জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য
  2017-09-24 18:50:32  cri
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের জন্য। কারণ এবারের সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্ধুতে ছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ তারিখ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন। সেনানির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ৫ দফা প্রস্তাবও উপস্থাপন করেন বিশ্বনেতাদের সামনে। এ ইস্যুতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নিজের ১৪তম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা তুলে ধরেন বিশ্বনেতাদের সামনে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘণের ফলে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তা বর্ণনা করেন তিনি। এতে করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কক্সবাজারে নিরাপত্তাহীনতাসহ যে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে তাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা ৭৫'এর হত্যাযজ্ঞের পর নিজের উদ্বাস্তু জীবনের কথা তুলে ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান। এবারসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। রোহিঙ্গাদের হাজার বছরের আবাসভূমি রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে ও পুনর্বাসনে ৫ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

প্রস্তাবগুলো হলো:

এক. অবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তে বন্ধ করা।

দুই. অনতিবিলম্বে জাতিসংঘ মহাসচিবের একটি অনুসন্ধানী দলকে মিয়ানমারে প্রেরণ।

তিন. মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা।

চার. রাখাইন থেকে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে নিজেদের বাড়িঘরে পুনর্বাসন করা।

৫. কফি আনান কমিশনের সুপারিশ নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

মিয়ানমারে চলামন সহিংসতা বন্ধ করে সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় জাতিসংঘ মহাসচিবসহ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার ভাষণ বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ দেখানোয় বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতায় বিভিন্ন উপলক্ষে তারা বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়া। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেন। বিশ্বের আর কোথাও যেন এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর না ঘটে সেজন্য বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

জাতিসংঘে ভাষণের আগে প্রধানমন্ত্রী ওআইসি কন্ট্যাক্টগ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরেন এবং মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট আয়োজিত বিশ্বসংস্থার সংস্কার বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেন। এসডিজি বাস্তবায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রন্ত বিভিন্ন আলোচনায় যোগ দিয়ে দিকনির্দেশনমূলক বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো অবস্থানের কারণে বিশ্বনেতারা এ বিষয়টিতে অধিকতর মনোযোগী হন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন, ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোসহ বিশ্বনেতারা রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের নিন্দা করেন এবং অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপেরও আহ্বান জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যু এড়িয়ে গেলেও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স জানিয়েছেন ট্রাম্পও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের বলিষ্ঠ ও দ্রুত পদক্ষেপ চান।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ ও জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরব উপস্থিতি এরই মধ্যে ফল দিতে শুরু করেছে। এতদিন মিয়ানমার বিষয়টি নিয়ে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে বসতে আগ্রহ না দেখালেও সুচি এনিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশকে। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং টুন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য সুচির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমার সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।

এ বিষয়টিকে বাংলাদেশের বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ জোরালো যে কূটনৈতিক তৎপরতা নিয়েছে তা অব্যাহত থাকবে এবং বিষয়টির একটি সন্তোষজনক সমাধান হবে-এমন আশা দেশের মানুষের।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040