বেইজিংএ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চীনা-বাংলা সাহিত্য সংলাপ ২০১৭
  2017-09-10 19:43:32  cri

গতকাল (শনিবার) বেইজিংএ লু শুন জাদুঘরের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চীনা-বাংলা সাহিত্য সংলাপ ২০১৭। চীন আন্তর্জাতিক বেতার এবং চীনের প্রকাশনা ও প্রচার সংস্থার যৌথ আয়োজনে এবারের সাহিত্য সংলাপের বিষয় ছিল চীনা ভাষার অন্যতম প্রধান সাহিত্য ব্যক্তিত্ব এবং দার্শনিক লু শুন ও বাংলা ভাষার বহুমুখী প্রতিভাধর কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা। এছাড়াও ছিল চীনে বাংলা ভাষা চর্চাকারী শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত এম ফজলুল করিম, চীন আন্তর্জাতিক বেতারের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান..., চীনের প্রকাশনা ও প্রচার সংস্থার উপ মহাপরিচালক এবং চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগের প্রধান ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী বর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটি নানা দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রায় ৫০ বছর আগে চালু হওয়া সিআরআই এর বাংলা বিভাগ তার নিজস্ব কর্তব্যবোধ থেকে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। চীনে বাংলা ভাষার প্রসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিআরআই এর বাংলা বিভাগ এক ধরণের অভিভাকত্বের ভূমিকা পালন করে আসছে। চীনে বিশুদ্ধ বাংলার প্রসার ও চর্চায় এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। শনিবারের সাহিত্য সংলাপ এরই ধারাবাহিকতা। একই অনুষ্ঠানে শীর্ষ কূটনীতিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক-গবেষক, শিক্ষার্থী এবং প্রকাশকদের সম্মিলন সত্যি এক বড় অর্জন।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রায় স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা নরুলের সাহিত্য চর্চার ব্যপ্তিকাল মাত্র ২২ থেকে ২৩ বছর। এই সময়ে তিনি সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে উচ্চ মানের রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। রচনা করেছেন ৪ হাজারের বেশী গান। এসব গানের বেশীর ভাগের সুরকার তিনি নিজেই। তৈরি করেছেন একটি স্বতন্ত্র সঙ্গীত ধারা। তাঁর কবিতার মাধ্যমে পরাধীন জাতির মনে ঘটিয়েছেন স্বাধীনতার স্পৃহা। বাংলা ভাষায় আরবী ফার্সি শব্দের এক জাদুকরী সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন নজরুল।

তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের ওপর নজরুল সাহিত্য দণ্ডায়মান। সাম্য, মানবতা আর অসাম্প্রদায়িকতা। আজকের এই দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিশ্বে তাই নজরুল অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। অনেক দেশেই আজ ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ঘটে চলেছে মানবতার লঙ্ঘন। নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে কারো কারো ওপর নেমে আসছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। তাঁর সময়ে নজরুল প্রচার করেছিলেন

গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান

যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম খ্রিষ্ঠান।

এ রকম এক প্রেক্ষিতে সাহিত্য সংলাপের বিষয় হিসেবে নজরুল কে বেছে নেওয়াটা অত্যন্ত সময় উপযোগী। পাশাপাশি চীনের মহান সাহিত্যিক লু শুনের সাহিত্যে মানবিক এসব বিষয়ের অনুসন্ধান করেছেন আলোচনায় অংশ নেওয়া গবেষকরা। বাংলা ও চীনা সাহিত্যের এই মিল অন্বেষণ নিঃসন্দেহে দু'দেশের মানুষকে আরও কাছাকাছি আসতে সাহায্য করবে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিনিময় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি চীনা মানুষের যে গভীর আবেগ ও ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে এক কথায় তা বিরল। বেইজিং যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইউ ছিউ ইয়াং তাঁর বক্তৃতায় বলেন, "বাংলা সাহিত্য বিশ্বের একটি সমৃদ্ধ সাহিত্যধারার অন্যতম। পড়াবার সময় আমরা এই দুটো ধারার কোনটাই উপেক্ষা করিনি। আমরা যেমন কাজী নজরুল ইসলাম ,শামসুর রাহমান,জসিম উদ্দিনের কবিতা পড়ি, তেমনি সতেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের কবিতাও পড়ি"।

বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীদের সত্যিকারভাবে বাংলা সাহিত্যের রস আস্বাধনের উপযোগী করে গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টার বর্ণনা আমরা তাঁর মুখে শুনেছি তা সত্যি মগ্ধ করার মত। মিজ ইয়াং বলছিলেন, "আমাদের শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাংলা ভাষা বিষয় বেছে নিয়েছিল, তখন বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। সেইজন্য আমাকে চেষ্টা করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার অনুভূতি, উপলব্ধি আরোপ করতে । এমন একটা সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে, এমনভাবে পাঠের বিষয় পড়াতে, যাতে আমার ছাত্রছাত্রী বাংলা ভাষার সূক্ষ্মতা এবং মাধুর্য অনুভব করতে পারে। বাঙালীর সামাজিক প্রথা, রীতি রেওয়াজ, জ্ঞান, আচার-আচরণ, আদব-কায়দা, মার্জিত রূচি,তাদের বিশ্বাস, মান-সম্মান, নীতিবোধ, ধর্মচর্চা, সমষ্টিগত মনোভাব, অর্জিত কীর্তিসমূহ এগুলো জেনে নিতে পারে। সেইজন্য চার বছর বি এ কোর্সের মধ্যে বাংলার সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ,ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়গুলো পড়ানো আমার নিজস্ব বাংলা শিক্ষার পরিকল্পনায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে"।

আর অনুষ্ঠানে চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিম বলেন "রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পাশাপাশি মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন জরুরী। সংস্কৃতির শক্তিই পারে সে বন্ধনকে দৃঢ়তর করতে"

তিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, " চীন ও বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধনকে কার্যকর ও সুদৃঢ় করতে এই আয়োজন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। এ ধরণের সংলাপ দু'টি দেশের মানুষের মাঝে বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে সুন্দর ভবিষ্যতের পথ রচনা করবে"।

রাষ্ট্রদূত ভবিষ্যতে এ ধরণের উদ্যোগে বাংলাদেশ দূতাবাসের অব্যাহত সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।

অনুষ্ঠান উপলক্ষে চীনের প্রচার ও প্রকাশনা সংস্থার উপ-মহা পরিচালক সিয়ে আই ওয়েই তাঁর বাণীতে বলেন, "এ অনুষ্ঠান চীন ও বাংলাদেশের ক্লাসিক্যাল গণসাহিত্য উপভোগ করার একটি সুযোগ। তাতে ইতিহাসের উত্থান-পতনের পাশাপাশি আধুনিক উজ্জ্বলতা দেখা যাবে। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ আদান-প্রদানের উত্কৃষ্ট গল্প তুলে ধরা হচ্ছে"।

অনুষ্ঠান উপলক্ষে সিআরআই এর মহাপরিচালক তাঁর বাণীতে চীনে বাংলা ভাষার প্রসার এবং উন্নয়নে বাংলা বিভাগের অভিভাবকত্বের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন,

'চীন এবং বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময়ের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। বর্তমানে নতুন মিডিয়ার দ্রুত উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে সিআরাই বাংলা ভাষায় চীনের একমাত্র গণমাধ্যম হিসেবে দু'দেশের পারস্পরিক বিনিময়ে জোরালো অবদান রাখতে চায়'।

শ্রোতা বন্ধুরা, চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগ আন্তরিকভাবে তার দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে।

(মহসীন)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040