বেইজিং শহরের থংচৌ জেলায় মহাখালের পরিবেশ উন্নয়ন
  2017-11-24 15:26:07  cri

"কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দাদের জন্য এটি একটি খুবই ভাল বিনোদনের জায়গা। কোনো কোনো বাসিন্দা এখানে শরীরচর্চা করেন। কোনো কোনো বাসিন্দা শিশুতদের নিয়ে এখানে খেলা করেন। আগে এখানে খালের পানিতে ছিল দুর্গন্ধ। কেউ এখানে আসতেন না। কিন্তু এখন এখানকার পরিবেশ অনেক সুন্দর।"

প্রিয় শ্রোতা, শুনছিলেন বেইজিং শহরের থংচৌ জেলার বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সী চাং হং ফেং-এর কথা। তিনি 'মহাখাল বন পার্ক' সম্পর্কে মন্তব্য করছিলেন। পার্কটি বস্তুতই স্থানীয় বাসিন্দাদের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

চাং হং ফেং হলেন থংচৌ জেলার উত্তর খালের পশ্চিম দিকে চাংসিন গ্রামের একজন বাসিন্দা। উত্তর খাল আসলে হল বিশ্ববিখ্যাত্ চিংহাং খালের সবচেয়ে উত্তরের শাখা। চিংহাং খাল, যেটিকে বাংলায় 'মহাখাল' বলা হয়, বিশ্বের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে প্রাচীন কৃত্রিম খাল। খালটি মোট ১৭৯৪ কিলোমিটার লম্বা। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত চীনের হাইহো, হুয়াংহো, হুইহো, ছাংচিয়াং ও ছিয়ানথাংচিয়াং নদীকে সংযুক্ত করেছে এই খাল। মহাখালটির এক হাজারেরও বেশি বছরের ইতিহাস রয়েছে। খালটি চীনের কৃষিযুগে চীনা মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্প্রীতিময় বন্ধন সৃস্টি করেছিল। থংচৌ ও থিয়াচিন এই খালের জন্যই বিখ্যাত্ বাণিজ্যিক নগরে পরিণত হয়।

বিংশ শতাব্দীর ৮০ ও ৯০-এর দশকে উত্তর খালের দু'তীরে অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এর ফলে খালের পানি দূষিত হতে থাকে এবং খালে আবর্জনা বাড়তে থাকে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা বিপদে পড়েন। এ সম্পর্কে চাং হং ফেং বলেন, "আমরা খাল ছাড়া বাঁচি না। আমরা ছোটবেলায় খালের পানি খেতাম। কিন্তু পরে পানির মান অনেক খারাপ হয়েছে।"

পরবর্তী কালে নগরায়নের পাশাপাশি বেইজিং শহর কর্তৃপক্ষ খালটির পরিবেশ উন্নত করার দিকেও নজর দেয়। বর্তমানে চাংসিনচুয়াং গ্রামের উত্তর খালে অবস্থিত কৃষিজমি মহাখাল বন পার্কের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। খালের দু'তীরে গাছ বেড়েছে, খালের পানি পরিচ্ছন্ন হয়েছে। চাং হং ফেং মনে করেন আগের সেই পরিস্কার ও সুন্দর খাল আবার ফিরে এসেছে।

চাংসিনচুয়াং গ্রামের ৬০ বছর বয়সী বাসিন্দা ওয়াং ইয়ৌ শুন ছোটবেলা থেকে উত্তর খালের তীরে বাস করে আসছেন। তিনি খালের পরিস্কার পানি দূষিত হতে দেখেছেন এবং তারপর সেই দূষিত পানি আবার পরিচ্ছন্ন হতে দেখেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "মনে আছে, আমার বয়স যখন পাঁচ বা ছয় বছর, তখন থেকেই খালের স্বচ্ছ পানিতে মাছ দেখতে পেতাম। আমি ছোট বেলায় খালের পানি খেতাম। কিন্তু আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, তখন থেকেই খালের দু'তীরে বিভিন্ন কারখানা নির্মিত হতে শুরু করে। বিশেষ করে কাগজ তৈরীর কারখানা। এগুলো দূষিত পদার্থ বেশি ছড়ায়। ফলে খালের পানিও দূষিত হয়েছে। পানি কাল হয়েছে। পরে কাগজের কারখানা বন্ধ হওয়ার পর খালের পানি আস্তে আস্তে আবার পরিস্কার হয়েছে। বন-পার্কের পরিবেশও এখন অনেক সুন্দর। কখনই ভাবিনি যে, খালের পানি আবার আগের মতো পরিস্কার হবে।"

মহাখাল বন পার্কে পর্যটকদের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াং ইয়ৌ শুন পার্কটিতে একটি রেন্ট-এ-কার কোম্পানিতে কাজ করেন। তিনি প্রতিদিন এখানে আনন্দিত মানুষের মুখ দেখেন। এর আগে ওয়াং ইয়ৌ শুন কৃষিকাজ করতেন বা গ্রামের কারখানায় কাজ করতেন। তিনি স্বীকার করলেন যে, তখন তিনি পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। বর্তমানো সবাই পরিবেশ সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। পর্যটনের মানও অনেক উন্নত হয়েছে।

চাং হং ফেং হলেন চাংসিচুয়াং গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) কমিশনের সম্পাদক এবং উত্তর খালের চতুর্থ পর্যায় প্রকল্পের প্রধান। তিনি খালের ৮ কিলোমিটার প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার খালের এই ৮ কিলোমিটার অংশ পরিদর্শন করেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে। খালের পানি দূষিত যাতে না-হয় বা কেউ না-করতে পারে—সেটা বিশেষভাবে খেয়াল রাখেন তিনি। চীনা মানুষ আজকাল পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন। গ্রামবাসীও খালের পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতন। চাং হং ফেং বলেন, "আমাদের গ্রাম ঢেলে সাজানো হচ্ছে। গত মে থেকে গ্রামে কোনো কারখানা নেই। ফলে দূষিত পদার্থ নির্গমণের সমস্যাও নেই। কিন্তু কোনো কোনো পর্যটক খালে আবর্জনা ফেলেন। গ্রামবাসীরা পর্যটকদের আবর্জনা না-ফেলার অনুরোধ জানান।"

চাং হং ফেং বলেন, চাংসিনচুয়াং গ্রামের ২ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হবে। এ ছাড়া, সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন, গণসেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে চাংসিনচুয়াং গ্রামকে দূষণমুক্ত করা হবে। কারখানা বন্ধ হওয়ায় যেসব গ্রামবাসী বেকার হয়েছেন, তাদেরকে পরিবেশ সুরক্ষা কর্মকাণ্ডে কাজ দেওয়া হয়েছে।

চাংসিনচুয়াং খাল পরিবেশ সুরক্ষার কাজ আসলে বেইজিংয়ের থংচৌ জেলার পরিবেশ উন্নয়নে নেওয়া দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। থংচৌ জেলার জল কর্তৃপক্ষ ব্যুরোর পরিচালক ফাং ইয়া জুন বলেন, "২০১৫ সাল থেকে আমরা পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছি। গত জুন পর্যন্ত জেলাটি ১৯টি দূষিত জলাশয় থেকে মুক্ত হয়েছে। উত্তর খাল ও থংহুই নদীসহ বড় নদীতে পানির মান অনেক উন্নত হয়েছে। ভবিষ্যতে পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলাটির পানির মান আরও উন্নত করা হবে।"

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শেষ দিকে থংচৌ শহরের উপ-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে দূষিত পানি পরিশোধনের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা নির্মিত হবে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে থংচৌ জেলার গ্রামীণ অঞ্চলে দূষিত পানি পরিশোধনের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা নির্মিত হবে। এর মাধ্যমে উত্তর খাল ও এর কাছাকাছি অঞ্চলের পরিবেশ আরও উন্নত হবে।

জানা গেছে, একসময় থংচৌ জেলা উত্তর খালের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্দর ছিল। থংচৌ জেলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস আছে। বর্তমানে থংচৌ জেলার পরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি, 'মহাখাল সাংস্কৃতিক এলাকা' নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের আওতায় যাদুঘর ও পার্ক নির্মিত হবে, সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ মেরামত করা হবে, এবং ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক সড়ক ও প্রাচীন গ্রাম রক্ষা করা হবে। থংচৌ জেলার সিপিসি'র কমিশনের প্রচার বিভাগের পরিচালক চা সিয়ান ইয়ৌ বলেন, "আমরা থংচৌ জেলার মানুষ মহাখালের সংস্কৃতির ওপর বেশি গুরুত্ব দিই। আমাদের মহাখাল সংস্কৃতি সুরক্ষার দায়িত্ব আছে। খালের দু'তীরে অনেক প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। বেইজিং শহরের উপ-কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়ায় প্রাচীন লু জেলায় প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি দুই সহস্রাধিক বছরের পুরাতন। এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।"

চা সিয়ান ইয়ৌ বলেন, মহাখাল হল চীনা জাতির সাহস ও শক্তির প্রতীক; চীনা জাতির ঐক্যের প্রতীক। মহাখালকে কেন্দ্র করে প্রাকৃতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে শুধু যে পানিদূষণ মোকাবিলা করা হবে ও সবুজায়ন করা হবে তা নয়, এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তিও সংরক্ষণ করা হবে।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040