সিন বা গ্রাম, দক্ষিণ চীনের কুয়াং তুং প্রদেশের একটি পাহাড়ী দরিদ্র গ্রাম। এখানে ৯৯ শতাংশ অঞ্চল পাহাড়। লুও চিয়ান হুয়া সিন বা গ্রামে নিযুক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের দারিদ্র বিমোচন কর্মগ্রুপের নেতা। গ্রামবাসীরা লুও চিয়ান হুয়াকে ডাকেন লুও তা নামে। ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের একটি সাংবাদিক দল কুয়াং তুং প্রদেশের ছিং ইউয়ানে গিয়ে সেখানকার অবস্থা সরেজমিনে দেখে এসেছেন। ওখানে লুও চিয়ান হুয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন এবং তাঁর সাথে বিস্তারিত কথা বলেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের তৃণমুলে গ্রামে নিযুক্ত সাধারণ একজন পার্টি সদস্য ক্যাডারের কার্যক্রম তুলে ধরব।
লুও তা সাংবাদিকদের নিয়ে চা বাগানে যাচ্ছিলেন। পথে সাংবাদিকরা দেখেছেন বাঁশ বন যেন সাগড়ের মতো বড়। মুরগীর দ্রুত দৌড় যেন উড়ছে। পথে একটি নির্মাণস্থানে লুওতাকে দেখে একজন পুরাতন গ্রামবাসীর মুখে ফুটেছে হাসি এবং তাকে থাম্পস আপ করেন। প্রবীণ এক গ্রামবাসীর ছেলে লিয়াং নেং হং জানান-
"সম্পাদক লুও এখানে অনেক কাজ করেন এবং বেশ অবদান রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্বে চালু হয় নানা প্রকল্প এবং আমাদের গ্রামও দিন দিন সুন্দর হয়ে ওঠেছে। আমরা সবাই তাকে দেখলে থাম্পস আপ করি এবং তাকে অত্যন্ত সম্মান করি। কারণ তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেন।"
লুও তা এখানে কী কী করেন এবং প্রথমে তিনি কীভাবে এ গ্রামে আসেন?
সিন বা গ্রাম ছিং ইউয়ান শহরের অধীনস্থ একটি গ্রাম। লু চিয়ান হুয়া অর্থাত্ লুও তা ছিং ইউয়ান কারগারে ১৪ বছরের মতো উপ পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। গেল ৯ বছর লুও তা ছিং ইউয়ান শহরের নানা দরিদ্র গ্রামে নির্দিষ্ট অঞ্চলের দারিদ্র বিমোচন কর্মগ্রুপের নেতা হিসেবে কাজ করেন। গত মে মাসে তিনি এসেছেন সিন বা গ্রামে।
লুও তা বলেন, এখানে সবাই দারিদ্র্যমুক্ত হতে চায় এবং তাদের এ ইচ্ছা খুবই জরুরী। যত দ্রুত সম্ভব দারিদ্র্যমুক্ত হওয়া তাদের প্রত্যাশা এবং তার জন্য এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।তিনি বলেন"আমি প্রথম যখন আসি গ্রাম বাসিন্দাদের কাছে জানতে চাই আমার নেতৃত্বে কোন কোন প্রকল্প শুরু করতে চান। তবে আমার কাজ তদন্ত ও জরিপ থেকে শুরু হতে হবে, তারা বুঝতে পারেন না এমনকি আমাকে সন্দেহ করেন। তারা ভাবেন আমি শুধু এখানে কিছু দিন থাকব এবং এমনেই এসেছি কোন কাজ করতে চাই না।"
তবে লুও তা সবাইকে সাহায্য করতে চান এমন মন নিয়ে এসেছেন সিন বা গ্রামে। এখানে ১৮২টি পরিবারের ৬৭১ জন মানুষ ৪০ বর্গ কিলোমিটার বড় পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাস করেন। এর মধ্যে ২৪টি পরিবারের ৮০জন দরিদ্র সীমার নীচে থাকেন।
লুও তা মনে করেন, দারিদ্র্যমুক্ত হতে চাইলে পরিবহন ব্যবস্থা প্রয়োজন।
সিন বা পাহাড়ী গ্রাম। এখানে বাঁশ,কাঠসহ নানা অর্থকরী ফসল চাষ হয়। আগে এখানে কোন রাস্তা ছিলনা। পরিবহন ট্রাক পাহাড়ে যেতে পারতনা বলে এখানে উৎপাদিত ফসলও গ্রামের বাইরে বিক্রি হতনা।
লুও তা এখানে আসার পর প্রথমে ছিং ইউয়ান গণকংগ্রস ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রস্তাব দেয়ার মাধ্যমে ২ কোটি ইউয়ান অর্থ সংগ্রহ করে ২৫ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করেন। ৯.৫ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করেন এবং দুটি পাথর রাস্তা সিমেন্ট রোডে পরিণত করেন। এ দুটি পাথর রোড সিমেন্ট রোড করার বিষয় নিয়ে লু্ও তা ছিং ইউয়ান সরকারের উচ্চ মহলে একটি চিঠি লিখেছেন। তিনি জানান, নিয়ম অনুযায়ী একটি গ্রামের বাসিন্দা ৩০০ জনের বেশি হলে দুটি সিমেন্ট রোড নির্মাণ করতে পারে তবে এখন এই গ্রামের বাসিন্দা মাত্র ২০০ জন। পাহাড়ে বসবাস ব্যয়বহুল এবং তাদের বাড়িঘরও মানসম্মত নয়। তাদের এ অবস্থা আমি চিঠির মাধ্যমে ছিং ইউয়ান সরকারের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদককে জানিয়েছি এবং তার সমর্থনে অবশেষে দুটি সিমেন্ট রোড নির্মাণের বরাদ্দ পেয়েছি।
রাস্তা মেরামত ও নির্মাণের পাশাপাশি, লুও তার উদ্যোগে দুটি কোম্পানিও প্রতিষ্ঠিা করেছেন। একটি হল পর্যটন কোম্পানি। সি বা গ্রাম বিখ্যাত একটি দীর্ঘায়ু গ্রাম। এখানকার বাতাস নির্মল এবং বাতাসে নেগেটিভ আয়নের পরিমাণ বেশি। এখানকার পানি সরাসরি খাওয়া যায়। তাছাড়া, গ্রামে বসবাস করেন ১০০ জনের বেশি ইয়াও নামে একটি সংখ্যালঘু জাতির মানুষ। যখন চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন কুয়াং তুংয়ে এ গ্রাম সবচেয়ে আগে মুক্ত হয় বলে মহান বিপ্লবের দর্শনীয় স্থান হিসেবে এখানে পর্যটন সম্ভাবনাও প্রচুর। লুও তার উদ্যোগে পর্যটন সম্পর্কিত অবকাঠামোও নির্মাণ করেছেন।
একেকটি বাড়িঘর দ্বিতীয় তলা নির্মাণ করা হচ্ছে। লুও তা জানিয়েছে এ বাড়িঘর পর্যটন অবকাঠামোর অন্যতম। এখানে অনেক বাড়িঘর পারিবারিক হোটেলে পরিণত হয়েছে। বাসিন্দারা এ বাড়িঘর কোম্পানিকে ভাড়া দিয়েছে এবং প্রতি বছর গড়ে ১৯০০ ইউয়ান পর্যন্ত ভাড়া পেতে পারেন। এখন দ্বিতীয় তলা নির্মিত হচ্ছে এবং ভাড়াও দ্বিগুণ হবে।
কোম্পানি আয়ের ২০ শতাংশ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করে বাকি আয় দারিদ্র বিমোচন তহবিলে জমা দেওয়া হয়।
পর্যটন কোম্পানি ছাড়া প্রতিষ্ঠিত আরেকটি কোম্পানি হল চা কোম্পানি। সিন বা গ্রামের কৃষি ফসল প্রচুর ও বৈশিষ্ট্যময়। কিছু তদন্ত করার পর লুও তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিা করেন চা কোম্পানি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩৩ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে চা চাষ করা হয় এবং কোন রকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা ছাড়া চা উৎপাদন করা হয়। কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার পর চা নিয়ে বিস্তারিত প্রসেসিং এবং ব্র্যান্ড প্যাকেজিং করা হয়। চা এর দাম প্রতি কেজি ১৬০ ইউয়ান থেকে বেড়ে ১৩৬০ ইউয়ানে উন্নীত হয়েছে ।
স্থানীয় সম্পদ উন্নয়নের জন্য লুও তা নানা জায়গায় গিয়ে লেখাপড়া করেন। সিন বা গ্রামে চালু করেন 'পাতলা মাছ' চাষ প্রকল্প।
কেন মাছের ওজন কমাতে হবে? এ প্রকল্পের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, দরিদ্র পরিবারের বাসিন্দা ইউ ইয়া ছিয়াং জানিয়েছেন, তাঁরা জাব খেয়ে বড় হওয়া মাছ কিনে তাদের পাহাড়ী ঝর্নার পানিতে চাষ করেন। ১১০০ মিটার উচু পাহাড়ের পানিতে কিছু খাওয়ানো হয়না মাছগুলোকে। এক মাস পর তাদের ওজন ১৭ শতাংশ কমে গেলেও মাংস আরও আঁটসাঁট হয়। প্রতি কেজি ৭ ইউয়ানে কিনে এবং ২০ ইউয়ানে এক কেজি মাছ বিক্রি করে। এখন ৭টি দরিদ্র পরিবারের ৩১ জন গ্রামের ৬টি মাছের পুকুরের দায়িত্ব নিয়েছে। ৬টি পুকুরের মাছ বিক্রি করে প্রতি আবর্তে ৩০ হাজার ইউয়ান আয় করতে পারেন তাঁরা।
নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সিন বা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের আগ্রহ আকর্ষণ করা হয়েছে। এখন প্রতিটি দরিদ্র পরিবারের নিজ নিজ প্রকল্প আছে।
চীন সরকার দারিদ্র বিমোচন কাজের ওপর গুরুত্ব দেয়। সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি চালুর ৪০ বছরে চীনে ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্র মুক্ত হয়েছে। চীন বিশ্বের প্রথম দেশ যে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দরিদ্র লোকসংখ্যা অর্ধেক হ্রাসের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের গ্রামীন অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জনপ্রতি বছরের আয় ২৩০০ ইউয়ান। ২০১৬ সালে চীনের দরিদ্র লোকসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার।
২০১৫ সালে যখন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কুই চৌ প্রদেশে পরিদর্শন করেন তখন তিনি জোর দিয়ে বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে চীনে সার্বিক দারিদ্র মুক্তি বাস্তবায়ন চাইলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দারিদ্র বিমোচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রামে নিযুক্ত নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দারিদ্র বিমোচন কর্ম প্রকল্পে একজন পার্টি সদস্য ক্যাডার হিসেবে লুও তা তার আস্থা প্রকাশ করে বলেন, ২০২০ সাল পর্যন্ত সিন বা গ্রামের গড় মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৮ হাজার ইউয়ান হবে এবং দরিদ্র পরিবারের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৪ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন
'দারিদ্র বিমোচন কাজ করতে করতে আমি জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছি। আমরা ভাল একটি যুগে আছি এবং আমি গ্রামবাসির জন্য বাস্তব কাজ করতে চাই।
লুও তার বাড়ি সিন বা গ্রাম থেকে ৪ ঘন্টার গাড়ির পথ। তাঁর বাবা ৮৭ বছর বয়সী এবং তার স্ত্রীর বাবা ৮৪ বছর বয়সী, চলা ফেরা করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। তাঁর সন্তান ১৭ বছর বয়সী এবং আগামি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করবে। তাঁর স্ত্রী একা একা পুরো পরিবারের যত্ন নেন। তিনি মাসে একবার বাড়ি যান। তাঁর অফিসের পাশে আছে ছোট অস্থায়ী একটি বাসা। লুও তার মতো এমন পার্টি সদস্য ক্যাডার চীনে অনেক বেশি। তাঁরা তৃণমুলে সবচেয়ে সাধারণ ও অসাধারণ কাজ করছেন।
(শিশির/মহসীন/সুবর্ণা)