চলমান রোহিঙ্গা সংকট গত সপ্তাহেও যথারীতি খবরের শিরোনাম ছিল বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে। এ ইস্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মিয়ানমার সফর সঙ্গত কারণেই বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ এবং রাজধানীতে বহুপ্রতিক্ষিত মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার চালু হওয়ার খবরও বেশ গুরুত্ব পেয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা নজর দেব প্রথম দুটি বিষয়ের দিকে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যেই এ সংকট নিয়ে আলোচনা করতে ২৪ অক্টোবর ৩ দিনের সফরে মিয়ানমার যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তার সঙ্গে ছিল ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। সফরের প্রথম দিনে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা ৬ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। বৈঠকে দুদেশের মধ্যে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। একই দিন নেপিদোতে সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় ছিল।
সফরের দ্বিতীয় দিনে মিয়ানমারে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই বৈঠকেও প্রধান আলোচ্য ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের নেত্রীকে স্পষ্ট করে জানান, যে সব রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে না গেলে তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তে পারে- যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার কারো জন্যই সুখকর হবে না।
জবাবে সুচি বলেন, তার দেশ থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের ফিরিয়ে নিতে কাজ করছে তার সরকার। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫টি প্রস্তাব ও আনান কমিশনের সুপারিশের আলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। দুদেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানান মিয়ানমার নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সুচিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সুচি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং সুবিধা মতো সময়ে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
দৃশ্যত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর বেশ ফলপ্রসু হয়েছে। দেশে ফিরে ২৭ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী নিজেও দাবি করেন সরকার যেভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে তাতে করে শিগগিরই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হবে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো এতটা আশাবাদী হতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।
২৬ অক্টোবর ঢাকায় এক সেমিনারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার এ পর্যন্ত যা যা করেছে তার সবই আইওয়াশ। আন্তর্জাতিক চাপ কমে গেলে তারা আর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না। এজন্য দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি। চীন ও রাশিয়া চাইলে এ সংকট সমাধান সম্ভব- মন্তব্য করে তিনি দেশ দুটির সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল, পর্যবেক্ষক, সুশীল সমাজ, নারীনেত্রী ও সাবেক সিইসি ও কমিশনারসহ বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপ শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। সংলাপের বিষয়ে জানাতে ২৬ অক্টোবর সংবা সম্মেলন করেন সিইসি কে এম নুরুল হুদা। তিনি জানান সংলাপে ৪ শতাধিক প্রস্তাব পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের দাবি সহায়ক সরকার গঠন, আইনপ্রণয়ন ও বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের মতো বিষয়গুলো কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে বলে জানান সিইসি। এগুলো তারা সরকারের কাছে পাঠাবেন। এ ছাড়া বাদবাকি সুপারিশগুলো নিয়ে তারা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন। বিদ্যমান আইনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে অভিমত ব্যক্ত করেন সিইসি।
সংলাপে বিএনপির দেওয়া প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্য মতভিন্নতা রয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু সহয়াক সরকার, সংসদ ভাঙ্গা না ভাঙ্গার মতো বিষয়গুলোতে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাও মনে করেন সহায়ক সরকার ও সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। এটি রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়। তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরিতে নির্বাচন কমিশনকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ সাবেক এই সিইসির।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।