চীনা পরিবারে শিশুদের যত্নে পিতার অংশগ্রহণ নিয়ে জরিপ
  2017-09-11 14:28:28  cri

 


চলতি বছরের গ্রীষ্মকালে ভারতের চলচ্চিত্র 'দঙ্গল' চীনে প্রদর্শিত হয় এবং অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই সঙ্গে চীনের বিখ্যাত অভিনেতাদের অংশগ্রহণে রিয়েলিটি শো 'বাবা আমরা কোথায় যাবো' ব্যাপকভাবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

আসলে বর্তমানে শিশুদের বেড়ে ওঠায় পিতা যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে ব্যাপক মতৈক্য তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমত, চলমান পরিস্থিতিতে পরিবারে শিশুদের শিক্ষায় পিতা কতভাগ অংশ নিতে পারেন? দ্বিতীয়ত, এ ক্ষেত্রে পিতা অংশ নিতে চাইলেও কেন তিনি তা পারেন না? এর পিছনের কারণগুলো কি?

এ বিষয়ে চীনের শাংহাই শিক্ষা বিজ্ঞান গবেষণাগারের পরিবার শিক্ষা গবেষণা ও নির্দেশনা কেন্দ্র একটি জরিপ প্রকাশ করেছে।

শাংহাই শহরের একটি সরকারি বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ৩৮২ জন পিতার ওপর জরিপটি চালানো হয়। এর ফলাফল থেকে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারা শিশুদের শিক্ষা ও দেখাশোনায় খুব কম অংশ নেন এবং এর মূল কারণ হল তাদের কর্মস্থলের অতিরিক্ত চাপ।

জরিপের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, শাংহাই শিক্ষা বিজ্ঞান গবেষণাগারের পরিবার শিক্ষা গবেষণা ও নির্দেশনা কেন্দ্রের পরিচালক ইউ ছিন ফাং বলেন, বিদেশের গবেষণা বিবেচনা করে পরিবারে শিশুদের যত্নে পিতার অংশগ্রহণের বিষয়টি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। বিদেশি পণ্ডিতদের গবেষণা অনুসারে, পিতার দায়িত্ব অর্থনৈতিক সমর্থন, শিশুর মাকে সমর্থন, শিশুর যত্ন ও তাদের দায়িত্বে প্রশিক্ষণ, লেখাপড়ায় উত্সাহ দেওয়া, প্রশংসা করা, শিশুদের সাথে কথাবার্তা, তাদের নিয়মিত জীবনে যত্ন নেওয়া, বই পড়ানো ও বিভিন্ন দক্ষতার উন্নয়নে উত্সাহ দেওয়া ইত্যাদি।

শাংহাইয়ের স্থানীয় রীতিনীতি বিবেচনা করে পিতার দায়িত্ব 'টাকা সরবরাহকারী' থেকে 'শিশুর যত্ন' পর্যন্ত কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এতে শিশুদের পরোক্ষ সমর্থন, সহচারী, শিক্ষার পরিকল্পনা, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, হোমওয়ার্ক দেখা, জীবনযাপনের যত্ন এবং স্কুলের সাথে যোগাযোগসহ মোট ৭টি ভাগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এ জরিপ থেকে বোঝা যায়, শাংহাইয়ের পিতাদের দায়িত্বের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থ সমর্থন এবং শিশুর মাকে উত্সাহ দেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়েছে, তবে শিশুদের স্কুলের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে তারা খুব কম অংশ নেন। আর শিশুদের সহচারী হিসেবে যে দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে, তা বিভিন্ন দায়িত্বের মধ্যে মাঝামাঝিতে অবস্থিত।

পিতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা শিশুর যত্নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। যারা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন, তারা শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষা, সহচারী, লেখাপড়ায় সহায়তা, শিক্ষার পরিকল্পনা এবং স্কুলের সাথে যোগাযোগে আরো বেশি দায়িত্ব পালন করেন।

তাছাড়া, বেতনের ব্যবধানও পিতাদের অংশগ্রহণে প্রভাব ফেলে। শিশুদের সহচারী ও পরোক্ষ সমর্থনে নিম্ন বেতনের পিতা উচ্চ বেতনের পিতার চেয়ে আরো ভালো। তারা শিশুদের আরো বেশি সময় দেন এবং শিশুর মাকেও মানসিক সমর্থন দেন।

এ সম্পর্কে গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ইউ ছিন ফাং বলেন, জরিপ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় পাওয়া যায়। যেমন-

১. শিশুদের যত্নে পিতার অংশগ্রহণে কাঠামোগত অভাব রয়েছে। তা থেকে বোঝা যায়, পিতা পরিবারের নির্ভরশীলতার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তারা পরিবারের বাইরে দায়িত্ব পালন করেন, আর মা পরিবারের ভিতরে দায়িত্ব পালন করেন। এ ঐতিহ্যিক চিন্তাধারার প্রভাবে শিশুদের যত্নকে মায়ের দায়িত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আসলে এ কাঠামোগত অভাবের পরিবর্তনে জন্য পিতাদের নিজেদের সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ অনেক গবেষণা থেকে জানা গেছে, পিতারাও মায়েদের মতো শিশুদের ভালোভাবে যত্ন নিতে সক্ষম। তাদের বেড়ে ওঠায় পিতাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা দরকার এবং এতে আরো দরকার সমাজের সুষ্ঠু পরিবেশ।

২. জরিপ থেকে জানা গেছে, পিতারা মনে করেন, শিক্ষার পরিকল্পনা ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা শিশুদের সহচারী হওয়ার চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ, তাই শিশুদের জীবনযাপনে নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী পিতারা। এজন্য তারা শিশুদের জন্য নানান নীতিমালা প্রণয়ন করেন এবং যখন শিশুরা কোনো ভুল করে তখন তাদের সমালোচনা ও শাস্তি আরোপ করেন।

মানসিক আদান-প্রদানে পিতাদের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। জরিপ অনুসারে, ২২ শতাংশ পিতা খুব কম শিশুদের আলিঙ্গন বা চুমু দেন, আর ৩০ শতাংশেরও বেশি পিতা কখনো শিশুদের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেন না। যদিও লোকজনের চিন্তাধারা পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক পিতা শিশুদের যত্নে আগের চেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করেন, তবে অধিকাংশই মায়ের মতো শিশুর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন না।

৩. শিশুদের যত্নে পিতাদের দায়িত্ব পালনে যে ঘাটতি দেখা যায় তা নিজেদের চাকরির সাথে জড়িত। জরিপ থেকে জানা গেছে, যদিও পিতাদের মধ্যে কয়েকজন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন নি, তবে শিশুদের সহচারী ও মাকে মানসিক সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে নিম্ন বেতনের পিতারা অনেক মনোযোগী। এ থেকে বোঝা যায়, চাকরিতে বেশি সময় দেওয়ার কারণে পিতারা শিশুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না।

বিদেশের গবেষণা থেকে জানা যায়, চাকরিতে অতিরিক্ত চাপ থাকলে পিতাকে কর্মস্থলে আরো বেশি সময় দিতে হয়, এ কারণে তারা শিশুদের সাথে অবস্থানের সময় খুব কম পান।

৪. শিশুদের স্কুলের পড়াশোনায় কম মনোযোগ দেন পিতারা। জরিপ থেকে জানা গেছে, শাংহাইয়ের প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় পিতার অংশগ্রহণ সম্পর্কে স্কুলের সাথে যোগাযোগের ফলাফল সবচেয়ে দুর্বল। ৩৮২ জন পিতার মধ্যে স্কুলের বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণের সংখ্যা মাত্র ৪০.৩ শতাংশ, স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অগ্রগতি জানার সংখ্যা মাত্র ৩৫.৫ শতাংশ, আর শিশুর শিক্ষকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এবং স্কুলে শিশুদের আচরণ সম্পর্কে জানার সংখ্যা মাত্র ২৭ শতাংশ। শিশুর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়মিতভাবে স্কুলে আসা পিতার সংখ্যা মাত্র ৬.৭ শতাংশ।

বহু বছর ধরে পরিবারের শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করার পর পরিচালক ইউ মনে করেন, পরিবারে শিশুদের যত্নে পিতার অংশগ্রহণের ঘাটতি এখন চীনের সমাজে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। এ সমস্যা সমাধানে কয়েকটি দিক থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন-

১.আত্মসচেতনতা:

পিতাদেরকে নিজেদের দিক থেকে শিশুদের যত্নে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পিতাদের দায়িত্ব শুধু জ্ঞান বৃদ্ধি নয়, শিশুদের আবেগ ও চরিত্র গঠনেও ব্যাপকভাবে মনোযোগ দিতে হবে।

পিতারা যখন শিশুদের যত্নে অংশ নেন, তখন নিজেদের উন্নতিও লক্ষ্য করা যায়। অনেক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, শিশুদের যত্নে অংশগ্রহণ কিছু মাত্রায় নিজেদের চাকরিতে সফলতা অর্জন ও চরিত্রের উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

২. দাদা-দাদী ও নানা-নানীর ভূমিকা:

বর্তমানে চীনের শাংহাই শহরে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির আগে শিশুর যত্নে দাদা-দাদী বা নান-নানীর অংশগ্রহণের পরিমাণ ৭৩.৪ শতাংশ। তাদের অংশগ্রহণে অনেক পিতা মনে করেন শিশুদের যত্ন নেওয়া পরিবারের অন্য সদস্যের দায়িত্ব। তাই পিতাদের দায়িত্ব আরো ভালভাবে পালন করার জন্য দাদা-দাদী বা নানা-নানী নিজেদের দিক থেকে শিশুদেরকে যত্ন নেওয়ার সময় কমিয়ে দিতে পারেন, যাতে পিতা বাধ্য হয়ে শিশুদের সহচারীর ভূমিকা পালন করতে পারেন।

৩. সামাজিক সমর্থন:

ব্যাপকভাবে বিবেচনা করে দেখা যায়, শিশুর যত্নে পিতার অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ অনেক প্রভাব ফেলে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে পিতাদের জন্য বিশেষ ছুটির ব্যবস্থা আছে, যাতে তারা এমন ছুটি নিয়ে শিশুদের সাথে বেশি দিন অবস্থান করতে পারেন।

তবে চীনের পিতারা চাকরিতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, ফলে তারা শিশুদের যত্নে খুব কম দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাই এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত, যাতে পিতাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও শিশুদের যত্নের সুযোগ তৈরি করা যায়।

৪. স্কুলের নির্দেশনা:

পরিবারে পিতার সময়ের ঘাটতি সমস্যার বিরুদ্ধে স্কুলগুলো পিতার দায়িত্ব নিয়ে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান ও পরিসেবার প্রকল্প চালু করতে পারে। যেমন- স্কুলে পিতাদের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করা, যা ব্যাপকভাবে পিতা ও শিশুর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে শিশুর যত্নে পিতাদের বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করা ও এ ব্যাপারে তাদের অংশগ্রহণের সচেতনতা উন্নীত করা উচিত্।

এবারের জরিপ প্রকাশনার সময় দু'জন পিতার শিশুদের যত্নের গল্প শেয়ার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন পিতার নাম ছেন হু মিং। তিনি ২০১৬ নতুন পিতামাতার বার্ষিক প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর মেয়ের পড়াশোনা ছাড়াও, বিভিন্ন শখের উন্নয়ন ও জীবনযাপনে যত্ন নেন তিনি। তাঁর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর চীনের ইউয়ুননান প্রদেশের পাহাড়াঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে দু'বছরের মতো কাজ করেন।

অন্য একজন শ্রেষ্ঠ পিতার নাম ওয়াং ওয়ে ছিং। তিনি নিয়মিতভাবে তাঁর মেয়েকে বই পড়া ও মৌখিক দিনলিপি লিখতে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর মেয়ে প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে মোট ৭.৬ লক্ষ অক্ষরের দিনলিপি সম্পন্ন করেছে।

শাংহাই শিক্ষা বিজ্ঞান গবেষণাগারের পরিবার শিক্ষা গবেষণা ও নির্দেশনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাচ্চাদের দেখাশোনায় পিতার অংশগ্রহণ নিয়ে জরিপ করা হয়েছে। তাতে পরিবারে পিতার দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ কেন্দ্র পিতাদের জন্য একটি চিঠি লিখেছে। চিঠিতে পিতাদেরকে শ্রেষ্ঠ পিতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে কিছু টিপস দেওয়া হয়েছে। যেমন- পিতা হতে হলে আবেগ ছাড়াও শিক্ষাবিষয়ক তত্ত্ব ও সঠিক উপায় জানতে হবে।

পিতাদের যথাযথভাবে নিজের চাকরি পাশে রেখে স্ত্রী ও সন্তানদের যত্নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সন্তানদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে অবস্থান করা, প্রতিদিন তাদের সাথে সুন্দর সময় কাটানো ও তাদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার প্রতি মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। শিশুরা পিতার হাতে হাত রেখে চমত্কারভাবে বড় হওয়ার প্রক্রিয়া অনুভব করবে বলে আশা করে গবেষণা কেন্দ্রটি।(সুবর্ণা/টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040