ভবিষ্যতে চীনের সুপার হাইস্পিড ট্রেনের গতি হবে ঘন্টায় ৪০০০ কিলোমিটার!
  2017-09-06 09:23:01  cri



 

চীনের রাজধানী বেইজিং ও মধ্যচীনের শহর উহানের মধ্যে ব্যবধান ১১৫২ কিলোমিটার। বর্তমানে বেইজিং থেকে হাই স্পিড বা দ্রুতগতির ট্রেনে বসলে আপনি উহান পৌঁছে যেতে পারবেন ৫ ঘন্টায়। ধরা যাক, আপনি যদি এমন কোনো সুপার ফাস্ট বা সুপার হাইস্পিড ট্রেনে চড়ে বসেন যেটি ঘন্টায় ৪০০০ কিলোমিটার গতিতে চলে! হ্যাঁ, হিসেব কষে দেখুন, লাগবে মাত্র ২০ মিনিট!! না, আমরা মোটেই কোনো কল্পনার কথা বলছি না। এ ধরনের ট্রেন চালু হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সম্প্রতি উহানে অনুষ্ঠিত তৃতীয় চীন বাণিজ্যিক মহাকাশযান শীর্ষ ফোরামে, চীনের মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কর্পোরেশান (সিএএসসি) জানিয়েছে, সংস্থাটি এমন ধরনের সুপার ফাস্ট ট্রেন নিয়ে গবেষণা করছে এবং এ গবেষণা প্রকল্পের কাজ চলছে উহান শহরের জাতীয় মহাকাশযান শিল্প পার্কে। তার মানে, এটা আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে চীনের প্রথম সুপার ফাস্ট ট্রেন এই উহান শহরে নির্মিত হবে!

প্রকল্পের দায়িত্বশীল ব্যাক্তি মাও খাই বলেন, তারা চীনের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সাথে সুপার হাইস্পিড ট্রেন নিয়ে মতবিনিময় শুরু করেছেন। এ ধরনের ট্রেন নির্মিত হলে, তা হবে নতুন প্রজন্মের পরিবহনযান। সুপারসনিক গতিতে এ ট্রেন ছুটবে, তবে সেটা ঠিক আমাদের এখনকার ট্রেনের মতো না; এ ট্রেন লাইনের উপরে বা আরও সঠিকভাবে বললে, টিউবের মধ্য দিয়ে রীতিমতো উড়বে!!

প্রস্তাবিত এই সুপার ফাস্ট ট্রেনের গতি হবে বর্তমান হাই স্পিড ট্রেনের ১০ গুণ এবং সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানের ৫ গুণ! মাও খাই বলেন, এ ধরনের ট্রেন এমন এক পরিবেশে চলাচল করবে, যেখানে বাতাসের বাধা থাকবে না। এ ট্রেনের জন্য ম্যাগনেটিক লেভিটেশান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ফলে এ ট্রেন ঘর্ষণজনিত বাধার সম্মুখীন হবে না। তাই এই ট্রেনে গতি হবে প্রচণ্ড।

 

চীনে ইতোমধ্যেই ট্রেন চলাচলে ম্যাগনেটিক লেভিটেশান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে, নতুন ধরনের সুপার ফাস্ট ট্রেন চলবে পাইপের মধ্য দিয়ে, বায়ুশূন্য পরিবেশে। ১৯০৪ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট গড্ডার্ড এমন ধারণা প্রথম পেশ করেন যে, বায়ুশূন্য পাইপের মধ্য দিয়ে ট্রেন প্রচণ্ড গতিতে চলতে পারে।

মাও খাই বলেন, মানুষ বড় স্বপ্ন দেখে এবং তা দেখা উচিত। আগে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই বাস্তবে বায়ুশূন্য পাইপে ট্রেনলাইন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন অর্থ, প্রযুক্তি, শ্রম, ও চাহিদা আর কোনো সমস্যা নয়। চীনের আছে সুপার ফাস্ট ট্রেন তৈরির সব উপাদান।

সুপার ফাস্ট ট্রেনের ওপর আবহাওয়ার কোনো বিরূপ প্রভাব পড়তে পারবে না। এ ট্রেনে কোনো জৈব জ্বালানিও লাগবে না। এ ট্রেন সাবওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।

বর্তমানে বিশ্বে তিনটি কোম্পানি ১০০০ কিলোমিটার/ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি গতির ট্রেন নিয়ে গবেষণা করছে। এগুলো হচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্রের 'এইচটিটি' ও 'হাইড্রোলুপ ওয়ান' এবং চীনের একটি কোম্পানি।

'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাগল' নামে পরিচিত এলন মুস্ক 'এইচটিটি' কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের অন্যতম। তিনি স্পেস-এক্স এবং টেস্‌লা'সহ কয়েকটি বিখ্যাত কোম্পানির সিইও'ও বটে। প্রকাশিত তথ্যানুসারে, এইচটিটি কোম্পানি এখন ম্যাগনেটিক লেভিটেশান বায়ুশূন্য পাইপ নিয়ে গবেষণা করছে। এ ট্রেনের চাকা থাকবে এবং সর্বোচ্চ গতি হবে ১২০০ কিলোমিটার/ঘন্টা। ট্রেনটি যখন চলা শুরু করবে তখন এবং যখন থামবে তখন চাকার ব্যবহার হবে। অন্যদিকে, চীনা কোম্পানি যে ধরনের ট্রেন নিয়ে গবেষণা করছে, সে ধরনের ট্রেনে কোনো চাকা থাকবে না। এ ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি হবে ৪০০০ কিলোমটার/ঘন্টা। চীনা কোম্পানি এ খাতে গবেষণা দেরিতে শুরু করলেও, টার্গেট ঠিক করেছে সর্বোচ্চ।

চীন মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কর্পোরেশান (সিএএসসি) একটি গবেষণা-গ্রুপ গঠন করেছে। দেশ-বিদেশের ২০টি গবেষণালয়ও এ প্রকল্পে অংশ নেবে। বর্তমানে গবেষণাদলের ২০০টি কৃতিস্বত্ব আছে।

চীনের প্রস্তাবিত সুপার ফাস্ট ট্রেনের গবেষণা প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপ: ২০২০ সালের মধ্যে মূল প্রযুক্তি আয়ত্ত করা। ২০২৩ সালের মধ্যে গোটা ব্যবস্থার পরীক্ষা শেষ করা এবং ৬০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতির ও ১০০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতির যাত্রীবাহী ট্রেন উত্পাদন করা। আঞ্চলিক সুপার ফাস্ট ট্রেনের পরিবহন নেটওয়ার্ক স্থাপন সম্পন্ন করা।

দ্বিতীয় ধাপ: ২০২৭ সালের মধ্যে ২০০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতির ট্রেন নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করা এবং জাতীয় পর্যায়ে সুপার ফাস্ট ট্রেনের পরিবহন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা।

তৃতীয় ধাপ: ৪০০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতির ট্রেন নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করা এবং 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশ ও অঞ্চলে সুপার ফাস্ট গতির ট্রেনের পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

সুপার ফাস্ট ট্রেন এখন চীনের ইন্টারনেটে একটি হট ইস্যু। অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করছেন এবং নানান প্রশ্ন করছেন। আমাদের শ্রোতারাও নিশ্চয়ই এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চাইবেন। এখানে আমরা কিছু প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। বলা বাহুল্য, প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষের এবং উত্তরগুলো সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।

প্রশ্ন ১: এ ট্রেন কি নিরাপদ? এত দ্রুত গতিতে চললে যাত্রার শুরু ও শেষে কি যাত্রীদের শরীরের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না?

উত্তর: আমরা এ সমস্যা নিয়েই প্রথমে চিন্তা-গবেষণা করছি। ট্রেনের গতি শূন্য থেকে ধীরে ধীরে বাড়বে, হঠাত করে এর গতি ঘন্টায় হাজার কিলোমিটার হবে না। আবার থামার সময়ও ধীরে ধীরেই থামবে, চট করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাবে না। অতএব এ ট্রেন নিরাপদ এবং যাত্রীদের কোনো সমস্যা হবে না।

প্রশ্ন ২: সুপারসনিক বিমানের চালকরা সাধারণত বিশেষ কাপড় এবং অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করেন। তবে কি এ সুপারসনিক ট্রেনেও যাত্রীদের বিশেষ পোশাক বা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করতে হবে?

উত্তর: ট্রেন চলবে বায়ুশূন্য একটি পাইপের মধ্য দিয়ে এবং ট্রেনের ভিতরের বাতাসের চাপ, অক্সিজেনের পরিমাণ, তাপমাত্রা, শব্দ ইত্যাদি সবই থাকবে মানবদেহের সাথে মানানসই। যাত্রীদের মনে হবে তারা সাধারণ ট্রেনেই বসে আছেন। অতএব কোনো বিশেষ পোশাক বা অক্সিজেন মাস্ক লাগবে না।

প্রশ্ন ৩: এমন ট্রেন গবেষণা ও উত্পাদনে অর্থ কতো লাগবে? বিমান বা হাইস্পিড ট্রেনের চেয়ে টিকিটের দাম কি বেশি হবে?

উত্তর: নতুন একটি পরিবহনযান নিয়ে গবেষণায় অবশ্যই অর্থ ব্যয় হবে এবং এক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ লাগবে। তাই আমরা এ গবেষণায় বেসরকারি বিনিয়োগও ব্যবহার করব। আর এ ধরনের ট্রেনের টিকিটের মূল্য বিমানের চেয়ে বেশি হবে না। কারণ, সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই আমরা এ ধরনের ট্রেন চালুর কথা ভেবেছি। তাই তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই টিকিটের দাম রাখা হবে।

প্রশ্ন ৪: এমন ট্রেন কি সত্যিই বাস্তবসম্মত? এমন ট্রেনের প্রয়োজনীয়তাইবা কী?

উত্তর: যদি যুক্তরাষ্ট্র ১০০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতির ট্রেন নির্মাণ করতে পারে, তবে আমরা চীনারও তা পারবো। এ প্রকল্প বাস্তবসম্মত। আর আমাদের হিসেব অনুসারে, দেশে-বিদেশে এমন ট্রেনের চাহিদা আছে। তাই এ ট্রেন তৈরি এখন সময়ের দাবি। তা ছাড়া, গবেষণার ক্ষমতা, অর্থ, নির্মাণ প্রযুক্তি এবং দক্ষ কর্মীবাহিনী নিয়ে চীন এমন ধরনের ট্রেন তৈরি করতে সক্ষম।

(শিশির/আলিম/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040