আমার ইন ছুয়ান ও হে ফেই সফর-২
  2017-10-04 14:33:21  cri

ইন ছুয়ানে সফর শেষ করে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে আন হুই প্রদেশের রাজধানী হে ফেই-এর উদ্দেশে যাত্রা করি আমরা। ইন ছুয়ানকে যেমন 'স্মার্ট সিটি' বলে ডাকা হয়, তেমনি হে ফেইকে ডাকা হয় চীনের 'উদ্ভাবন ও নির্মাণের কেন্দ্র' বলে।

২১ সেপ্টেম্বর সকালে আমরা প্রথমে যাই University of Science and Technology of China-র উন্নত প্রযুক্তি গবেষণালয়ে। এখানে আমরা একটি প্রদর্শনীস্থল ঘুরে দেখি। এখানে উদ্ভাবন ও নির্মাণশিল্পে শহরটির অর্জিত সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যাই জাতীয় উচ্চ প্রযুক্তি শিল্প উন্নয়ন এলাকায়। সেখানে আমরা কয়েকটি উচ্চ প্রযুক্তি কোম্পানি পরিদর্শন করি। এদের একটি IFLYTEK । এটি চীনের সবচেয়ে উন্নত শব্দ চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান। এ খাতে কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি উন্নত পণ্যও বাজারে ছেড়েছে। IFLY Input তেমনি একটি অ্যাপ্লিকেশন। এ অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে মানুষের মুখের শব্দগুলো মোবাইল ফোনে লিখিত শব্দে পরিণত হয়। আঞ্চলিক ভাষা বললেও কোনো সমস্যা নেই। এ অ্যাপ্লিকেশন সব বুঝতে পারে। তা ছাড়া, গাড়ির জন্য তারা তৈরি করেছে একটি ভয়েস রিকগনিশান ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় কণ্ঠের মাধ্যমে গাড়ির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব; যেমন, কারকে ফোন করা, এসি চালু করা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, জিপিএস ব্যবহার করা ইত্যাদি। এ সবকিছু স্রেফ ভয়েসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

হে ফেই চীনের বৃহত্তম যন্ত্র নির্মাণকেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত কোম্পানি আছে। আন হুই প্রদেশের বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানি জেএসি ও জার্মানির ভক্সওয়াগেন কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে এখানে বিদ্যুতচালিত গাড়ি উত্পাদন করা হয়।

Lenovo-র বৃহত্তম গবেষণাকেন্দ্রও হে ফেইতে অবস্থিত। এখন বিশ্বে প্রচলিত লেনোভোর ৮টি মডেলের কম্পিউটারের মধ্যে একটি হেফেইতে উত্পাদন করা হয়। হে ফেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্ট চিকিত্সার ক্ষেত্রেও চীনের অন্যান্য শহরের তুলনায় এগিয়ে আছে।

২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে হে ফেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিন হুই কমিউনিটি এবং লেই চিয়ে নামক একটি কালচারাল স্ট্রিটে যাই আমরা। হে ফেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। এটি জাতীয় প্রথম শ্রেণীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর অন্যতম। এতে রয়েছে থিয়েটার, মাল্টি ফাংশন হল, লোক সংস্কৃতি প্রদর্শনী হল, শিল্প প্রদর্শনী হল ইত্যাদি। এখানে নাগরিকের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণ হয়।

  

বিদেশি বন্ধুরা এখানে এসে চীনের ঐতিহ্যের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেন। ফ্রান্সের সাংবাদিক আলেসান্দ্রা রেবেচিনি। মাটির বাসন তৈরির কাজে তিনি খানিকটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। তিনি জানালেন, এটাই তার প্রথম চীন সফর। চীনা ঐতিহ্যের ব্যাপারে তার আগ্রহ প্রবল। মাটির বাসন তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে এসে খানিকটা ধারণা পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি।

তারপর আমরা সবাই শিল্প প্রদর্শনী হলে যাই। রেবেচিনি জানান, এখানে প্রদর্শিত ছবিগুলোতে আধুনিক উপাদান দেখে তিনি খুব অবাক হয়েছেন। তিনি লক্ষ্য করেন, একটি আধুনিক ছবিতে চীনা প্রাচীন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিল্পের আধুনিক ফর্মের সাথে প্রাচীন কাহিনীকে যুক্ত করে চীনা ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি প্রচার একটি কার্যকর পদ্ধতি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

জার্মান সাংবাদিক ওলফরাম লবনিত্স ঐতিহ্যিক চীনা চিকিত্সা খুব পছন্দ করেন। তার মতে ঐতিহ্যিক চীনা চিকিত্সায় রয়েছে প্রাচীনকালের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। এ চিকিত্সা খাতে উন্নয়ন, নবায়ন ও উদ্ভাবনও চীনা সংস্কৃতির একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

তারপর সবাই আসি বিনহু কমিউনিটিতে। এখানে হে ফেইয়ের সাধারণ নাগরিকের জীবন সম্পর্কে জানাশোনা হয় সবার। আমাদের বিদেশি বন্ধুরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেশেন। তারা টেবিল টেনিস খেলেন, একসঙ্গে হস্তলিপিশিল্প ও নৃত্য চর্চা করেন।

 

ইরানের সাংবাদিক মোজগান নাচলেন। তিনি বলেন, তার দেশেও কমিউনিটি সেবাকেন্দ্র আছে, তবে তা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। অথচ এখানে সবাই নিজ নিজ পছন্দের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে।

এদিনের শেষদিকে আমরা যাই লেই চিয়েতে। এটি একটি খাবার ও সংস্কৃতি রাস্তা। এখানে মানুষ স্থানীয় খাবার খেতে পারে এবং নানা চীনা ঐতিহ্যিক নাটক বা অপেরাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করতে পারে। এখানে আমরা সবাই 'সিয়াং সেং' নামক চীনা ঐতিহ্যিক শো উপভোগ করি। ভাষা বাধা হলেও, সবাই খুব মজার এক সময় কাটাই।

২৩ সেপ্টেমর প্রতিনিধিদলটি আসে হে ফেই শহরের ফেই সি জেলায়। জেলায় আমাদের গন্তব্য সেন হে নামক একটি উপজেলা। এটি চীনের বিখ্যাত একটি পুরাতন নগর। যাওয়ার পথে আমরা পৌঁছাই ইয়ান তিয়ান উপজেলায়। এখানে আমরা স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে ভাব বিনিময় করি। তাদের আন্তরিকতা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। গ্রামবাসীদের সবার মুখেই হাসি। বাচ্চা কোলে মা, ক্রীড়ারত শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী-পুরুষ—সবার মুখে আমি আন্তরিক হাসি দেখেছি। তারা খুবই শান্ত ও সুন্দর এক পরিবেশে জীবনযাপন করে। সহজ-সরল জীবনের প্রতিফলন যেন তাদের এই মুখের অম্লান হাসি।

সফরের শেষ গন্তব্য সান হে পুরাতন নগর। 'সান' মানে 'তিন', 'হে' মানে 'নদী'। তিনটি নদী এখানে মিলিত হয় বলে নগরের নাম এমন হয়েছে। এ নগরের আগের নাম ছুয়ে চু। এর মানে পাখির দ্বীপ। সান হে চীনের ৫ তারকা দর্শনীয় স্থান। চীনের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামীণ নগরের পুরস্কার পেয়েছে সান হে।

যেদিন আমরা সান হে যাই, সেদিন বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টিতে পুরাতন নগরে হাঁটাহাটি করা এবং ছোট নৌকায় বসে এ পুরাতন নগরকে দেখা খুবই আনন্দের ব্যাপার। সফরের সবচেয়ে সুন্দর ও রোমান্টিক সময় কেটেছে আমাদের এই নগরে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040