0920
|
বাতাস ও বৃষ্টির মধ্যে একটি বাস আন হুই প্রদেশের চিন চাই নামক একটি পাহাড়ি অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। 'তা পিয়ে' পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে বাসটি। ওখানে আছে চীনের প্রথম 'হোপ প্রাইমারি স্কুল' বা 'আশা প্রাথমিক বিদ্যালয়'।
চীনা যুব তহবিলের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে চালু হয় 'আশা প্রকল্প'। এ প্রকল্পের আওতায় সমাজ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে দরিদ্র ও পশ্চাত্পদ অঞ্চলের শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়।
বাসে বসে আছেন ৮৪ বছর বয়সি চৌ হুও সেং। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। এর আগে তিনি ৯৮ বার এখানে এসেছেন। এটি তার ৯৯তম যাত্রা। তিনি চিয়াং সু প্রদেশের খুন শান শহরের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। গত ২২ বছর ধরে তিনি নিজের চোখে চিন চাই পাহাড়ি অঞ্চলের পরিবর্তন দেখেছেন। এখানকার কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে; দরিদ্র ও পশ্চাত্পদ অঞ্চলটি হয়েছে সমৃদ্ধ। চৌ হুও সেং-এর শরীর আগের মতো ভালো নেই। তিনি জানালেন, বাকি জীবন তিনি 'আশা প্রকল্প'-কেই 'জীবনের প্রকল্প' হিসেবে গণ্য করবেন।
এর আগের দৃশ্য; সকাল ৬টা। খুন শান শহরে নিজ বাড়িতে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন চৌ হুও সেং। পুরাতন এই বাড়িতে কোনো দামী আসবাবপত্র নেই। আছে, অসংখ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। চৌ হুও সেং এই বইগুলো রেখেছেন আশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য। গেল বছর চৌ হুও সেং একবার সেরিব্রাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই তার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। তবে আজ তিনি খুব আনন্দিত। কারণ, এখন তিনি ৫০০টি বই এবং ৩০ হাজার ইউয়ান নিয়ে চিন চাই জেলায় তার প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করবেন।
১
৯৯২ সালে চৌ হুও সেং টিভির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো চিন চাই আশা প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে অবগত হন। তিনি তখন ভাবলেন, অবসর নেয়ার পর নিশ্চয় একবার ওখানে যাবেন। তিন বছর পর তিনি অবসর নিলেন এবং ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো চিন চাই আশা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। বিদ্যালয়ে তার প্রথম দিন তিনি কোনোদিন ভুলবেন না। তিনি দেখলেন, দো'তলা একটি মাটির ভবনে একটি মাত্র ক্লাসরুম। ছোট ঘরে ৭০ জন ছাত্রছাত্রী। টেবিল বলতে শুধু লম্বা একটি বোর্ড। কোনো চেয়ার নেই। শিক্ষার্থীরা যার যার বাড়ি থেকে বসার জন্য চেয়ার, টুল ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। স্কুলের জানালা তৈরি হয়েছে কাগজ দিয়ে; নেই কোনো বিদ্যুত বা টয়লেট। চৌ হুও সেং সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি এ বিদ্যালয়ের উন্নয়নে কাজ করবেন।
তিনি খুন শান ফিরে গেলেন এবং বই বিক্রয় করা শুরু করলেন। তিনি একটি ত্রিচক্রযানে করে খুন শান শহরের বিভিন্ন স্কুল ও দোকানে বই বিক্রয় করতে লাগলেন। একটি ব্যানারও তিনি বানিয়ে নিলেন। ব্যানারে লেখা ছিল: 'আশা প্রকল্প দাতব্য বিক্রয়'। এ ভাবে তিনি দীর্ঘ ২২ বছর প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বই বিক্রি করে অর্থ জমিয়েছেন। এ সময়ে তিনি বিক্রি করেছেন প্রায় ২ লাখ বই। ২২ বছরে তার ৪টি ত্রিচক্রযান ভেঙেছে। মাঝে মাঝে তিনি নিজের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের বই নিয়ে বাসযোগে গন্তব্যে যেতেন, বই বিক্রি করতে।
১৯৯৫ সালের বসন্তকালে চৌ হুও সেং নিজের সঞ্চয় ও বই বিক্রির টাকা নিয়ে প্রথম চিন চাই পাহাড়ি অঞ্চলে যান এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সে অর্থ দান করেন। বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে তিনি ট্রেন ও বাসে চড়ে এবং পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন ৬০০ কিলোমিটার। তখন থেকেই চিন চাই প্রাথমিক বিদ্যালযে যাওয়া-আসা করা তার জীবনের অংশে পরিণত হয়। বই বিক্রি করে অর্থ জমান এবং সেই জমানো অর্থ নিয়ে চলে যান বিদ্যালয়ে। এভাবে তিনি ৯৮ বার বিদ্যালয়ে গেছেন। এবার তার ৯৯তম যাত্রা।
অর্থ সাশ্রয়ের জন্য চৌ হুও সেং সবসময় সবচেয়ে সস্তা ট্রেন টিকিট কেনেন এবং সবচেয়ে সস্তা হোটেলে বসবাস করেন।
বাস থেকে নামতেই তার কাছে ছুটে আসে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে আছে বড় বড় চোখের একটি লম্বা মেয়ে। তার নাম লিয়াও লান। সে গত ৯ বছর চৌ হুও সেংয়ের সাহায্যে পড়াশুনা করছে।
২০০৫ সালে লিয়াও লানের বাবা মারা যান এবং মা নিঁখোজ হন। চাচা-চাচির সঙ্গে শুরু হয় তার বসবাস। পরে তার চাচা ও দাদিও মারা গেলেন। চাচি তাকে বিদ্যালয়ে পড়াতে চাইলেন। কারণ, শিক্ষা দারিদ্র্য থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। কিন্তু তার টাকা নাই। লিয়াও লানের গল্প শুনে চৌ হুও সেং স্থানীয় সেচ্ছাসেবকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং লিয়ান লান এবং তার দুই ভাই-বোনকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া শুরু করেন।
লিয়াও লান ও তার বড় বোন গত বছর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। যখনই চৌ হুও সেং আসেন, লিয়াও লান তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। লিয়াও লান বললো, "চৌ দাদা আমাকে প্রায়ই বলেন, অনেক মানুষ আমাদেরকে সাহায্য করেন। আমাদের উচিত তাদেরকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানানো।" তাই এবার সে দু'টি চিঠি লিখে নিয়ে এসেছে।
গত ২২ বছরে চৌ হুও সেং বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, জমেছে অনেক স্মৃতি। কিন্তু এই পাহাড়ি শিশুদের সঙ্গে তার স্মৃতি অন্যরকম। তিনি বলেন, লেখাপড়ার প্রতি তাদের তীব্র আগ্রহ তাকে আনন্দ দেয়।
ই সান মেই নামের একটি মেয়েও চৌ হুও সেংয়ের সাহায্যে লেখাপড়া করেছে। তার মা মূক ও বধির, বাবা বৃদ্ধ। তার ছোট দুটি বোনও আছে। তার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় ই সান মেই। তখন মা গুরুতর অসুস্থ। ই সান মেই বিশ্ববিদ্যালয়ে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে চৌ হুও সেং তাকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিলেন। ই সান মেই জানায়, চৌ দাদা তার জীবনে নতুন আশার সঞ্চার করেছেন। অবশেষে চৌ হুও সেংয়ের সাহায্যে ই সান মেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর সে এখন চিন চাই জেলার বাজার পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যুরোর একজন কর্মী। তার ভাগ্য পুরোপুরি বদলে গেছে।
অনেকে চৌ হুও সেংয়ের প্রভাবে এ কাজে অংশ নিচ্ছেন। উ ওয়ে লিন ও তার স্ত্রী ছি ফাং ২০০৪ সালে চৌ হুও সেংয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। তখন থেকে তারাও নিয়মিতভাবে চিন চাই জেলায় আসছেন এবং শিশুদের সাহায্য করে যাচ্ছেন। ২০১০ সালে এ দম্পতির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় 'খুন শান শহর চৌ হুও সেং আশা প্রকল্প স্বেচ্ছাসেবক কমিটি'। উ ওয়ে লিন এ সংস্থার উপপ্রধান। গত ১২ বছরে উ ওয়ে লিন দম্পতি বারো জন ছাত্রছাত্রীকে সাহায্য করেছেন এবং ৬ লাখ ইউয়ান অনুদান দিয়েছেন।
খুন শান শহরে এখন অনেকেই চৌ হুও সেংয়ের গল্প জানেন। তারা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। পুলিশ তাকে বই বিক্রয় করতে দেখলে স্যালুট করে। অনেকে চৌ হুও সেংকে বই বিক্রি করতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহায্যও করেন।
একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, "চৌ দাদা প্রতিবার একেকজন শিশুকে ৫০০ থেকে ১০০০ ইউয়ান অনুদান দেন; অথচ নিজে শুধু ২০ ইউয়ানের কাপড় পরেন।"
গত ২২ বছরে চৌ হুও সেং ও স্বেচ্ছাসেবকরা চিন চিইয়ের শিশুদের ১ কোটি ইউয়ান অনুদান দিয়েছেন। তাদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ৫টি স্কুল। তাদের সাহায্যে অন্য ১০টি স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হয়। সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রী তাদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে।
এখন চৌ হুও সেং-এর দেখাদেখি অনেকেই এ কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। চিন চাইয়ের বাইরের অন্য দারিদ্র অঞ্চলেও তারা এখন সাহায্য দিচ্ছেন।
চৌ হুও সেং 'তা পিয়ে' পাহাড়ে তার ৯৯তম যাত্রা শেষ করেছেন। যাত্রা শেষ করে জানালেন, তিনি অন্তত আরও একবার অর্থাত শততম বার এখানে আসতে চান। আর যদি সম্ভব হয় ১০১তম, ১০২তম...বার বার আসতে চান। চৌ হুও সেংয়ের এই আসা-যাওয়া চলতে থাকুক, আরও অনেক অনেক বছর, এই কামনা করি। (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)