গত ১৮ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র ঊনবিংশ জাতীয় কংগ্রেস। সিপিসি'র গঠনতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা অনুসারে, দেশের ৪০টি নির্বাচন সংস্থার মাধ্যমে, কংগ্রেসের জন্য নির্বাচিত হন মোট ২২৮৭ জন প্রতিনিধি। তাঁরা ঊনবিংশ জাতীয় কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিনিধিদের অনেকেই তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ভাল কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আজকের 'পুবের জানালা' অনুষ্ঠানে আমরা এই দুই সহস্রাধিক প্রতিনিধির মধ্যে একজনের সঙ্গে পরিচিত হবো। তাঁর নাম তু লি ছুন। তিনি কুয়াং সি প্রদেশের নান নিং শহরের চতুর্থ গণহাসপাতালের একজন হেড নার্স। তিনি বেথুন ও নাইটিংগেলসহ চিকিত্সা ও নার্সিংসংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ পদক অর্জন করেছেন।
যে-বিভাগ তু লি ছুন আছেন, সে-বিভাগটি একটু বিশেষ ধরনের। তার বিভাগে এইডসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হয়। তার নেতৃত্বে একদল নার্স এইডস্ রোগীদের দেখাশোনা করেন, যত্ন নেন।
২০০৫ সালের কথা। তু লি ছুন প্রথম এইডস বিভাগে যোগ দিয়েছেন। তখন তিনি এমন একজন রোগীর দেখা পান, যার গোটা শরীরে বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে। বড় একটি ফোস্কার ব্যাস ছিল দশ থেকে বারো সেন্টিমিটার। ফোস্কা ফেটে গেলে দুর্গন্ধ বের হয়। তু লি ছুন দশ-বারো দিন এ রোগীর যত্ন নিয়েছেন, কোনো অভিযোগ করেননি।
তু লি ছুন গেল ১২ বছরে দশ সহস্রাধিক এইডস রোগীর যত্ন নিয়েছেন। তিনি বলেন, "এইডস রোগীদের জন্য শারীরিক ব্যথার পাশাপাশি মানসিক আঘাতও গুরুতর। অনেক এইডস রোগী শুধু মৃত্যুর দিন গোনেন। তাদেরকে বেঁচে থাকতে উত্সাহ দেওয়া খুব প্রয়োজন। আবার এমন রোগীও আছেন, যাকে তার পরিবার পরিত্যাগ করেছে। এমন রোগীর জন্য বিশেষ যত্ন খুবই জরুরি।"
সিয়াও মা একজন এইডস রোগী। তিনি তু লি ছুনের হাসপাতালে চিকিত্সা নিচ্ছেন। তিনি সাংবাদিককে বলেন, "তু লি ছুন প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসেন। তিনি আমার চুল ও পোশাক পরিষ্কার করেন, আমার বিছানাও।" কয়েক বছর আগের কথা বলতে গিয়ে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি বলেন, "তখন কেউও আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতো না। শুধু ম্যাডাম তু আমাকে পরিত্যাগ করেননি। তিনি আমাকে সাহস দিয়েছেন।" এখন সিয়াও মা এইডস প্রতিরোধ সেচ্ছাসেবক দলের সদস্য এবং দলের সঙ্গে কমিউনিটি ও গ্রামে গিয়ে কাজ করছেন।
তু লি ছুন শুধু হাসপাতালের রোগীদের যত্ন নেন, তা নয়। রোগীরা হাসপাতাল ত্যাগ করার পরও তাদের সঙ্গে যোগযোগ বজায় রাখেন। যখন রোগীরা ওষুধ নিতে হাসপাতালে আসেন, তখন তু লি ছুন তাদের খোঁজখবর নেন। কোনো কোনো রোগীর কাছে তু লি ছুন জীবনের আলো।
তু লি ছুনের বিভাগের একজন তরুণ নার্স সিয়াও ছিং মাস ছয়েক আগে একবার একজন রোগীকে ইনজেকশান দিচ্ছিলেন। বেখেয়ালে রোগীর রক্ত গিয়ে পড়ে সিয়াও ছিংয়ের চোখে। পরে সিয়াও ছিং অসুস্থ বোধ করেন এবং বমি করেন। তার আশঙ্কা হলো, তিনি নিজে এইডসে আক্রান্ত হয়েছেন। পরিবারের কাউকে এক কথা বলার সাহস পেলেন না তিনি। তখন তিনি তু লি ছুনের কাছে আসেন এবং নিজের আশঙ্কার কথা তাকে জানান। সিয়াও ছিংয়ের কথা শুনে তু লি ছুন কোনো কথা না-বলে তাকে জড়িয়ে ধরেন।
তু লি ছুন তাদের কাজকে 'ছুরির ফলার ওপর নাচের' সাথে তুলনা করেন। এ কাজে ঝুঁকি আছে। রোগীদের রক্তের সংস্পর্শে আসলে তাদেরও রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থাকে। সিয়াও ছিংর মতো কেউ এইডস্ রোগীর রক্তের সংস্পর্শে এলে এক ধরনের ওষুধ খেতে হয়। সিয়াও ছিংয়ের উপসর্গগুলো ছিল এইডস্ রোগীর মতো। তাই সিয়াও ছিংয়ের এইডসে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল না।
নার্সদের কাজের ঝুঁকি কমাতে তু লি ছুন বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি রোগীদের শরীরে ইন্ট্রাভেনাস নিড্ল ব্যবহার করা শুরু করেন। এতে নার্সদের ঝুঁকি কমে যায়।
ভাগ্যক্রমে সিয়াও ছিং এইডসে আক্রান্ত হননি। এখন পর্যন্ত তু লি ছুনের অন্য কোনো সহকর্মীও এ রোগে আক্রান্ত হয়নি। তু লি ছুন বলেন, "আমার সহকর্মীদের অধিকাংশই তরুণ মেয়ে। এ কাজ তাঁরা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই করেন। তাদের সমর্থন ছাড়া আমি একা এ কাজ করতে পারি না।"
নান নিং চতুর্থ গণহাসপাতালের এইডস বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে। যখন এ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কেউই এ বিভাগে আসতে চাইছিলেন না। তু লি ছুন বলেন, "আমি ভাবলাম, সিপিসি'র সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্ব আছে। আমি না-এলে অন্যরাও আসতে চাইবে না।" তাই বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই তু লি ছুন প্রথম নার্স হিসেবে স্বেচ্ছায় এ বিভাগে যোগ দেন। এর আগে তিনি ছিলেন সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান নার্স। সংক্রামক রোগীদের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা ছিল স্বাভাববিকভাবেই বেশি।
বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দু'বছরে তু লি ছুন বেইজিং ও কুয়াং চৌতে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে হাসপাতালে ফিরে তিনি অন্যান্য নার্সদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, এবং গোটা বিভাগের পরিকল্পনাকাজের সঙ্গে যুক্ত হন।
তু লি ছুন এ বিভাগে ১২ বছর ধরে কাজ করছেন। এইডস রোগীদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ মাদক সেবন করতে চান। আবার কেউ কেউ নিজের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করতে উদ্যোগী হন। তু লি ছুনের নেতৃত্বে নার্সদের দলটিকে এসব সমস্যাও মোকাবিলা করতে হয়।
তু লি ছুন বলেন, "সিপিসির সদস্য হিসেবে আমাদের উচিত অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। যদি আমি ফ্রন্ট লাইনে না-দাঁড়াই, অবদান না-রাখি, তবে অন্যদের এমন কাজ করতে বলার অধিকার আমার থাকে না।"
তু লি ছুনের প্রভাবে এ বিভাগের নার্সদলের সদস্যসংখ্যা ৮ জন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ জনে। এদের মধ্যে ১০ জনের বেশি এরই মধ্যে হয় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন বা সন্তান প্রসব করেছেন। হাসপাতালের নীতি অনুযায়ী তারা অন্য বিভাগে স্থানান্তরিত হতে পারতেন। কিন্তু তু লি ছুনের প্রভাবে তারা কেউ এ বিভাগ ছেড়ে অন্যত্র যাননি।
সবচেয়ে ভালো নার্স, বেথুন ও নাইটিংগেল পদকসহ মোট ৫০টিরও বেশি পুরস্কার পেয়েছেন তু লি ছুন। তিনি বলেন, "এইডস রোগীরা বিশেষ একটি গ্রুপ। তাদের জন্য আমাদের যত্ন প্রয়োজন। আমার লক্ষ্য ভালভাবে নিজের কাজটি করা।"
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র একজন সাধারণ সদস্য তু লি ছুন। তিনি সাধারণ, কিন্তু তার কাজ ও স্বপ্ন অসাধারণ। আমরা তাকে শ্রদ্ধা জানাই। (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)