লেনচৌ-ছং ছিং রেলপথ
  2017-10-14 20:30:24  cri

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। চীনের কান সু প্রদেশের রাজধানী লান চৌ। লান চৌ রেলস্টেশন থেকে রওনা হয়েছে একটি দ্রুতগতির পরিবহন-ট্রেন। ৯ বছরে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৮৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লেনচৌ-ছং ছিং রেলপথের। এই রেলপথ ধরেই এখন ছুটে চলবে এই ট্রেনটির মতো আরও অনেক ট্রেন।

গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে লান চৌ থেকে ছং ছিং যেতে কান সু, স্যান সি, সি ছুয়ানসহ বিভিন্ন প্রদেশের ২২টি জেলা অতিক্রম করতে হতো। এগুলোর মধ্যে ১৭টি আবার জাতীয় দরিদ্র জেলা। তখন দরিদ্র লোকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি এবং অনেক কৃষকের গড় বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৯০০ ইউয়ান।

দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য যোগাযোগ-ব্যবস্থা উন্নত করাকে অন্যতম প্রধান উপায় মনে করা হয়। লানচৌ-ছংছিং রেলপথ যেসব অঞ্চল দিয়ে গেছে সেসবের অধিকাংশই পাহাড়ি। ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যাবে, চীনের সিছুয়ান, কান সু ও শ্যান সি প্রদেশের সীমান্তে অবস্থিত লং নান জেলা। ইয়াং কা ন্যু দরিদ্র এ জেলার সাধারণ একজন নারী। ১৯৯৬ সালে সিনহুয়া বার্তা সংস্থার একজন সাংবাদিক তার বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। তার বাড়িতে ছিল না বিদ্যুত। কেরোসিনের বাতির মিটমিটে আলোতে সাংবাদিক তার বাড়ির দেয়ালে আঁকা একটি ট্রেনের ছবি দেখেন। তখন এ জেলায় কোনো রেলপথ ছিল না। ইয়াং কা ন্যু কখনও ট্রেনে চড়েননি। তিনি জানান, তার স্বামী এ ছবি এঁকেছেন। তিনি সাংবাদিককে প্রশ্ন করেন: 'একদিন কি আমরা এমন ট্রেনে চড়তে পারবো? বাইরের জগতটাকে দেখতে পারবো?" সাক্ষাত্কারশেষে ইয়াং কা নুয়ু তার মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়ান ট্রেনের ছবির সামনে। সাংবাদিক তাদের ছবি তোলেন। ২০ বছর পর ইয়াং কা ন্যু স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

পাহাড়ের অন্যদিকে, সি ছুয়ান প্রদেশের ছাং সি জেলার মানুষেরও একই স্বপ্ন ছিল। ১৯৯৪ সাল থেকে ছাং সি জেলার কার্যালয়ের পরিচালক চাও চুন কুও লানচৌ–ছুংছিং রেলপথ নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তার প্রস্তাবিত রেলপথ যাবে ৯টি শহরের ২৫টি জেলার মধ্য দিয়ে। ২০০০ সালে, 'দুটি অধিবেশন' চলাকালে, কানসু ও সি ছুয়ান প্রদেশ এবং ছুং ছিং কেন্দ্রশাসিত মহানগরের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে লানচৌ-ছুংছিং রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব তুলে ধরেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারও এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানায়। ২০০৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় লানচৌ-ছুংছিং রেলপথ নির্মাণের কাজ।

এ রেলপথ কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে।

ইয়াং কা ন্যু বাড়ি থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে অন্য একটি গ্রামে ইউয়ু চুন ছিয়াং নামের একজন ই–বাণিজ্য ব্যবসায়ী ইতোমধ্যেই ট্রেনের মাধ্যমে পণ্য পরিবরহনের পরিকল্পনা করেছেন। তিনি বছরে ১ কোটি ইউয়ান মূল্যের পণ্য বিক্রয় করতে পারেন। অথচ পরিবহনব্যবস্থার দুর্বলতা তার ব্যবসা উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। লানচৌ-ছুংছিং রেলপথ চালু হবার পর তিনি তার পণ্য আরও দ্রুত চীনের নানা জায়গায় পাঠাতে পারবেন এবং ব্যয়ও কমবে আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ। ইউয়ু চুন ছিয়াং বলেন, পরিবহন-ব্যয় কমায় তার যে অর্থ সাশ্রয় হবে, সেটা তিনি স্থানীয় মানুষের দারিদ্র্যবিমোচনের কাজে বিনিয়োগ করবেন। এভাবে আরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারবে। লানচৌ-ছুংছিং রেলপথসংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সমস্যা ছিল অভিন্ন। সম্পদ আছে, কিন্তু পরিবহনব্যবস্থা দুর্বল। এখন এ সমস্যা আর নেই। সিছুয়ানের শালুক, কান সুর জলপাই এখন রেলপথের মাধ্যমে বাইরে যেতে পারবে।

রোম একদিনে নির্মিত হয়নি। পাহাড়ি অঞ্চলে একটি রেলপথ নির্মাণও সহজ কাজ নয়। হু মা লিং সুরঙ্গ অতিক্রম করতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগে। অথচ এ সুরঙ্গ নির্মাণ করা ছিল কঠিনতম কাজ।

২০১১ সালের অগাষ্ট মাস। লানচৌ-ছুংছিং রেলপথ নির্মাণের তৃতীয় বছর। এর আগে সব কাজ সুষ্ঠভাবে চলেছে। হু মা লিং সুরঙ্গও কাটা হয়েছে। তবে ১৯ অগাষ্ট হঠাত করে সুরঙ্গে ধস নামে। জার্মান বিশেষজ্ঞ সবচেয়ে উন্নত সরঞ্জাম ও দল নিয়ে এসেছিলেন। তারাও বলেছেন, এখানে সুরঙ্গ নির্মাণ অসম্ভব। চীনের অভিজ্ঞ কর্মীরাও বলেছিলেন, তারা কখনও এমন ধরনের স্থানে সুরঙ্গ কাটেননি। বিগত ৫ বছরে হু মা লিং সুরঙ্গ নির্মাণকাজে বার বার বাধা এসেছে। ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা। ধস হলে আবার খনন শুরু হয়, আবার ধস হয়। ২০১৫ সালে চীনা কর্মীরা একটি সফল পরিকল্পনা তৈরি করেন। তারা বিশ্বে প্রথম এ ধরনের বিরূপ জায়গায় সুরঙ্গ নির্মাণে সক্ষম হন।

১৯১৯ সালে Sun Yat-sen লানচৌ-ছুংছিং রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ২১ শতাব্দী পর্যন্ত এ রেলপথ নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। হু মা লিং সুরঙ্গ শুধু একটি উদাহরণ। এ রেলপথ নির্মাণের সময় সংশ্লিষ্টরা একের পর এক বিশ্বরের্কড সৃষ্টি করেন। যারা এ রেলপথ নির্মাণে অংশগ্রহণ করেন তারা এখন পর্যন্ত চীনে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ১৫০টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং ৭০টি পেটেন্ট পান। এ রেলপথের নির্মাণ বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আগে পশ্চিম-উত্তর চীন ও পশ্চিম-দক্ষিণ চীনের মধ্যে সরাসরি রেলপথ ছিল না। এখন লানচৌ-ছুংছিং রেলপথ প্রতিবছর ৬ কোটি টন মালামাল পরিবহন করতে পারবে এবং লানচৌ থেকে ছুংছিং যাওয়ার ব্যয় তিন ভাগের এক ভাগ কমে যাবে এবং সময় তিন ভাগের দু'ভাগ কম হবে।

চীনে কয়লা সম্পদের ভারসাম্যহীনতা সমস্যাও সমাধান করতে পারে এ রেলপথ। ভবিষ্যতে সিন চিয়াং থেকে কয়লা আরও সহজে ও দ্রুত পশ্চিম-দক্ষিণ চীনে পাঠানো হবে। এ ব্যবসার বার্ষিক পরিমাণ হবে ১২০০ কোটি ইউয়ান।

চলতি বছরের অগাষ্ট মাসে ছংছিং, সিছুয়ান, কানসু ও কুইচৌ একটি সহযোগিতামূলক কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভবিষ্যতে লানচৌ-ছংছিং রেলপথের মাধ্যমে পণ্য শুধু চীনের ভিতরে নয়, বাইরেও পাঠানো হবে। লানচৌ থেকে ছংছিংতে পণ্য পাঠানোর পর তা কুয়াং সি প্রদেশের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে।

এ রেলপথ পশ্চিম চীনের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেও বেগবান করবে। (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040