চীনের কার্যকর উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতা
  2017-11-26 19:51:12  cri

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে অবশেষে একটি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে। গত ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দু'দেশের মধ্যে এ সমঝোতাস্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বন্ধুরাষ্ট্র চীন। সমঝোতাস্মারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ না থাকলেও এ ক্ষেত্রে এ যাবত সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে এ চুক্তিটিকে।

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগটি আসে বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন অংশীদার চীনের কাছে থেকে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ২১ নভেম্বর নেপিদোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে বৈঠকের পর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তিন দফা প্রস্তাব দেন। দৃশ্যত তারই পথ ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি সমঝোতায় আসতে পেরেছে। ওয়াং ই তার প্রস্তাবে, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাখাইনে অস্ত্রবিরতি এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। বলেন, রাখাইনবাসীর শান্তিতে বসবাসের জন্য রাজ্যটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আর দীর্ঘ মেয়াদে রাখাইনে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের প্রস্তাব রাখেন ওয়াং ই। তিনি জানান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশই চীনের বন্ধুরাষ্ট্র। সে হিসেবে চীন দুদেশের এ সমস্যা সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে।

আসেম সম্মেলনে মিয়ানমার নেত্রী অং সান সুচি রোহিঙ্গা সমস্যার উল্লেখ পর্যন্ত না করলেও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেন। জানান, ওয়াং ই'র দেয়া প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করবেন তিনি। এর পরপরই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের মধ্যে নেপিদোতে এ বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়। দুদিনের আলোচনার পর ২৩ নভেম্বর সুচির সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। বৈঠক শেষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দুদেশের মধ্যে সমঝোতাস্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়। একে অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অফ ডিসপ্লেসড পারসন ফ্রম রাখাইন স্টেট বা রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত মানুষদের ফিরিয়ে নেয়ার সমঝোতা হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ফিরে ২৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। জানান, মিয়ানমারের ইচ্ছা অনুযায়ী সমঝোতাস্মারকে ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। আগামী দুমাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হবে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত যে সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকেই শুধু এ সমঝোতাস্মারকের আওতায় ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। তার আগে থেকে যে সব রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি পরে বিবেচনা করা হবে। প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করার জন্য আগমী তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে। আর যথাসময়ে এ বিষয়ে ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করবে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ছেং শুয়াং বলেন, রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এছাড়া ২৪ নভেম্বর পেইচিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান।

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোঘেরিনি। এ বিবৃতিতে তিনি জানান, ইইউ প্রত্যাশা করে কোনরকম দেরি না করেই চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হবে এবং রোহিঙ্গারা নিজেদের আবাসভূমিতে ফিরে যাবে। তবে,আন্তর্জাতিক আইন মেনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিটি হয়েছে কি না তা ইইউ পর্যবেক্ষণ করবে বলেও জানান তিনি। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করবে বলে আশা প্রকাশ করেন ইইউর এই শীর্ষ কূটনীতিক।

এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরের দিনও হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। হিউম্যান রইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা ও নজরদারি থাকতে হবে।

বিশ্লেষকদের মধ্যে এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তারা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতি এখনো বেশ জটিল। তবে চীনের উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে প্রক্রিয়া শুরু হলো তা ইতিবাচক এবং এ পথেই এগিয়ে যেতে হবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040