মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সংখ্যা এরই মধ্যে ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। এখনো প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনার জন্য বারবার মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়ে আসলেও খুব একটা গা করছিল না দেশটি। তবে, এ বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ ও বাংলাদেশের জোর কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে মিয়ানমারের ওপর। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে আলোচনায় সম্মত হয় তারা। গত ২ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির দপ্তর বিষয়ক মন্ত্রী কিও তিন্ত সোয়ে বাংলাদেশে আসেন আলোচনার জন্য।
ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব কামাল আবদুর নাসের চৌধুরী বৈঠক করেন মিয়ানমারের সিনিয়র এই মন্ত্রীর সঙ্গে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় দুদেশের পক্ষ থেকেই দেওয়া হয় প্রস্তাব।
বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানান, দুদেশের কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। এ ছাড়াও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা হয় মিয়ানমার মন্ত্রীর সঙ্গে। তিনটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতাস্মারক সইয়ের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তি বা সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হয়নি বৈঠকে। মিয়ানমারের মন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনেও কোনো কথা বলেননি।
এ কারণে বৈঠকের ফলাফল নিয়ে সংশয় দেখা দেয় বিভিন্ন মহলে। প্রশ্ন ওঠে মিয়ানমারের সদিচ্ছা নিয়ে। মন্ত্রীর সফরকে লোক দেখানো বিষয় বলেও মনে করেন অনেকে। কারণ মন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে এ বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া বিষয়ে কোনো চুক্তি না হলেও ১৯৯২ সালে করা চুক্তির আওতায় তাদের ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা। তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. তাসনীম সিদ্দিকী মনে করেন, ২৫ বছরে মিয়ানমারের পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের মানুষ আরোও বেশি নেতিবাচক হয়েছে। তাই ২৫ বছর আগের চুক্তি দিয়ে এখনকার সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন নতুন চুক্তি। তবে, দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগেরর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে, ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তিন দিনের সফরে ঢাকা আসেন ৩ অক্টোবর। ৪ অক্টোবর তিনি বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে। বৈঠক শেষে তাদের উপস্থিতিতে তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ, রেল, সড়ক ও নৌ অবকাঠামোসহ ১৭টি অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর আগের দুদফা ঋণের মতো এক্ষেত্রেও বছরে এক শতাংশ হারে সুদ দেবে বাংলাদেশ। ঋণ পরিশোধে ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছর সময় পাওয়া যাবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতের অর্থমন্ত্রী বলেন, জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের এ উন্নয়নে অংশীদার হতে তার দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে বলেও জানান অরুণ জেটলি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার কথা স্মরণ করে আশা প্রকাশ করেন, আগামীতেও তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
২০১০ সালে প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয় ভারত। ওই ঋণে নেওয়া ১৬টি প্রকল্পের মধ্যে ১২টির কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ২০০ কোটি ডলার ঋণে ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এবার ভারত সর্বোচ্চ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এ অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।