কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-সিপিসি চলতি মাসে তার উনবিংশতম জাতীয় কংগ্রেস আয়োজনের জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত। আশা করা যাচ্ছে এ কংগ্রেস থেকে চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্রের আরও উন্নত বিকাশের নতুন দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর সিপিসি অনেক বড় বড় বাঁধা সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছে। দৃঢ়ভাবে শিকড় আঁকড়ে ধরে উদ্ভাবনের সাথে এগিয়ে গিয়ে এই দল চীনকে বিশ্ব মঞ্চে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে সিপিসি'র এই অসাধারণ সাফল্যের নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
মার্ক্সবাদে বিশ্বাস
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের ভাববাদী ভিত্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকাকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করেছে। সিপিসিও এর ব্যতিক্রম নয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে 'মার্ক্সবাদ' এই দলের মৌলিক বিশ্বাস আর 'কমিউনিজম' এর শীর্ষ আদর্শ হিসেবে পরিগনিত হয়ে আসছে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সিপিসি এবং গোটা জাতিকে উন্নয়নের পথে পরিচালিত করার প্রয়াসে 'মার্ক্সবাদ' চীনা কমিউনিস্টদের উদ্ভাবিত সকল তত্ত্বের মূল ভিত্তি।
২০১২ সালে সিপিসি'র অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবেদনে যেমনটি বলা হয়েছিল- 'কমিউনিস্টদের বিশ্বাস মার্ক্সবাদে, সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম রাজনৈতিক আত্মা যা সকল বৈরী পরিস্থিতিতে তাদেরকে টিকিয়ে রাখে'
২০১৬ সালে সিপিসি'র ৯৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সমাবেশে সিপিসি'র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং মার্ক্সবাদ থেকে বিচ্যুতি অথবা তা পরিত্যাগের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এ ধরণের মৌলিক পরিচালন তত্ত্ব ব্যতিরিকে দল তার আত্মা হারাবে, হারাবে সঠিক গতিপথ।
এই প্রেক্ষিতে এটি মোটেই অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, সিপিসির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের সংগ্রহশালায় প্রদর্শনের জন্য রাখা 'কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো'র প্রথম চীনা সংস্করণ সংঘাত এবং বিপ্লবের সময়গুলোতেও অত্যন্ত যত্নের সাথে রক্ষিত ছিল।
এই সংগ্রহশালার প্রধান জাং লাইমিং (Zhang Liming) বলছিলেন, "সিপিসি এ'জন্যই চীনা জাতি এবং এর জনগণকে ঐতিহাসিক অর্জনের পথে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে যে, এই দল সব সময়ই তার প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য অর্জনের পথে অবিচল ছিল"।
সাংহাই সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমির গবেষক হুয়াং রেনই (Huang Renwei)এর মতে, 'মার্ক্সবাদের সফল প্রয়োগের ফলে চীনে সিপিসি এবং সমাজতন্ত্রবাদ দিনে দিনে আরও গতিশীল হয়ে ওঠছে'।
মানব কেন্দ্রিক উন্নয়ন
জিংগাংশানে(Jinggangshan) চীনের এক্সিকিউটিভ লিডারশীপ একাডেমিতে শিক্ষার্থীরা এমন কিছু গ্রামে কয়েকদিন থাকার সুযোগ পান যে গ্রামগুলো দারিদ্রের কবল থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়েছে। এর মাধ্যমে তাঁরা একটি পরীক্ষণ কোর্সে দারিদ্র মুক্তির সরাসরি অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকেন।
একাডেমীর নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মেই লিমিং (Mei Liming) বলেন, "এই কোর্সের উদ্দেশ্য হচ্ছে সিপিসি আধিকারিকদের মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া"।
জিংগাংশানকে (Jinggangshan) আনুষ্ঠানিকভাবে দরিদ্র এলাকার তালিকা থেকে বের করে আনার প্রতিকী তাৎপর্য রয়েছে কারণ, পূর্ব চীনের জিয়াংসি প্রদেশে সিপিসি'র প্রাথমিক বিপ্লবের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমি ছিল এই স্থান।
সিপিসির জন্ম হয়েছে জনগণের মধ্য থেকে। সুতরাং জনগণকেই এর শক্তি এবং প্রজ্ঞার উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১২ সালে সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর গণমাধ্যমকে সি চিন পিং বলেছিলেন, "মানুষের সুখী জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করাই আমাদের লক্ষ্য"।
সি বার বারই জোর দিয়ে বলেছেন যে, দলের সফল হওয়া নির্ভর করে জনগণের সমর্থনের ওপর।
সিপিসি এবং চীন সরকার মানুষের প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দেয় এবং সে অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করে। ফলাফল হিসেবে তা সামাজিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নে সাহায্য করে।
১৯৭৮ সালে সংস্কার এবং উন্মুক্তকরণ নীতি গ্রহণের পর চীনে ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করেছে। এই মুহূর্তের লক্ষ্য ২০২০ সালের মধ্যে সমগ্র দেশ থেকে দারিদ্র দূর করা।
বিদেশী বিশ্লেষকদের মতে তরুণ সম্প্রদায়ের বহুমুখী চাহিদা এবং অসন্তুষ্টি থেকে সামাজিক সমস্যার উৎপত্তি ঘটতে পারে। এই প্রেক্ষিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চীন উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিচ্ছে।
সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি পরিচালিত পার্টি স্কুলের অধ্যাপক দাই ইয়ান জুন (Dai Yanjun) বলেন, "মানুষের কল্যাণ অনুসন্ধানকে দলের মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্যের কেন্দ্রে স্থান দেওয়ার কারণে সিপিসি এবং সমাজতন্ত্র চীনে তাদের উপযোগিতা ধরে রাখতে পেরেছে"।
ধারাবাহিক সংস্কার ও উদ্ভাবন
সংস্কার এবং উম্মুক্তকরণ নীতি উদ্ভাবন, নতুন ধারণা, পদ্বতি এবং নীতি প্রবর্তনে নব যুগের সূচনা করেছে সিপিসি।
সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি পরিচালিত দলীয় স্কুলের অধ্যাপক হুয়াং সিয়াং হুয়াই (Huang Xianghuai) বলেন, "সমাজতন্ত্রের পথ, তত্ত্ব,পদ্বতি এবং চীনা বিশিষ্টতার সাংস্কৃতিক চরিত্র সিপিসির সৃজনশীলতার প্রমান'। অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের পর থেকে সিপিসি উদ্ভাবন, সমন্বয়, পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়ন, উন্মুক্তকরণ এবং অংশীদারিত্বের ধারণা চর্চায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
সি'র নেতৃত্বে সার্বিক সংস্কার গভীরতর করার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব-গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ৩৮ টি সভা করেছে। দেশব্যাপী বর্তমানে ১ হাজার সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও তদারকি করা হচ্ছে।
হুয়াং এর মতে, 'সিপিসি কখনই তার শক্তি হারাবেনা যতক্ষন পর্যন্ত তা উদ্ভাবন ও সংস্কার অব্যাহত রাখে'।
অভ্যন্তরীণ দলীয় কঠোর পরিচালন ব্যবস্থা
"লোহাকে বাগে আনতে লোহার মতই শক্ত হতে হয়"। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের ব্যাপক পরিবর্তন থেকে সিপিসি এই শিক্ষাই লাভ করেছে।
১৯৬২ সালে দল 'আত্ম-শৃঙ্খলা' নীতি প্রস্তাব করে। আর ১৯৮৫ সালে প্রস্তাব করে 'কঠোর অনুশাসন' নীতির। ২০১৪ সালে সি তুলে ধরেন যে, কঠোর এবং সার্বিকভাবে দলকে পরিচালনা করা একটি অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার।
দলের অভ্যন্তরে তদারকির জন্য সিপিসির গঠনতন্ত্র হচ্ছে ভিত্তি। স্বয়ংক্রিয় শৃঙ্খলা এবং কঠোর পরিচালন নীতি বজায় রাখতে গঠনতন্ত্রে বেশ কয়েকবার সংশোধনী আনা হয়েছে।
এর মধ্যে আইন ও বিধিও উন্নত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিপিসি ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে বর্তমান অবস্থার নিরিখে দলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক জীবনের অনুসরণীয় রীতি চালু করেছে এবং দলের অভ্যন্তরের তদারকি বিধিতে সংশোধনী এনেছে।
সিপিসির অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের পর কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরো ৮ দফা কৃচ্ছতা নীতি বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
কঠোর পরিচালন নীতি আর দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা সিপিসিকে শক্তিশালী হিসেবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।
যোগ্যতর ব্যক্তি নির্বাচন
সিপিসি সব সময়ই সঠিক এবং যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচন ও নিয়োগকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আসছে।
অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের পর আধিকারিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার আরও গভীরতর করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, তাঁরা শুধু ভোট,নম্বর, বয়স অথবা তাঁর এলাকার অর্জিত জিডিপির ভিত্তিতে নয় বরং ব্যাপক সংখ্যক বাছাই সূচকের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।
সি বলেন, 'দলের কাজ সুসম্পন্ন করতে বিস্তৃত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে সদস্য সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ'।
তিনি এ বৈচিত্রের গুরুত্ব বুঝেন কারণ দরিদ্র পীড়িত অঞ্চলের গ্রামের একজন কর্মকর্তা থেকে সিপিসি'র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে উন্নীত হয়েছেন সি।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন
চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে সি জেনিভায় 'মানব জাতির জন্য অংশীদারিত্বের ভবিষ্যত সম্পন্ন সম্প্রদায় গঠন' শীর্ষক একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এক মাস পর, ধারণাটি চীনের "বেল্ট এন্ড রোড" উদ্যোগের সাথে মিলিয়ে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
চীনের সংশ্লিষ্টতায় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, ব্রিক্স সম্মেলন, এপেক এবং জি-২০'র মত আন্তর্জাতিক পরিচালন ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান হারে কার্যকর হয়ে উঠছে। বিশ্ব পরিচালন ব্যবস্থায় চীনের অবদান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
একবিংশ শতকে বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দার পর কিছু পশ্চিমা দেশে তীব্র জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্বায়ন থেকে আলাদা থাকার নীতির উত্থান ঘটেছে।
শাসক দল সিপিসি বর্তমানকার অর্থনীতির বিশ্বায়ন এবং আন্ত সংযোগ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার নয় বরং যুক্ত করতে বেশী আগ্রহী।
দেশের অভ্যন্তরে সুশাসন চর্চার পাশাপাশি চীন বিশ্ব সংকটসমূহের সমাধানেও কাজ করতে যুগপৎভাবে সক্ষম হয়েছে।
সিপিসি চীনা বৈশিষ্টসম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশসমূহের আধুনিকায়নের সুযোগ বিস্তৃত করেছে। আর পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে চীনা প্রজ্ঞা ও বিশ্ব জুড়ে বিরাজমান নানা সমস্যার সমাধান সুত্র।
(সিনহুয়ায় ১১ অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ)
http://news.xinhuanet.com/english/2017-10/11/c_136671449.htm