হাম্বানটোটা বন্দর: চীন-শ্রীলঙ্কা সহযোগিতার নিদর্শন
  2018-01-13 18:02:08  cri



শ্রীলঙ্কার সর্ব-দক্ষিণে নির্মাণাধীন হাম্বানটোটা বন্দর অবস্থিত। বন্দর থেকে মাত্র ১০ নটিকেল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক শিপিং রুট।

২০১৭ সালের শুরুর দিকে হাম্বানটোটায় শ্রীলঙ্কা-চীন শিল্প এলাকার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। আর বছরের শেষ দিকে, শ্রীলঙ্কা-চীন যৌথ উদ্যোগে, হাম্বানটোটা বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এভাবে ২০১৭ সালে দু'দেশের সহযোগিতার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।

হাম্বানটোটা বন্দরের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিএইচইসি)-র পক্ষ থেকে আসা প্রকল্পের সহকারী ম্যানেজার লিউ চাওহুই জানালেন, প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ প্রায় শেষ হবার পথে। আগামী মে মাসের মাঝামাঝিতে এ-কাজ পুরোপুরি শেষ হবে।

২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর চীন ও শ্রীলঙ্কা যৌথভাবে হাম্বানটোটা বন্দর পরিচালনা করা শুরু করে। আরও স্পষ্ট করে বললে, শ্রীলঙ্কা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চায়না মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস যৌথভাবে বন্দর পরিচালনা করছে।

বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রার দিন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রানিল ভিক্রমাসিংহে আশা প্রকাশ করেন যে, শ্রীলঙ্কা-চীন যৌথ পরিচালনায় এ বন্দর দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের মুখ দেখবে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগর আরেকটি নতুন বন্দর পাচ্ছে।

হাম্বানটোটা বন্দরের ভবিষ্যত নিয়ে দু'পক্ষই আশাবাদী। সিএম পোর্ট-এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাং থিয়ান সিনহুয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমরা হাম্বানটোটাকে প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে সংযোগের কেন্দ্র বানাতে চাই। এটা শ্রীলঙ্কার জাতীয় লক্ষ্য,আর পরিচালক হিসেবে আমাদের মিশন।"

হাং থিয়ান আরও বলেন, "আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, হাম্বানটোটা বন্দর শ্রীলঙ্কার শিপিং ইন্ডাস্ট্রিতে কলম্বো বন্দরের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কারণ, হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের বেশি কাছে অবস্থিত। চীনের সেনচেনে বন্দর পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে সিএম পোর্ট-এর। এ অভিজ্ঞতা হাম্বানটোটা বন্দরে কাজে লাগানো হবে।"

হাম্বানটোটার কুড়ি কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কার সাউদার্ন হাইওয়ে এক্সটেনশান প্রজেক্ট। চীনা ও লঙ্কান কর্মীরা এই হাইওয়ে নির্মাণের কাজ করছেন। এর মধ্যে আছে সেতু তৈরির কাজ। এটি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিএইচইসি)-র প্রকল্প। প্রকল্পে সিএইচইসি'র প্রতিনিধি ইয়াং সেনইয়াং বললেন, "নির্মাণক্ষেত্রের কাছাকাছি জঙ্গলে হাতি, ময়ূর, ও বানর বাস করে। ফলে, আমাদের কাজ করতে সমস্যা হয়। তারপরও আমরা ২০১৭ সালে প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ করতে সক্ষম হয়েছি।"

ইয়াং আরও বলেন, "বন্যপ্রাণীরা মানুষ ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই, আমরা চেষ্টা করেছি যাতে এখানকার বন্যপ্রাণীদের বিচরণ বাধাগ্রস্ত না-হয়। আর এ লক্ষ্যে আমরা দু'টো বিশেষ সেতু নির্মাণ করেছি। এই সেতুগুলোর নীচ দিয়ে বণ্যপ্রাণীরা অবাধে যাতায়ত করতে পারবে।"

হাম্বানটোটার ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত সাউদার্ন হাইওয়ে এক্সটেনশান প্রজেক্টের প্রথম অংশ। এখানে পর্বত আছে, আছে জলাশয়। তাই, এখানকার নির্মাণ-পরিবেশ প্রজেক্টের চতুর্থ অংশের চেয়ে অনেক বেশি জটিল।

চায়না ন্যাশনাল অ্যারো টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কর্পোরেশনের ভাইস প্রজেক্ট ম্যানেজার চৌ ইয়ুয়ে জানালেন, হাইওয়ের প্রথম অংশের প্রথম ১৩ কিলোমিটার অবস্থিত বন্যাপ্রবণ এলাকায় এবং বাকি ১৭ কিলোমিটার পড়েছে পাহাড়ি এলাকায়। এর ওপরে আছে প্রচুর বৃষ্টিপাত। ২০১৭ সালে বৃষ্টি প্রকল্পের কাজে যথেষ্ট বাধার সৃষ্টি করেছে।

চৌ জানালেন, ব্যাপক বৃষ্টিপাতে প্রচুর নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ভেসে গেছে। এমনকি একাধিক নির্মাণাধীন কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের ফলে একবার কয়েকদিনের জন্য প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখা হয়।

চৌ বলেন, "কিন্তু বৃষ্টি থামার পর আমরা পরিস্থিতির সাথে দ্রুত নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছি। ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ প্রকল্পের ৫০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। অনেক সমস্যা সত্ত্বেও আমরা সময়ে সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ শেষ করছি।"

সাউদার্ন হাইওয়ে এক্সটেনশান প্রজেক্ট মাতারা থেকে হাম্বানটোটা পর্যন্ত বিস্তৃত। মাতারা থেকে হাম্বানটোটা পর্যন্ত এই হাইওয়ে নির্মিত হচ্ছে ৪টি পর্যায়ে। প্রতিটি পর্যায়ের ঠিকাদারী পেয়েছে চীনা কোম্পানিগুলো।

শ্রীলঙ্কার সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সাউদার্ন হাইওয়ে এক্সটেনশান প্রজেক্টের সিনিয়র প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন আর এম জামিনি। তিনি বলেন, হাম্বানটোটা মহাসড়কের নির্মাণকাজ ভালোভাবে এগুচ্ছে। আশা করা যায় যে, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ কাজ সম্পূর্ণ শেষ হবে। তিনি জানান, এই মহাসড়ক পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ, উভা প্রদেশ, ও অন্যান্য দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোসহ দেশের বিভিন্ন অংশকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করবে।

জামিনি বলেন, "এই মহাসড়ক স্থানীয় জনগণের কল্যাণ করবে। কারণ, এর ফলে পণ্যের পরিবহন সহজতর হবে। সড়কটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের জন্যও কল্যাণকর প্রমাণিত হবে। তাঁরা তাদের পণ্য অল্প সময়ে কলম্বো পাঠাতে পারবে। এতে তাঁদের জীবনমান উন্নত হবে।"

হাম্বানটোটার বন্দর চীন-শ্রীলঙ্কা সহযোগিতার একটি কেন্দ্র। আর নির্মাণাধীন মহাসড়কটি হবে এতদঞ্চলের জন্য প্রয়োজনীয় একটি অবকাঠামো। হাম্বানটোটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড লজিস্টিকস্‌ জোনেও দু'দেশ সহযোগিতা করার কথা ভাবছে। শ্রীলঙ্কায় চীনের রাষ্ট্রদূত ঈ সিয়ানলিয়াং বলেন, "এই জোনে ভবিষ্যতে চীন-শ্রীলঙ্কা সহযোগিতা এগিয়ে যাবে।"

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হাম্বানটোটায় শ্রীলঙ্কা-চায়না লজিস্টিকস্‌ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পরে নভেম্বরে এই জোনে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটি দফতরও স্থাপন করা হয়।

বর্তমানে সিএইচইসি জোনের উন্নয়নের জন্য লঙ্কান সরকারের সাথে আলোচনা করছে। এখন দু'পক্ষই জোনের জন্য বিনিয়োগকারী খুঁজছে। ইতোমধ্যেই ৩০টির বেশি কোম্পানি জোন পরিদর্শন করেছে এবং সেখানে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

শ্রীলঙ্কায় সিএইচইসি'র প্রতিনিধি দফতরের যুগ্ম মহা-পরিচালক চাং লিয়ানচিউ বলেন, ১০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এদিকে, লঙ্কান মন্ত্রিসভা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অনুসারে, রাষ্ট্রায়াত্ব সিলন ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড চীনের চায়না ম্যাশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের সাথে যৌথভাবে জোনে একটি ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করবে।

সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনা অনুসারে, ৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকজুড়ে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা-চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড লজিস্টিকস্‌ জোন মৌলিক শিপিং সেবা দেবে এবং পাশাপাশি বন্দর-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পৃষ্টপোষকতা দেবে।

শ্রীলঙ্কার বন্দর ও জাহাজমন্ত্রী মাহিন্দ্রা সামারাসিংহে মনে করেন, এই জোনের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তিনি বলেন, "হাম্বানটোটা জেলায় বেশ কয়েকটি শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যান্য কয়েকটি নির্দিষ্ট জেলায়ও শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা আশা করি, চীনা কোম্পানিগুলো সেসব শিল্প এলাকা গড়ে তুলতে এবং সেখানে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।"

(চায়না ডেইলি অবলম্বনে আলিমুল হক)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040