এক পায়ের সুন ইউরো চি ১৯ দিনে সাইকেলে পাড়ি দিলেন ২৪ হাজার কিলোমিটার!
  2017-11-25 20:26:10  cri

চলতি বছর (২০১৭) চীনের জাতীয় দিবসের ছুটিতে যেন অসাধ্য সাধন করেন প্রতিবন্ধী সুন ইউরো চি। বয়স তার ২৮। মাত্র একটি পা সম্বল। এই একটি পা ব্যবহার করেই তিনি সাইকেলে পাড়ি দিলেন ২৪ হাজার কিলোমিটার!

পয়লা অক্টোবর তিনি হে নান প্রদেশের সিন সিয়াং থেকে যাত্রা শুরু করেন। তার গন্তব্য তিব্বতের রাজধানী লাসা। ১৯ দিনে তিনি অতিক্রম করেন ২৪ হাজার কিলোমিটার। এতোটা পথ পাড়ি দেবার পর সুন ইউরো চি দাঁড়ান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩০০ মিটার উচু ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে। তার সামনে তখনও ২০০০ কিলোমিটার পথ রয়ে গেছে পাড়ি দেবার!

২০০৯ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় সুন ইউরো চি একটি পা হারান। ২০১৩ সালে তিনি একজন প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তার প্রভাবে শুরু করেন এক পায়ে সাইকেল চালানো।

পয়লা অক্টোবর থেকে প্রতিদিন সুন ইউরো চি গড়ে ১০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছেন। নিজের সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করতেই যেন তিনি তার এই দীর্ঘ যাত্রায় নকল পা'টি ব্যবহার করেননি।

যাত্রাপথের সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল সিনচিয়াং-তিব্বত সড়ক। এ পথের গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫০০ মিটার। এ সড়কটি ৫টি ৫০০০ মিটার উঁচু পাহাড়, ১৬টি হিমশৈল, ও ৪৪টি নদী অতিক্রম করেছে। এটা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত একটি সড়কপথ। এ সড়কপথকে জয় করা ছিল সুন ইউরো চি'র লক্ষ্য।

মালভূমিতে হোটেল পাওয়া মুশকিল। তাই সুন ইউরো চি'কে সাবধানে চলতে হয়েছে। তিনি সকালে যতটা সম্ভব দ্রুত চলেছেন। এমনভাবে সময় হিসেব করেছেন যাতে তার সন্ধ্যা হয় কোনো নগরে।

দীর্ঘসময় ধরে ঝড়ো হাওয়ায় জনশূন্য অঞ্চলে সাইকেল চালানো সুন ইউরো চি'র জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সারাদিন সাইকেল চালানোর পর নতুন কোনো শহরে বা জনপদে পৌঁছানোর সাথে সাথে তার সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যেত। নতুন একটা শহরে বা জনপদে পৌঁছানো ছিল তার যাত্রাপথের সবচেয়ে আনন্দদায়ক একটা ব্যাপার।

গত বছর সুন ইউরো চি সি চুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেং তু থেকে ৩০০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পৌঁছেছিলেন মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। কিন্তু এবার তার নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল নকল পা ছাড়াই এক পায়ে সাইকেল চালিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া।

সুন ইউরো চি সবসময় বলেন, সাইকেল তাকে বাঁচিয়েছে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে সুন ইউরো চি শানতুংয়ের একটি মেডিকেল স্কুলে পড়ছিলেন। তবে দুর্ঘটনায় পা হারানোয় তার জীবনের সবকিছু রাতারাতি পাল্টে যায়। লেখাপড়া, চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্ন, বিয়ে, ভবিষ্যত জীবনের পরিকল্পনা—সবকিছুই বদলে যায়। সুন ইউরো চি বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করতেন। কিন্তু দুর্ঘটনা তার সে পছন্দের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। জীবনের সবচেয়ে কঠিন একটি সময় তখন তাকে কাটাতে হয়েছে। সুন ইউরো চি পরে স্কুলে ফিরেছেন এবং ২০১৩ সালে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেন। তবে প্রতিবন্ধী হিসেবে তিনি সহজে চাকরি পাওয়ার সুযোগ নিতে চাননি। তিনি ট্রেনের টিকিট কেটে চলে যান চীনের উত্তর দিকে মো হে শহরে। এই ভ্রমণ সুন ইউরো চি'র আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়; তিনি বুঝতে পারেন, একটি পা নিয়েই তিনি ভ্রমণ করতে পারেন। পরবর্তী এক বছরে তিনি হে লং চিয়াং, সিন চিয়াং ভ্রমণ করেন; থাই শান পাহাড়েও ওঠেন। ইউন নান প্রদেশে তিনি স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এ সব অভিজ্ঞতা তাকে, তার চিন্তাচেতনাকে বদলে দেয়।

ইউন নানেই একজন প্রতিবন্ধী সাইক্লিস্টের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তার প্রভাবে সুন ইউরো চি শুরু করেন সাইকেল চালানো। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৩০০০ ইউয়ান দিয়ে প্রথম ভালো একটি সাইকেল ক্রয় করেন সুন ইউরো চি।

৬ মাসের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সুন ইউরো চি তার প্রথম যাত্রা শুরু করেন। ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি সামাজিক তথ্যমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, হে নান প্রদেশের রাজধানী থেকে হাই নান প্রদেশের রাজধানী হাই খৌতে যেতে তার একজন সাথী দরকার। সিয়াও মি নামক একটি মেয়ে তার সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দুর্ঘটনার আগে সুন ইউরো চি হাসপাতালে কাজ করতেন। তখন সিয়াও মি সেখানে একজন রোগী ছিলেন। পরেও দুজনের মধ্যে যোগযোগ ছিল, তবে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নন তারা।

পয়লা মার্চ ২০১৪, দু'জন শুরু করেন তাদের যাত্রা। হে নান, হুপেই, হু নান, কুয়াং তুংসহ নানা প্রদেশ অতিক্রম করেন দু'জন; ২০০০ কিলোমিটার চলার পর পৌঁছান হাই খৌ। এটা ছিল সুন ইউরো চি'র প্রথম সাইকেল যাত্রা। পথে সিয়াও মি তার যত্ন নেন; এমনকি দুজনের ব্যাগ নিজের সাইকেলে রেখে বহন করেন। এ যাত্রার মাধ্যমে দু'জন পরস্পরকে আরও জানতে পারেন এবং ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে দু'জন বিয়ে করেন। ২০১৫ সালে তাদের মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। সিয়াও মির সঙ্গে পরিচয়, বিয়ে, এবং তাদের মেয়ের জন্ম সুন ইউরো চি'র জন্য ছিল বড় উপহার। তিনি এ উপহার পেয়েছেন সাইকেলে চড়ার কারণে। তাই তিনি মনে মনে সাইকেলকে ধন্যবাদ জানান।

২০১৫ সাল থেকে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সাহায্যে সুন ইউরো চি ইনার মঙ্গোলিয়ার হুলানবেইয়ারে একটি সরাইখানা খোলেন। ২০১৬ সালে একজন বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে হাই খৌতে আরেকটি পরিবারিক হোটেল খোলেন।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে, সু ইউরো চি গঠন করেন ২০ জনের একটি দল এবং দলটিকে নিয়ে ছেং তু থেকে যান এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। সুন ইউরো চি'র জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল ঝড়ো হাওয়া ও উঁচু সড়ক। কোথাও কোথাও পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। ২০ জনের দলটির মধ্যে মাত্র ৩ জন শেষ পর্যন্ত এ যাত্রায় টিকে ছিলেন। তখনও ৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে অথচ তিন জনের সঙ্গে ছিল মাত্র একটি রেড বুলের ক্যান। তিন জন এ পানীয় ভাগাভাগি করেন এবং ৬ অগাষ্ট বিকেলে পৌঁছান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে।

সুন ইউরো চি জানালেন, তিন বছর সাইকেলে চড়ার অভিজ্ঞতা তার জীবনকে অনেক বদলে দিয়েছে। আগে তিনি মনে করতেন যে সাইকেলে চড়া একটি যাতায়াত পদ্ধতি এবং এর মাধ্যমে তিনি অন্যদের সামনে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করতে পারেন। কিন্তু ২০ হাজার কিলোমিটার চলার পর তিনি আবিষ্কার করেন যে, এটা আসলে নিজেকে জয় করার একটা প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, "সাইক্লিং আমার কাছে ধর্মের মতো। আমার শুধু একটি পা আছে। কিন্তু আমি ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পন করতে রাজি নই।" (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040