবজিও রাখা আছে।

বাসায় বাচ্চাদের যত্ন করার ব্যাপার নিয়ে বাবাও অনেক উদ্বিগ্ন। তিনি সবসময় বাচ্চাদের সাথে থাকতে চান। কিন্তু নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে তিনি প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি ইউয়ান ঋণ নিয়েছেন। তিনি এ ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে চান। দ্রুত ঋণ পরিশোধ ও পরিবারের সুন্দর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে তিনি গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজ করতে এসেছেন।

তথ্যমাধ্যমের কারণে ফু মান জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর কি কি পরিবর্তন ঘটেছে? এ সম্পর্কে তার বাবা বলেন, এ কয়েক দিন ফু মানকে দেখে মনে হয়েছে সে অনেক আনন্দিত এবং আগের চেয়ে বেশি কথা বলছে। সে ভালোভাবে লেখাপড়া করছে ও অন্যদের সাহায্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।

অনেক অপরিচিত লোক তাদের পরিবারের অবস্থা জানার পর অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন, তবে ফু মানের বাবা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতিরিক্ত সাহায্যের কারণে তাঁর ছেলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি উদ্বিগ্ন। বিনা প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন করার অভ্যাস তৈরি করাতে চান না তিনি।

জানা গেছে, ওয়াং ফু মানের স্কুলে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৬৭ জন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পিতামাতার সাথে থাকে না। তবে স্কুলে কোনো হোস্টেল ব্যবস্থা না থাকার কারণে তাদেরকে প্রতিদিন বাসা থেকে স্কুলে যেতে হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে, যাদেরকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা হাঁটতে হয়।

স্কুলের প্রধান ফু হেং বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত চুয়ানবাওশান প্রাথমিক স্কুলে অফিস ভবন, খেলার মাঠ, ক্যান্টিন ও ল্যাবসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের লাঞ্চের জন্য বার্ষিক ৮০০ ইউয়ান প্রদান করা হয়েছে। তবে বাজেটের কারণে এ পর্যন্ত কোনো হিটিং ব্যবস্থা চালু করা হয় নি এবং দূরবর্তী এলাকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য হোস্টেল স্থাপন করা হয় নি। তবে এবারের বসন্ত উত্সবের পর হোস্টেল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে এবং তখন ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলের সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হবে।

'বরফ বালকের' খবর দেখে ইউয়ুননান প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টির যুবশাখা ওই স্কুলটিতে ১ লাখ ইউয়ান সমমানের ত্রাণসামগ্রী পাঠায়। এ ছাড়া, অন্য কোম্পানি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গরম জামাকাপড় ও হিটিং যন্ত্রপাতি প্রদান করে।

চীনের ইউয়ুননান প্রদেশের শাওথুং শহরের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, শাওথুং এলাকা চীনের গভীর দরিদ্র এলাকাগুলোর অন্যতম। এতদাঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি।

এ সম্পর্কে চীনের হুয়ানান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি কার্য মূল্যায়ন কেন্দ্রের পরিচালক জেং ফাং হুই বলেন, বর্তমানে চীনের দরিদ্র এলাকায় বিশেষ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার, তবে শাওথুং এলাকায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, আত্ম-উন্নয়নের দক্ষতা দুর্বল, তাই এ অর্থ বেশ কার্যকর হয় নি। যদিও 'বরফ বালকের' গল্প অনেককে মুগ্ধ করেছে, তবে দরিদ্রতার কারণে পিতামাতার সাথে না থাকার সমস্যা আরো গুরুতর। তিনি স্থানীয় অঞ্চলের সরকারকে এ বিষয়ে আরো বেশি সুযোগ সুবিধা প্রদান করে দরিদ্র পরিবারের পিতামাতার কর্মসংস্থান সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, 'বরফ বালকের' গল্প নিয়ে বাংলাদেশের 'প্রথম আলো' পত্রিকাও একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আসলে চীনের দারিদ্র্য বিমোচন যুদ্ধে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তবে বাকি ৩ বছরের মধ্যে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্তকরণ একটি বিশাল ও জটিল ব্যাপার। এতে সমাজের বিভিন্ন পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

(সুবর্ণা/টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040